মুভি দেখার সময় কেন পপকর্ন খায় সবাই
সিনেমা হলের কথা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অন্ধকার ঘরে বড় পর্দায় মুভি দেখার দারুণ অনুভূতি। নয়তো লবিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে নাকে আসা সেই মনভোলানো গন্ধ, যা বলে দেয় মুভি দেখার মজা নিতে হলে একটা জিনিস এখনো কেনা বাকি। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। সেই মাখন–মাখন, নোনতা-মিষ্টি স্বাদের পপকর্নের কথাই বলছি। মুভি দেখার সঙ্গে পপকর্নের সম্পর্কটা যেন একেবারে হাতে হাত ধরে চলার মতো। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছ কি, মুভি দেখতে গেলেই আমরা সবাই কেন শুধু পপকর্ন খুঁজি? কেন আমরা চিপস বা অন্য কিছু না নিয়ে কেবল পপকর্ন নিয়েই হলে ঢুকি?
মুভি দেখার সময় কেন পপকর্ন খাই—সবাই তা জানার আগে একটু পপকর্নের ইতিহাস জেনে নেওয়া যাক। পপকর্নের জন্ম হয়েছে ভুট্টা থেকে। প্রায় ১০ হাজার বছর আগে মেক্সিকোতে তেওসিন্টে নামক একধরণের বুনো ঘাস থেকে মানুষ প্রথম ভুট্টা চাষ শুরু করে। সেই প্রাচীন ভুট্টা অবশ্য দেখতে আজকের ভুট্টার মতো ছিল না। তবে মানুষ যে খুব দ্রুতই এই ফসল চাষ শুরু করেছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় পেরুতে। সেখানে প্রায় ৭ হাজার বছর আগে প্রায় ৪৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ প্রাচীন মানুষের ভুট্টা চাষের জীবাশ্ম প্রমাণ পাওয়া গেছে।
যদিও যেকোনো ভুট্টাই কিছুটা ফোটে, তবে সিনেমা হলে বা দোকান থেকে আমরা যে পপকর্ন খাই, তা কিন্তু সাধারণ ভুট্টা নয়। এটি হলো বিশেষভাবে চাষ করা এক জাতের ভুট্টা। এই জাতের ভুট্টার বৈজ্ঞানিক নাম জিয়া মেস এভার্টা। শাঁসের ভেতরে বিশেষভাবে প্রচুর স্টার্চ থাকে, যা একে আরও ভালোভাবে ফুটতে সাহায্য করে। আর তাই এর স্বাদ হয় সবচেয়ে সেরা। বর্তমানে বিশ্বের বেশির ভাগ পপকর্ন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য পশ্চিমে অবস্থিত ‘কর্ন বেল্ট’ ভুট্টা চাষের প্রধান এলাকায় জন্মে।
মূলত ভুট্টার দানাকে তাপ দিলে যে শব্দ করে ফেটে যায়, সেটাই হলো পপকর্ন। ভুট্টার দানার বাইরের শক্ত খোসার ভেতরে থাকে তেল, পানি ও স্টার্চ। যখন একে গরম করা হয়, ভেতরের পানি বাষ্পে পরিণত হয়ে প্রচণ্ড চাপ তৈরি করে। এই চাপ সহ্য করতে না পেরে খোসাটি হঠাৎ ফেটে যায়। আর ভেতরের নরম অংশটি দ্রুত সাদা ফেনায় পরিণত হয়ে বাইরে বেরিয়ে শক্ত হয়ে যায়। ভুট্টা ফাটার সময় পপকর্নের সেই বিখ্যাত পপ আওয়াজ হয়। ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হলো ভুট্টা ফোটানোর জন্য সঠিক তাপমাত্রায়। এর চেয়ে খুব ধীরে গরম করলে বাষ্প বেরিয়ে যায় ও খোসা ফাটে না। আবার খুব দ্রুত ও বেশি গরম করলে ভেতরের অংশ শক্ত থেকে যায়।
ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকেই আমেরিকাজুড়ে পপকর্ন বেশ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তবে তখন কিন্তু সবাই একে আজকের নামে চিনত না। সেই সময় মজার এই খাবারটি পার্ল মানে ‘মুক্তা’ অথবা ‘ননপ্যারিল’ নামে বিক্রি হতো। অর্থাৎ পপকর্নের তখন দুটি সুন্দর নাম ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষের মুখে মুখে এর পপকর্ন শব্দটি ব্যবহার হতে থাকে। অবশেষে ১৮৪৮ সালের মধ্যে ‘পপকর্ন’ শব্দটি আনুষ্ঠানিকভাবে ডিকশনারি অব আমেরিকানিজমে জায়গা করে নেয়। সেই থেকেই এই মজার খাবারটি পপকর্ন নামটি পেয়ে যায়।
তবে পপকর্নের জনপ্রিয়তার পেছনে একজন মানুষের হাত ছিল, যার নাম চার্লস ক্রিয়েটরস। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের এক মিষ্টির দোকানের মালিক। চার্লস ক্রিয়েটরস তাঁর দোকানে চিনাবাদাম ভাজার জন্য একটি বাষ্পচালিত মেশিন তৈরি করেছিলেন। পরে নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে তিনি সেই মেশিনটিকে পাল্টে এমন এক মেশিন তৈরি করলেন, যা খুব দ্রুত দারুণ পপকর্ন ফোটাত। খেলাধুলার মাঠ কিংবা সিনেমা হলের মতো যেখানেই প্রচুর ভিড় জমত, সেখানেই চার্লস ক্রিয়েটরসের পপকর্ন মেশিন দেখা যেতে শুরু করল।
পপকর্নের জনপ্রিয়তার পেছনে শুধু সুস্বাদু স্বাদই ছিল, এমনটা নয়। বরং এটি তৈরি হতে দেখাটাও ছিল বেশ মজার তখন। তবে পপকর্ন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায় ১৯২৯ থেকে ১৯৩৩ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দার সময়। সেই ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের সময় মানুষ যখন কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন মাত্র ৫ বা ১০ সেন্টে এক ব্যাগ গরম পপকর্ন ছিল এক সাশ্রয়ী বিলাসিতা মানুষের কাছে। খুব কম খরচে সামান্য আনন্দ পাওয়ার এ সুযোগটিই পপকর্নকে দ্রুত সাধারণ মানুষের প্রিয় নাশতা করে তুলল। যা পরে সারা বিশ্বের ছড়িয়ে পড়ে।
মজার বিষয়, শুরুর দিকে সিনেমা হল মালিকেরা পপকর্নের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই রাখতে চাইতেন না। তখন সিনেমাকে দেখা হতো উচ্চবিত্তের এক বিলাসবহুল বিনোদন হিসেবে। হলগুলো ছিল বিশাল, সুন্দর কার্পেটে মোড়ানো। আর মালিকেরা চাইতেন না কেউ পপকর্ন খেয়ে সেই কার্পেট নোংরা করুক। তা ছাড়া নীরব সিনেমা দেখার জন্য তখন মানুষকে লেখাযুক্ত কার্ড পড়তে হতো, যা কেবল শিক্ষিতদের জন্যই সহজ ছিল। মূলত শব্দ আসার আগে মুভি ছিল নীরব। তাই ছবির চরিত্ররা কী কথা বলছে বা গল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ কী, তা বোঝাতে পর্দার ওপর বারবার লেখাযুক্ত কার্ড দেখানো হতো।
কিন্তু ১৯২০-এর দশকে যখন মুভিতে শব্দ যোগ হলো, তখন গল্প বোঝার জন্য আর পর্দার ওপর আসা লেখাযুক্ত কার্ড পড়ার দরকার হলো না। ফলে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত—যে কেউ মুভি দেখতে যেতে পারতেন। এর ফলে মুভি দ্রুত একটি সস্তা ও মজাদার বিনোদন হয়ে উঠল। পপকর্নের মতোই সিনেমাও সাধারণ মানুষের নাগালে চলে এল। তাই সেই নতুন দর্শকেরা হলে বসেই তাঁদের প্রিয় সস্তা খাবার পপকর্ন খেতে চাইলেন। আর এই চাহিদা থেকেই হলমালিকেরা ধীরে ধীরে সিনেমা হলে পপকর্ন কর্নার ও স্টল চালু করলেন।
পরে দেখা গেল, হলমালিকেরা সিনেমার টিকিট বিক্রি করে যে লাভ হয়, তার চেয়েও বেশি মুনাফা আসছে পপকর্ন বিক্রি করে। বিষয়টি বুঝতে পেরে বিশ্বের সব সিনেমা হল ধীরে ধীরে এই পপকর্ন বিক্রি শুরু করে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত জনপ্রিয়তা একটুও কমতে দেয়নি পপকর্ন। এখন সিনেমা হলে মুভি দেখার অভিজ্ঞতা মানে পপকর্ন খাওয়া হয়ে গেছে।
সূত্র: বিবিসি, সিএনএন, স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন