রহস্যের দুনিয়ায় কিংবদন্তি দানবের খোঁজে
মাঝেমধ্যে মনে হয়, করার মতো এত কিছু আছে যে এই ছোট্ট জীবনটা তার জন্য পর্যাপ্ত নয়। অবশ্য আমি যা যা করতে আগ্রহী, তা অভিভাবকদের চোখে এককথায় অর্থহীন। এই যেমন ধরো, ভিডিও গেম খেলা, অ্যানিমে দেখা, সিনেমা দেখা। একমাত্র বই পড়ার অভ্যাস বাদে বাকিগুলোর কোনোটাই সমাজ সেভাবে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখেছে বলে মনে পড়ে না। তাও কমিকস-মাঙ্গা পড়তে দেখলে ভুরু বাঁকা হয়ে যায়! সমাজ যা খুশি করুক, আমি তো আর থেমে নেই। নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়ে প্রতিটা অভ্যাসে কিছু কিছু বাতাস দিয়ে চলেছি নিত্যই। সমস্যা হচ্ছে, কোনোটাতেই ছাড় দিতে ইচ্ছা করে না। আর সব কটি চর্চা করার মতো যথেষ্ট সময় নেই।
মাঝেমধ্যে এমন হয় যে দুটো ভালো লাগার অভ্যাস একসঙ্গে উপভোগের সুযোগ চলে আসে। এই যেমন ধরো, ইদানীং একটা বইয়ের সিরিজ পড়ে গেম খেলার আনন্দ পাচ্ছি। লিট-আরপিজি (LitRPG) ধারার এই সিরিজটিতে মূলত ভিডিও গেমের ভঙ্গিতে লেখা হয়েছে গল্প। ঠিক তেমনি মজা পেয়েছি বোফুরি (BOFURI) অ্যানিমেটি দেখে, যা নিয়ে আগেও একবার তোমাদের বিস্তারিত জানানোর চেষ্টা করেছি। আজও তেমনই একটি অ্যানিমের কথা তোমাদের জানাব, যাতে বাস্তব জীবন ও গেমের জীবনকে পাশাপাশি রেখে এগিয়েছে ঘটনাক্রম। আর তোমরা অ্যানিমেটি দেখে গেম খেলার মতোই আনন্দ পাবে।
বলছিলাম শাংঘ্রি-লা ফ্রন্টিয়ার অ্যানিমেটির কথা। কাতারিনার লেখা এই গল্পের সন্ধান আমি প্রথমে পেয়েছিলাম এক ইউটিউব ভিডিও থেকে। এ ছাড়া সে সময় শহরের একটা দোকানে নিয়মিত মাঙ্গা খুঁজতে যেতাম। প্রচ্ছদে পাখির মাথাওয়ালা এক চরিত্রের ছবি আকর্ষণও করেছিল বেশ। কিন্তু সামর্থ্যের অভাবে আর সংগ্রহ করা হয়ে ওঠেনি। এর কিছুদিন পরই দেখলাম অ্যানিমে আসছে, ফলে বেশ আগ্রহ নিয়েই দেখতে বসলাম।
গল্পের কাহিনি অনেকটা এমন—রাকুরোও হিজুতোমে বেশ ব্যতিক্রম একটা ছেলে। সে গেম খেলতে ভীষণ পছন্দ করে। তবে ভালো ভালো নামীদামি গেমের পরিবর্তে প্রচুর ত্রুটিপূর্ণ, কঠিন ঝামেলাপূর্ণ, খেলোয়াড়ের অভাবে প্রায় বাতিলের খাতায় চলে যাওয়া গেমগুলো খুঁজে খুঁজে খেলাই তার অভ্যাস! আর কাজটা সে ভীষণ আনন্দ ও গর্বের সঙ্গেই করে থাকে। একটা গেম খেলা শেষ হলে দোকানে চলে যায় নতুন কোনো বিচ্ছিরি গেমের সন্ধানে। ওই একই দোকানে আরও একটি মেয়ে মাঝেমধ্যেই যায়। তবে গেম খেলার চেয়ে রাকুরোওর প্রতিই তার আগ্রহ বেশি। মেয়েটির নাম রেই সাইগা। কিঞ্চিৎ লাজুক স্বভাবের রেই তার ভালো লাগার কথা রাকুরোওকে বলে উঠতে পারে না। যদিও তারা একই স্কুলে পড়ে, কিন্তু রাকুরোও তাকে ঠিকমতো চেনেও না।
এমনই ঘটনা চলছিল। একদিন গেমের দোকানদার রাকুরোওকে গছিয়ে দিল বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় গেম—শাংঘ্রি-লা ফ্রন্টিয়ার। আজেবাজে গেম খেলে অভ্যস্ত ছেলেটি খানিক কৌতূহলেই শুরু করল খেলা। গেমটি মূলত ভিআর বা ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি গেম। এ গেমগুলোর ক্ষেত্রে চোখে অ্যাপল-ভিশনের মতো একধরনের গ্যাজেট সেঁটে নিলে খেলোয়াড়দের চেতনা সোজা পৌঁছে যায় গেমের দুনিয়ায়। গেমটি গুছিয়ে বানানো হলে সবকিছু নিখুঁতভাবে অনুভব করতে পারে খেলোয়াড়েরা। শাংঘ্রি-লা ফ্রন্টিয়ারের নির্মাতা নামকরা এক গেম কোম্পানি, এ খেলায় যুক্ত হয়েছে প্রায় ৩০ মিলিয়ন খেলোয়াড়, ফলে গেমটির ভেতরে খুঁটিনাটি যে ভয়ানক নিখুঁত, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রাকুরোও বরাবরের মতোই—সানরাকু—ছদ্মনাম ব্যবহার করে যোগ দেয় খেলায়। নিজের চরিত্রটিকে সে ভাগ্যের কোটায় বেশি পয়েন্ট দিয়ে তৈরি করে।
গেম শুরু হতেই সানরাকু বুঝতে পারে, তার এযাবৎকালে খেলা গেমগুলোর তুলনায় এই গেম ভীষণ ভিন্ন। এতে বিরাট কোনো ত্রুটি প্রায় নেই বললেই চলে। সবকিছুই বলতে গেলে সঠিক আঙ্গিকে আছে। যেমন দৌড়ঝাঁপ করা কিংবা গাছে ওঠা, লড়াই করা—সবই যেমন হওয়ার কথা, তেমনই হচ্ছে। তাই দেরি না করে নিজের লেভেল বাড়ানোর কাজে মন দেয় সে। লড়াই করে গবলিন, ভোরপাল খরগোশের মতো প্রাণীদের সঙ্গে। ৫০টা ভোরপাল খরগোশ বধ করে সে হাসিল করে দুটি কার্যকর ছুরি।
সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু ঘটনাচক্রে একদিন সে পড়ে গেল শাংঘ্রি-লা ফ্রন্টিয়ার গেমের অন্যতম কিংবদন্তি দানব—লিকাগন দ্য নাইটস্লেয়ারের খপ্পরে। শাংঘ্রি-লা ফ্রন্টিয়ার গেমে এমন দানব রয়েছে মোট সাতটি। যার মধ্যে কেবল চারটির নাম জানতে পেরেছে খেলোয়াড়েরা। বাকিগুলোর নাম পর্যন্ত কেউ জানে না। আর এসব দানবের একটাকেও এখন পর্যন্ত কেউ পরাজিত করতে পারেনি। সানরাকু এসবের বিন্দুবিসর্গ জানত না সে সময়। তবে হাল ছাড়তে সে নারাজ। আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে সে হারানোর চেষ্টা করে লিকাগনকে। শত শত নিখুঁত আঘাত করে আর আক্রমণ এড়িয়ে চেষ্টা করে জয় হাসিল করার। কিন্তু কাজটা মোটেই সহজ নয়। শেষতক হার মানতে বাধ্য হয় সে। তখনকার মতো মারা পড়ে দানবটির হাতে। জেগে উঠে সানরাকু দেখতে পায়, দানবের অভিশাপ বসে গেছে ওর দেহে। যত দিন দানবটিকে সরাসরি হারাতে না পারবে, এ অভিশাপ কাটানো সম্ভব হবে না। সুতরাং গেমটা খেলে যাওয়ার আরও জোরালো কারণ হাতে পায় সে। হারাতেই হবে এই কিংবদন্তি ভয়াল দানবকে। শুরু হয় আরও আরও লড়াই, অ্যাডভেঞ্চার, রহস্য উদ্ধারের যাত্রা।
শাংঘ্রি-লা ফ্রন্টিয়ার অবশ্য একেবারে শুরুতে মাঙ্গা নয়, বরং লাইট নভেল হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল স্বপ্রকাশিত লেখকদের ওয়েবসাইট সোসেৎসুকা-নি-নারোতে। সেখান থেকেই ২০২০ সাল নাগাদ আঁকিয়ে রুউস্কে ফুজি বইটি ধারাবাহিকভাবে মাঙ্গা মাধ্যমে রূপান্তরের কাজটি শুরু করেন। মাঙ্গাটি কোদানশার সাপ্তাহিক কিশোর ম্যাগাজিনে প্রকাশ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে নিয়ম মেনেই ভলিউম আকারে বাজারে আসে এবং অ্যানিমে নির্মাণকাজ এগোয়। স্টুডিও সিটুসির (C2C) প্রোডাকশনে মোহনীয় এই অ্যানিমেটি বলতে পারো একটি রত্ন। চমৎকার সব লড়াই, আনকোরা সব দানব, স্পেশাল এফেক্ট, কাহিনির নিয়মিত চমক একে করে তুলেছে সাধারণের থেকে ভিন্ন।
আরেকটা দিক, যা আমাকে সব সময় কাহিনির প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলে, তা হচ্ছে গল্পে আসা চরিত্রগুলো। এই গল্পে অনেক অনেক বিশেষ চরিত্র রয়েছে। আর এদের অধিকাংশই একমুখী নয়। এদের আছে বহুমাত্রিকতা। প্রত্যেকেই নিজের নিজের লক্ষ্য নিয়ে যোগ দিয়েছে শাংঘ্রি-লা ফ্রন্টিয়ার-এ। যেমন ধরো, সানরাকুর মূল উদ্দেশ্য আনন্দ লাভ। আবার রেই সাইগা যোগ দিয়েছে কেবল সানরাকুর সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য, তার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ খুঁজতে। তবে একই সঙ্গে রেই একজন দক্ষ গেমার, শাংঘ্রি-লা ফ্রন্টিয়ার-এর অন্যতম ক্ষমতাধর চরিত্র সে। আমানে তোয়া, চরিত্রটি বোধ হয় সবচেয়ে ঘোলাটে, সে কখন কী চায় বোঝা কঠিন। মাঝেমধ্যেই তোমাদের তাকে বাজে, আবার পরক্ষণেই ভালো বলে মনে হয়। আছে উওমি কেই, যে কিনা আরও অনেক উদ্ভট গেম খেলে খেলে সানরাকুর বন্ধু হয়ে গেছে। তাই বন্ধুর উৎসাহে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে যোগ দেয় খেলায়। বন্ধুর থেকে পিছিয়ে পড়তে সে বিন্দুমাত্র রাজি নয়।
গেমের খেলোয়াড়েরা তো বটেই, এমনকি এনপিসি (NPC = Non-Playable-Character), অর্থাৎ যারা গেমের ভেতরেই প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে নির্মিত, তারাও বেশ জরুরি। এ ক্ষেত্রে এমুল, বিলাক, ভাইজাশ, হাকামরি-নো-ওয়েদারমন, আরামিস, লিকাগন দ্য নাইটস্লেয়ার—এরা বিশেষ। মূলত এমুল আর সানরাকুর জুটি একই সঙ্গে কার্যকর ও আনন্দদায়ক। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, অ্যানিমেতে এমুল চরিত্রের কণ্ঠশিল্পী রিনা হিদাকা ও সানরাকু চরিত্রের কণ্ঠশিল্পী ইয়ুমা উচিদা, সিরিজটিতে কাজ শুরু করার পর এক পর্যায়ে ব্যক্তিজীবনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন।
এ তো গেল গেমের ভেতরে থাকা চরিত্ররা। শাংঘ্রি-লা ফ্রন্টিয়ার অ্যানিমেতে খোদ গেম নির্মাতারাও চলে এসেছেন চরিত্র হিসেবে। গেম কোম্পানির প্রোগ্রামার, ম্যানেজার—তাঁরা গেমকে আরও কঠিন আর উপভোগ্য করার জন্য প্রাণপাত করে দিচ্ছেন। খেলাটির প্রতি তাঁদের ভালোবাসার নমুনা তোমরা দেখতে পাবে তাঁদের কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে।
লেখক কাতারিনা নিজে মূলত একজন রোল-প্লেয়িং গেম ভক্ত। ফাইনাল ফ্যান্টাসি, মনস্টার হান্টার, ডার্ক সোলস, জেনোব্লেড ক্রনিক্যালস, এল্ডেন রিংয়ের মতো গেমগুলো তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে। আর এ ধরনের লেখালেখির ক্ষেত্রে আগ্রহ বাড়িয়েছে প্রবাসে থাকাকালে পড়া লাইট নভেল—দ্য ইরেগুলার অ্যাট হাইস্কুল। মূলত এ গল্প ওয়েবসাইট সোসেৎসুকা-নি-নারোতে পড়েছিলেন তিনি। তোমরা যারা এল্ডেন রিং গেমটি খেলেছ, তারা হয়তো শাংঘ্রি-লা ফ্রন্টিয়ার-এ সানরাকু চরিত্রটিকে একেবারে বর্মহীন রাখার পেছনের অনুপ্রেরণাটা ধরতে পারবে। আমি গেমটি প্রায় দুই শ ঘণ্টা খেলেছি। ভয়ানক কঠিন এই গেমটির মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নানা ধরনের চরিত্র নিয়ে একেবারে নিজের মতো করে আক্রমণ আর কৌশল সাজিয়ে গেমটি খেলা সম্ভব। ফলে একেবারে ঢাল-তলোয়ার ছাড়া খেলার যেমন স্বাধীনতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিরাট তলোয়ার নিয়ে খেলার উপায়, আবার চাইলে কেবল জাদু বা শুধু তিরন্দাজি করেও হারানো সম্ভব গেমটির ভয়ানক সব শত্রুকে। লেখক কাতারিনার একেবারে সীমিত অস্ত্র নিয়ে বর্মহীন থেকে কেবল আঘাত এড়ানোর দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে লড়াইয়ের কৌশলটি বেশি মনে ধরেছিল। আর সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে সানরাকুর চরিত্রটিকে নির্মাণ করা হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস।
অনেক কথাই বলা হলো, বাকি রয়ে গেল আরও অনেক কিছু। তোমরা সিরিজটি দেখা শুরু করলে বাকি কথাগুলোও দিব্যি জেনে যাবে। এখন পর্যন্ত দুটো সিজনে ৫০টির মতো পর্ব মুক্তি পেয়েছে এই ধারাবাহিকের। তৃতীয় সিজনের ঘোষণাও চলে এসেছে ইতিমধ্যে, আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি তার জন্য।
দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল তোমাদের এই অ্যানিমেটির ব্যাপারে জানাব, সে কাজটি সম্পন্ন হলো অবশেষে। যদিও এই সিজনে প্রায় ১৮টি অ্যানিমে ধারাবাহিক দেখছি, সেগুলোর অধিকাংশ নিয়ে বলার প্রয়োজন বোধ করছি না। তবে তোমরা জেনে খুশি হবে, সাকামোতো ডেজ, কাইজু নম্বর এইট, দান-দা-দান–এর মতো অ্যানিমেগুলোর দ্বিতীয় সিজন বর্তমানে চলছে এবং চমৎকারভাবে বিনোদিত করছে। নতুন সিজনের মধ্যে তোউগেন আনকি, গাচিআকুতা—এককথায় ফাটাফাটি হচ্ছে। এ ছাড়া টুকিটাকির মধ্যে ভালো লাগছে দ্য ওয়াটার ম্যাজিশিয়ান, অনমিও কাইতেন, সিক্রেটস অব দ্য সাইলেন্ট উইচ। এ ছাড়া আরেকটি অ্যানিমে বড় ভালো লাগছে, তবে নামটা এত বড় যে লিখতে ইচ্ছা করছে না। পরে কখনো সুযোগ পেলে ওটা নিয়ে তোমাদের বিস্তারিত জানানোর ইচ্ছা রইল। তোমরাও জানিয়ো শাংঘ্রি-লা ফ্রন্টিয়ার অ্যানিমেটি তোমাদের পছন্দ হলো কি না!