রকিব হাসানের ‘ক্যাম্পাসে ভূত’ (তৃতীয় পর্ব)

অলংকরণ: ধ্রুব এষ

অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিংয়ে কোরি অ্যালেঙ্গারের সঙ্গে দেখা করল কিশোর। আকর্ষণীয় চেহারার একজন মহিলা। বয়স চল্লিশ। ডিন হ্যারল্ড দুজনের পরিচয় করিয়ে দিয়ে, ওদের রেখে বেরিয়ে গেলেন।

‘আপনি কি এখানেই থাকেন?’ জিগ্যেস করল কিশোর।

‘না, লস অ্যাঞ্জেলেসে। লরা বেঁচে থাকতে তাঁর সঙ্গে খুব একটা দেখা করিনি বলে এখন সত্যিই দুঃখ হচ্ছে।’

মহিলার কথা বলার ঢঙের সঙ্গে টিনার বলার মিল আছে, লক্ষ করল কিশোর। জিগ্যেস করল, তিনিও টেক্সাস থেকে এসেছেন কি না।

হাসলেন কোরি। ‘একসময় ছিলাম ওখানে। তার মানে কথার টানটা এখনো রয়ে গেছে, আমি অবশ্য ধরতে পারি না।’ তিনি জানালেন, লস অ্যাঞ্জেলেসের একটা মহিলা কলেজে লরা ওয়াইল্ডারের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁর, বন্ধুত্ব হয়েছে। ‘তারপর লরা এখানে চলে এলে ঘন ঘন তাকে চিঠি লিখতাম আমি, কিন্তু সে খুব কমই জবাব দিত, তাই শেষে যোগাযোগটা কেটে গিয়েছিল।’

একটা ব্যাপারে অবাক লাগল কিশোরের, মৃত বান্ধবীর সম্পর্কে প্রায় কিছুই বললেন না কোরি। কিশোর এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে বিব্রত হয়ে কোরি জানালেন, কিছুদিন হলো তাঁর স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। বললেন, ‘সত্যি কথাটাই বলি, লরার কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, পত্রিকায় ওর ভূতের কাহিনিটা পড়ে মনে হয়েছে। এখানে যে এসেছি, তার একটা কারণ, আমার আশা, ওর ব্যাপারে আলোচনা করলে হয়তো পুরোনো অনেক কথা মনে পড়বে আমার।’

কোরির কাছ থেকে জানতে পারল কিশোর, তিনি অবিবাহিত, এখন আর কলেজে পড়ান না, লস অ্যাঞ্জেলেসে স্যাবাক মেডিকেল ল্যাবরেটরি নামের একটা ল্যাবরেটরিতে কাজ করেন।

কথা শেষ হলো। তিনটার সময় প্রফেসর জনসন আর টিনার সঙ্গে লরার বাসাটা দেখতে যাওয়ার কথা। গাড়ি চালিয়ে সেখানে চলল কিশোর। কোরির সঙ্গে মিটিংয়ের কথাটা ভাবতে লাগল। যদিও মহিলাকে খুবই ভালো লেগেছে, কিন্তু কোথায় যেন একটা খটকা রয়ে গেছে, কেমন রহস্যময় মনে হয়েছে তাঁকে। কী যেন একটা গোপনীয়তা। যেটা ধরতে পারেনি ও।

স্টোনভিল শহরের প্রান্তে লরার বাসাটা এত বেশি গাছপালায় ঘেরা, মনে হয় যেন জঙ্গলের ভেতর। কাঠের তৈরি একটা দোতলা বাড়ি। কলেজের কাছেই। বাড়ির সামনে গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিলেন প্রফেসর জনসন আর টিনা। ওদের পাশে এনে গাড়ি রাখল কিশোর।

ঘণ্টা বাজাতেই দরজা খুলে দিলেন সুদর্শন চেহারার এক বৃদ্ধা। ‘ইনি মিসেস ব্রিক,’ কিশোরদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন জনসন।

‘মিস্টার ব্রিক কোথায়, মিসেস ব্রিক?’ জিগ্যেস করলেন জনসন।

‘কাজে বেরিয়েছে,’ জবাব দিলেন মিসেস ব্রিক।

কেন এসেছেন, তাঁকে জানালেন প্রফেসর জনসন।

‘অসুবিধা নেই,’ মিসেস ব্রিক বললেন। ‘ওপর তলাটা খালিই আছে। মিস ওয়াইল্ডার চলে যাওয়ার পর আবার ভাড়া দিয়েছিলাম। ওরাও গত হপ্তায় খালি করে দিয়ে চলে গেছে। কাজেই ওপরে গিয়ে বিনা দ্বিধায় দেখতে পারেন।’

ঘর ও ঘরের আসবাব সবই পুরোনো ফ্যাশনের। তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আরামদায়ক। গভীর মনোযোগে প্রতিটি ঘর পরীক্ষা করে দেখতে লাগল কিশোর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে আর অবাক হয়ে ভাবছে, এত দিন পর এখনো কি এখানে লরা ওয়াইল্ডারের নিখোঁজ হওয়ার কোনো সূত্র পাওয়া যাবে?

‘তাঁর জিনিসপত্র বের করে নিয়ে যাওয়ার আগে ঘরটাতে কী খোঁজা হয়েছিল?’ জিগ্যেস করল কিশোর।

‘না, খুব বেশি খোঁজা হয়নি,’ মিসেস ব্রিক জবাব দিলেন। ‘আর এখন খুঁজলেও কিছু পাওয়া যাবে না। দেয়ালে নতুন রং করা হয়েছে। কার্পেট আর আসবাব কয়েকবার করে পরিষ্কার করা হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, প্রফেসর ওয়াইল্ডার আমাদের বাড়িতে থাকতেন বটে, কিন্তু তাঁর সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না আমরা। বেশির ভাগ সময়ই ঘরের দরজা আটকে দিয়ে থাকতেন, একা থাকতেই ভালোবাসতেন তিনি।’

কোনোই লাভ হলো না এখানে এসে, ভাবছে কিশোর। বেরিয়ে এসে গাড়ির দিকে এগোনোর সময় প্রফেসর জনসন বললেন তাকে, ‘যদি ভেবে থাকো, আমার গ্যারেজে রাখা জিনিসপত্রের মধ্যে ক্যাটালিস্টের নামটা পাবে, তাহলে নিরাশ হতে হবে তোমাকে। কোনো কিছু দেখা বাকি রাখিনি আমি। তন্নতন্ন করে খুঁজেছি।’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘মনে হয় তাঁর গবেষণার সব কাগজপত্র তিনি ক্যাম্পাসেই রাখতেন। কলেজের কাজ কলেজে রেখে মনটাকে ফাঁকা করে বাড়িতে বসে থাকতেন। বাড়িতে খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া বোধ হয় কোনো কিছুই করতেন না।’

প্রফেসর আর টিনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠল কিশোর। ঘড়ি দেখল। চারটে বাজে। শহরে ঢুকে একটা দোকান থেকে স্যাবাক মেডিকেল ল্যাবরেটরিতে ফোন করে দেখা করার অনুমতি নিল। তারপর লস অ্যাঞ্জেলেসের উদ্দেশে রওনা হলো।

ফোন করে ভালোই করেছে। কারণ, লস অ্যাঞ্জেলেসে যখন পৌঁছাল ও, ল্যাবরেটরির অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। তবু কথা যেহেতু দিয়েছেন, কিশোরের জন্য অপেক্ষা করে বসে রইলেন পরিচালক। লম্বা একজন মানুষ। চোখে রিমলেস চশমা। আন্তরিকভাবেই কিশোরকে সাহাঘ্য করতে চাইলেন। কিন্তু কোরি অ্যালেঙ্গারের কাছে যা তথ্য পেয়েছে, তার চেয়ে বেশি কিছু আর পেল না এখানে কিশোর। এখানেই কাজ করেন কোরি। টেকনিশিয়ানের কাজ।

‘কোরির অতীত সম্পর্কে কী কী জানেন আপনি?’ জিগ্যেস করল কিশোর।

‘প্রায় কিছুই না। লস অ্যাঞ্জেলেস সিটির একজন বড় চিকিৎসক, ড. অ্যাডাম ফ্রিম্যানের সুপারিশে কোরিকে এখানে কাজ দিয়েছি আমরা। দিয়ে ভুল করিনি। খুব দক্ষ আর নির্ভরশীল মহিলা, কোরি অ্যালেঙ্গার।’

আরও নানা প্রশ্ন করল কিশোর। কিন্তু নতুন আর কোনো তথ্যই জানতে পারল না পরিচালকের কাছ থেকে। বাড়ি ফেরার পথে বারবার একটা কথা অবাক হয়ে ভাবতে লাগল ও, প্রফেসর জনসনের কাছে পাওয়া, লরার কাছে লেখা কোরির চিঠিপত্র থেকে প্রমাণিত হয়, তিনি একজন ধনী মানুষ। সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ান। তাহলে সাধারণ একটা ল্যাবরেটরিতে টেকনিশিয়ানের কাজ করেন কেন?

আরও পড়ুন