ভূত অদ্ভুত

মডেল: বিভা | ছবি: সুমন ইউসুফ

ভূত আছে কি নেই—সে এক বাজে তর্ক। ‘বাজে’ এই অর্থে যে এ নিয়ে তিন ধরনের মত আছে। এক দল বলে, ‘অবশ্যই আছে। দুনিয়ায় মানুষ যেমন আছে, তেমনি ভূতও আছে।’ আরেক দল ঘোরতর অবিশ্বাসী। তারা বলে, ‘ভূত? সে আবার কী? যত্তসব বোগাস!’ তৃতীয় দলে আছে মধ্যপন্থী। তাদের কথা জটিল। তারা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘এ এক অমীমাংসিত রহস্য। জগৎ-সংসারের সবটুকু কি আর জানি আমরা?’ মুশকিল হলো যে এই তিন দলের মত কখনোই এক হয় না। হবেও না। তাই এই তর্ক চলছে। চলবে।

তবে এই কথাও সত্যি যে বিজ্ঞান চর্চা করতে করতে যাঁরা জীবন পার করে দিয়েছেন এবং মনে-প্রাণে ভূতে অবিশ্বাস করেছেন, তাঁদের অনেকেই নিশুতি একাকী কবরখানা কিংবা পরিত্যক্ত নির্জন কোনো বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে হলে আদৌ স্বস্তি বোধ করেন না। ওই জায়গাটুকু দ্রুত পেরিয়ে যেতে পারলেই যেন রক্ষা। কেমন যেন অস্বস্তি হয়। মনে হয়, কেউ যেন দেখছে, পিছু নিচ্ছে। অথচ সাহস করে পেছনে তাকালে দেখা যায় না কিছু। অর্থাৎ, বাস্তবে ‘ওনারা’ থাকুন বা না-ই থাকুন, অনেকের মধ্যে মনের ভেতর বেশ শক্ত আসন পেতেই বসে আছেন ‘তেনারা’!

লোকে নাকি আজকাল ভূতে আর বিশ্বাস করে না। ভূত মানে নাকি অতীত! বললেই হলো? তাহলে এখনো কেন এমন দেদার বিক্রি হয় ভূতের বই? প্রতিবছর তৈরি হয় অসংখ্য ভূতের সিনেমা? পড়তে-লিখতে পারে এমন কেউ কি আছে, যে জীবনে একখানাও ভূতের গল্প পড়েনি? চোখে দেখতে পায় এমন কেউ কি আছে, যে জীবনে একটাও ভূতের নাটক কিংবা সিনেমা দেখেনি? কানে শুনতে পায় এমন কাউকে কি পাওয়া যাবে, যে কখনোই মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, নিদেনপক্ষে এফএম রেডিওর শরণাপন্ন হয়নি জমজমাট একখানা ভূতের গল্প শুনতে?

ঝমঝম বৃষ্টিপড়া রাতে খিচুড়ি-টিচুড়ি খেয়ে গায়ে কাঁথা টেনে উবু হয়ে শুয়ে ভূতের একটা গল্প পড়তে কার না ভালো লাগে! ছুটির অলস সন্ধ্যায় ছাদে বসে পেঁয়াজ-মরিচমাখা মুড়ি চিবোতে চিবোতে দাদি-নানির মুখে ভূতের গল্প শুনতে শুনতে আনমনেই চমকে পেছনে তাকানোর অভ্যাস এখনো হারিয়ে যায়নি অনেকেরই। ইন্টারনেট, মোবাইল, ডিভিডি—এসব ছাড়িয়েও এমন ‘খাঁটি’ ভৌতিক পরিবেশে ভূতের গল্প এখনো অনেক মানুষের প্রিয়, ভীষণ পছন্দের।

ভূতের গল্পও মানুষের মুখে মুখে ফিরছে সেই আদিকাল থেকে। সন-তারিখের হিসাবও যখন শুরু হয়নি, তখন থেকেই লোকের মুখে মুখে ফিরছে ভূতের গল্প। লোকমুখে চালু গল্প তো আছেই, বড় বড় সাহিত্যিকও লিখেছেন ভূতের গল্প। রবিঠাকুর তো লিখেই ক্ষান্ত দেননি, রীতিমতো ভূত নামানোর ‘প্ল্যানচেট’ চর্চাও করেছেন বলে জানা যায়!

যাঁরা ভাবছিলেন বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির কল্যাণে যখন কমে আসছে কুসংস্কার, কমে আসছে অন্ধকার জায়গা আর ভূতদের প্রিয় থাকার জায়গা, যেমন ‘তেঁতুল’, ‘বট’—এসব গাছ কেটে সুপার মার্কেট তৈরির হিড়িকে ভূতেরা বোধ হয় এবার হারিয়েই যাবে; তাদের সব আশঙ্কা মিথ্যে প্রমাণ করে দিব্যি মাথা উঁচু করে টিকে আছে ভূতসমাজ! তাই তো হ্যারি পটার যে স্কুলে পড়ে, সেই হগওয়ার্টস স্কুলেও ভূতের আনাগোনা অবিরত।

কোথায় জন্মে ভূত? এ নিয়েও নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন, মানুষ মরে ভূত হয়; আবার কারও কারও মতে ভূত রীতিমতো আলাদা এক জাতি— তাদের বিয়ে হয়, বাচ্চাকাচ্চাও হয়। অনেকেই নাকি গাছের মগডালে গেছোভূত আর শাঁকচুন্নির বিয়ে দেখেছেন স্বচক্ষে! তবে এ কথা নিশ্চিত, মানুষ মরে ভূত হলেও হতে পারে, কিন্তু ভূতের জীবন আছে কি নেই সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত ভূত-বিশেষজ্ঞরাও একমত হতে পারেননি। কেউ বলেন, ভূতের জীবন নেই বলেই তো সে ভূত; প্রাণ থাকলে তো সে মানুষই হতো! আবার কারও মত—মন্ত্র পড়ে, রসুন দিয়ে, বুকে গজাল ঠুকে—এমন নানা কায়দায় খতম বা নিকেশ করা যায় ভূত। নিকেশ বা খতম তো এ রকম মৃত্যুই! আর জীবন না থাকলে কি মরণ হতে পারে? হয় কখনো?

ভূত দেখতে কেমন? এর উত্তরে এককথায় সবাই বলে—ভয়ংকর!

তবে একেক ভূত দেখতে একেক রকম। দরকারমতো নাকি সে অন্য চেহারাও ধারণ করতে পারে। এমনকি ভোজবাজির মতো দিব্যি হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে। লোকে বলে, ভূতের চেহারা নাকি তেমন সুবিধের হয় না। সুদর্শন ভূতের খবর পাওয়া যায় কম! ভূত বিশ্বাসীরা বলেন, ভূতের চোখ হয় ভাটার মতো, নখ থাকে বড় বড়। হাত-পা ইয়া লম্বা লম্বা। যেসব ভূত ‘মানুষ’ সেজে থাকে, তাদেরও চেনা যায় পা দেখে। কারণ, ভূতের পা নাকি উল্টো! আবার কোনো ভূতের শরীরে মাংসের বালাই নেই; শুধু হাড়সর্বস্ব কঙ্কালকে সম্বল করে দিব্যি খটখটিয়ে সে ভয় দেখায় সবাইকে।

ভূত থাকে কোথায়?

কোথায় নয়? ভূত বিশ্বাসীদের দাবি, সবখানেই ভূতের দেখা মেলে। তা ছাড়া ভূতের শরীর খুব নমনীয় বলে ছোট ছোট জায়গায়ও থাকতে অসুবিধা হয় না কোনো। তা ছাড়া তারা বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে বলে ঠিক কোথায় যে তাদের বাস, সেটি বোঝা একটু মুশকিলও বটে। তবে সাধারণত গ্রামেই ভূত-পেতনিদের বসবাস বেশি। অশ্বত্থ, নিম, বট, তেঁতুল, বাঁশঝাড়—এসব জায়গা তাদের প্রধান আবাসস্থল। পোড়া বাড়ি তাদের খুব প্রিয়। কবরস্থান-শ্মশানঘাটে তাদের আনাগোনা একটু বেশি। আবার কিছু ভূত আছে নোংরা। তারা বাড়ির বাইরের শৌচাগারের কাছে রাত্রিবেলা ঘুরঘুর করে। কেউ রাতের বেলা প্রাকৃতিক কাজ সারতে গেলেই নাকি ভয় দেখায়! শহরেও যে ভূত নেই, তা নয়। একটু নিরিবিলি শহুরে হোটেল নাকি তাদের খুব প্রিয়। কামরায় একা পেলে গলা চেপে ধরতে চাওয়ার অভ্যাস নাকি যায়নি ভূতসমাজের অনেকেরই! এমনকি অত্যাধুনিক ফ্ল্যাটবাড়ির লিফটেও ভূত হানা দেয় বলে খবর পাওয়া যায়। লিফটে রাতের বেলা কাউকে একা পেলেই নাকি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে, ভয়ানক সব শব্দ করে ভয় দেখাতে আসে কোনো কোনো ভূত।

মডেল: বিভা, সাফি, দ্রাহা | ছবি: সুমন ইউসুফ

তবে যত দূর জানা গেছে, বেশির ভাগ ভূতেরই সূর্যের আলো তো বটেই, এমনকি বৈদ্যুতিক বাতির আলোয়ও অ্যালার্জি আছে। শহরে বৈদ্যুতিক আলো বেশি বলে, আর ওই আলোয় অ্যালার্জি হয় বলেই—গ্রামের তুলনায় শহরে ভূতের সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে কমে আসছে। লোকে বলে, বৈদ্যুতিক আলোর উৎপাত থেকে বাঁচতেই ভূতেরা নাকি রীতিমতো স্যাবোটাজ করে শহরজুড়ে লোডশেডিং ঘটানোর কলকাঠি নাড়ে! এই স্যাবোটাজ ঠেকাতে চিন্তাশীল লোকেরা তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠনের কথাও নাকি প্রস্তাব করেছেন!

কিন্তু কী খায় ভূত?

নাহ্, ছাগলের মতো সবকিছুই হামলে পড়ে খায় না ভূতেরা। তাদের এ ব্যাপারে বাছবিচার অনেক। মাছ ভূতের খুব প্রিয় খাবার। কেউ রাতের বেলা মাছ নিয়ে আসার সময় যদি চারপাশটা ফাঁকা থাকে, তবে নির্ঘাত পিছু নেবে, ভূত পিছে পিছে আসবে। আর নাকি সুরে ‘মাঁছ দেঁ, মাঁছ দেঁ’ বলে ঘ্যানঘ্যান করে জ্বালিয়ে মারবে। এ জাতের ভূতের হাত থেকে বাঁচা কঠিন নয়, স্রেফ পেছনে না তাকিয়ে ভূতের কথায় কান না দিয়ে হনহন করে হেঁটে বাড়ি এসে দরজার খিল আটকে বসে থাকলেই হলো। অনেক ভূত আবার বাড়িতে যখন ইলিশ মাছ ভাজা হয়, তখন রান্নাঘরের চারপাশে ঘুরঘুর করে, এমনকি ফাঁকতালে চুরিও করে। জানা যায়, একবার এক বাড়ির কর্ত্রী এই রকম ‘মাছচোর’ এক ভূতের উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে যেই নাকি ভূতে হাত বাড়িয়েছে মাছ নিতে, অমনি গরম খুন্তি ভূতের হাতে লাগিয়ে দিয়েছে ছ্যাঁকা। চোর-ভূত তো ‘বাঁবা গোঁ, মাঁ গোঁ, বাঁচাও’ বলে চিতৎকার করতে করতে পালিয়েছে। এই ঘটনার পর থেকে এই মাছচোর ভূতের উপদ্রব কিছুটা কম। তারপরও পদ্মা নদীর পাড়ে রাস্তার পারের দোকানে যখন বিক্রি হয় ইলিশ মাছ, তখন নাকি কিছু ভূত এখনো ছোঁকছোঁক করে বেড়ায়। দয়াপরবশ হয়ে কোনো কোনো দোকানি নাকি তুলেও দেয় ওদের হাতে। মাছের পাশাপাশি ভালো মিষ্টিও ভূতদের খুব প্রিয়। বিশেষ করে রসগোল্লা। কোনো কোনো ভূত, যারা ব্যবসা-ট্যাবসা করে বেশ দুই পয়সা কামিয়েছে, তারা পয়সা দিয়ে কিনে নিয়ে যায় হাঁড়িভর্তি কিংবা বড় বাক্সভর্তি রসগোল্লা। আর মাস্তান স্বভাবের ভূতেরা পয়সা দেওয়ার ধার ধারে না। রাতের বেলা আসে। মিষ্টি খেয়ে বিদায় নেয়। মিষ্টিতে ভেজাল থাকলে বা ভালো না হলে মুশকিল; রীতিমতো দোকানের মালসামান ভেঙে দিয়ে যায় ওসব মাস্তান ভূতের দল।

একবার রাতের দিকে পরিচিত এক মিষ্টির দোকানে যেতে হয়েছিল মিষ্টি অর্ডার করতে। অর্ডার যখন করছি, তখন মিষ্টির সব র্যাক খালি প্রায়—বিক্রি হয়ে গেছে। খালি এক র্যাকে বেশ কয়েকটা রসগোল্লা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখছিল কর্মচারী। আমি খানিকটা অবাক হয়ে দোকানমালিককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার? দোকান তো বন্ধ হয়ে যাবে এখনই। তাহলে অমন করে মিষ্টি সাজাচ্ছে কেন আপনার কর্মচারী? সারা রাত ওভাবে মিষ্টি বাইরে রাখলে তো নষ্ট হয়ে যাবে। ফ্রিজে রাখলেই হয়।’ দোকানি একটু নিচু গলায় বললেন, ‘না না, নষ্ট হবে না। রাতে ওনারা এসে খেয়ে যাবেন। মিষ্টি বাইরে না রাখলে মুশকিল। রেগেমেগে ওনারা দোকানের জিনিসপত্র সব ওলট-পালট করে দিয়ে যাবেন। তাই রোজ রাতেই কিছু মিষ্টি রেখে যাই এভাবে।’ ঘটনা তখনো মাথায় ঢোকেনি আমার। বোকার মতো জিজ্ঞেস করি, ‘দোকান তো তালাবদ্ধ থাকবে। বাইরের কেউ ভেতরে ঢুকবে কী করে?’ দোকানি আমার অজ্ঞতায় একটু হেসে নেয় প্রথমে। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলে, ‘তালা তো মানুষের জন্য। ওনাদের কি আর দোকানে তালা মেরে ভেতরে আসা বন্ধ করা যায় কখনো?’ অতক্ষণে মাথায় ঢোকে আমার—‘ওনারা’ মানে আসলে ‘তেনারা’! তবে খাবার ক্ষেত্রে বেশ বাড়াবাড়িও করে কিছু কিছু ভূত। কোনো কোনো দুষ্টু ভূত নাকি রীতিমতো কড়মড়িয়ে খায় মানুষ! তবে, আশার কথা যে এহেন ভূতের সংখ্যা অল্প। ভাগ্য ভালো—নইলে, এত দিনে মনুষ্যসমাজের সদস্যদের টিকে থাকাই মুশকিল হতো।

মডেল: মাশরাবা | ছবি: সুমন ইউসুফ

গুটেনবার্গ সাহেবের ছাপাখানা আবিষ্কারের যুগ থেকেই যে ভূতটি জগতের তাবৎ ছাপাখানার ঘাড়ে শক্তপোক্তভাবে রীতিমতো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো করে বেঁচেবর্তে আছে, সেই ‘ছাপাখানার ভূত’টির দৌরাত্ম্য আজও কমেনি এতটুকুও। ছাপাখানার ভূত সব সময় তক্কে তক্কে ওত পেতে থাকে; সুযোগ পেলেই বানান ভুল করিয়ে দেয়, লেখার কোনো লাইন একদম গায়েব করে ফেলে। কখনো-বা হাওয়া করে দেয় পুরো একটি অনুচ্ছেদও! পণ্ডিত লেখক, তুখোড় প্রুফ রিডার, কম্পিউটারের কারিগরি—সব ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত বিজয়ীর হাসি হাসে ছাপাখানার ভূতই। ওই ভূত বাবাজির কারসাজিতে যত সাবধানে ছাপাই হোক না কেন, কোনো না কোনো ভুল থেকেই যায়। অবিশ্বাসীরা বলেন, ‘এসব আর কিছু না। মানুষের অমনোযোগিতা। একটু সাবধানে কাজ করলেই এসব এড়ানো যায় সহজেই।’ বলা যত সহজ, করা কিন্তু তার চেয়ে হাজার গুণ কঠিন। কারণ, ছাপাখানার প্রেস, কম্পিউটার কম্পোজ সেকশন, প্রুফ রিডারের টেবিল—সবখানেই লুকিয়ে থাকে ওই ছাপাখানার ভূত!

ভূতদের কোনো নির্দিষ্ট পেশা নেই বলেই ভূতশুমারিতে তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তবে অনুসন্ধানে এ-ও জানা যাচ্ছে যে নানা কাজে তারা জড়িত হলেও মানুষকে ভয় দেখানোই তাদের প্রধান কাজ। ভয় না দেখাতে পারলে তাদের নাকি পেটের ভাত হজম হয় না, ঘুমের অসুবিধা হয়, বুক ধড়ফড় করে। তা ছাড়া মানুষকে নিয়মিত পিলে চমকে ভয় না দেখাতে পারলে ভূতসমাজে মুখ দেখানোই দায় হয়ে পড়ে—অমন অকম্মা ভূতকে দেখলে বাকি ভূতেরা মুখ টিপে হাসে। আড়ালে-আবডালে বলে বেড়ায়, ‘ও হলো ভূত নামের কলঙ্ক! ওই ব্যাটা তো মানুষেরও অধম!’ তবে এ কথাও সত্য, বেশির ভাগ ভূতই খুব পরিশ্রমী, এক মুহূর্ত চুপ করে অলস সময় কাটায় না, অবসর তার নেই বললেই চলে—নানা কাজে সে ব্যস্ত থাকে সব সময়। এই পানির কল খুলে দিল, সে পরমুহূর্তেই ক্যাঁচ শব্দ করে বন্ধ দরজাটা খুলে দিল। কিংবা গভীর রাতে ছাদে জোরে জোরে দৌড়ে বাড়ির সব মানুষের ঘুম বরবাদ করল। অথবা জোরে ফুঁ দিয়ে শোঁ শোঁ আওয়াজ তুলে নিভিয়ে দিল মোমবাতি। দিনের আলোয় বেরোনো মুশকিল বলে ভূতেরা দিনের বেলায় পার্টটাইম কাজ করে। রাতই তাদের ফুলটাইম কাজের সময়। তবে কোনো কোনো কাজপাগল ভূত রাতের মতো দিনের বেলায়ও কাজের চাপে দম ফেলার ফুরসত পায় না। এই ভূতেরা ঠিক ‘দুপুরবেলা ঠেলা মেরে’ ভয় দেখাতে ভারি ওস্তাদ।

ভূতের ভয় অনেকেরই আছে, কিন্তু ভূত বলে কি সত্যিই কিছু আছে? নাকি সবটাই মানুষের কল্পনা?
মডেল: সাফি | ছবি: সুমন ইউসুফ

ভূতের শক্তি অনেক। কোনো কোনো ভূত দেখতে প্যাঁকাটি-মার্কা হলেও গায়ে তাদের ভীষণ জোর। ভূত-তাড়ানি ওঝার মন্ত্র সহ্য না করতে পেরে ঝপ ঝপ করে পালানোর সময় বিদায়ের স্মারক চিহ্ন হিসেবে ভেঙে দিয়ে যায় কোনো বড় গাছের মাথা। অত বড় গাছ ভাঙা তো যেমন-তেমন কাজ নয়, অনেক শক্তির ব্যাপার। অর্থাৎ, এটি জ্যামিতির উপপাদ্যের মতোই প্রমাণিত সত্য যে ভূতের গায়ে অনেক জোর। অর্থাৎ, যেচে পড়ে ভূতের সঙ্গে ‘কুস্তি লড়তে’ না যাওয়াটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ইয়া ইয়া মাসল না থাকলে এ ধরনের লড়াইয়ে না নামাটাই উত্তম।

তা ছাড়া শরীর ইচ্ছেমতো বড়-ছোট করতে পারে বলে কাজকম্মে সুবিধাও হয় বেশি। যেমন, এক ভূত বউ সেজে জামাইকে খাওয়ানোর সময় জামাই লেবু চাইতেই সে বাড়িতে বসেই হাতটাকে দশ হাত লম্বা করে বাড়ির বাইরের বাগান থেকে লেবু পেড়ে আনে! অনেকটা যেন আধুনিক যুগের ‘প্লাস্টিক ম্যান’! শুধু যে শরীরের আকার বড়-ছোট করতে পারে ভূত, তা তো নয়, ইচ্ছেমতো নানা চেহারাও ধারণ করতে পারে তারা। এই মুহূর্তে মানুষ, তো পরমুহূর্তেই বানর, আর তারপরের মুহূর্তেই বিড়াল। আবার বেমালুম হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ায় জুড়ি নেই ভূতের। এই আছে, আবার এই নেই। অর্থাৎ, যখন আমরা এই লেখাটি পড়ছি, তখন যে আমাদের ঘাড়ের পেছন থেকে অদৃশ্য কোনো ভূত উঁকি মেরে এই লেখাটি পড়ছে না, সে কথা হলফ করে বলা মুশকিল!

আরও পড়ুন

ভূত চিনব কী করে? এ বড় মুশকিলের ব্যাপার। ইচ্ছেমতো চেহারা বদলে ফেলতে পারে বলে ভূত চেনা সহজ কম্ম নয়। তবে কিছু কিছু লক্ষণ দেখে ভূত চেনার চেষ্টা করা যেতে পারে। যেমন কাউকে যদি যখন-তখন বেমালুম হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেখা যায়, তাহলে বুঝতে হবে মানুষটি হয় ম্যাজিশিয়ান, কিংবা নির্ঘাত ভূত। আবার ভূতের পা-এর পাশ উল্টে থাকে বলে সেদিকে নজর করেও চেনা যায় ভূত। আর ঝকঝকে সূর্যের আলোয় যখন দুনিয়ার তাবৎ লোকের ছায়া পড়ে, তখনো ভূতের কোনো ছায়া পড়ে না। এই ‘ছায়ার অভাব’ দেখেও অনেকে ভূত চেনে। লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, গায়ের আঁশটে গন্ধ থেকেও নাকি চেনা যায় ভূত। তবে, আজকাল সস্তায় নানা সুগন্ধি পাওয়া যায় বলে এ পদ্ধতি ততটা কার্যকর নয় বলে মত অভিজ্ঞদের। আর ‘চন্দ্রবিন্দু’যুক্ত কথাবার্তা শুনেও তাদের চেনা যেতে পারে। তবে তাতে আবার সর্দি লাগা মানুষের সঙ্গে যেন গুলিয়ে না ফেলা হয়, সেদিকেও সতর্ক থাকতে হবে বৈকি!

মানুষই যে খালি ভূতে ভয় পায় তা কিন্তু নয়। মানুষও নানা কায়দা আবিষ্কার করেছে ভূতকে ভয় দেখানোর। আলো, লোহা, হলুদ পোড়া, মরিচ পোড়া—এসব ভূতদের একদম সহ্য হয় না। তাই ভূতের উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে মানুষের দল এসব দিয়ে ভূতকে ভয় দেখায়। তা ছাড়া ‘মন্ত্র’কেও ভারি ভয় পায় ভূত। এসব মন্ত্র পড়ে ভূতের কানে জ্বালাপোড়া ধরিয়ে ভূত তাড়ায় মানুষ। আর মানুষের মতোই ঝাঁটার বাড়িও ভারি না-পছন্দ ভূতের। তাই কাউকে ভূতে ধরলে ওঝা ঝাঁটার বাড়ি মেরে বাড়িছাড়া করে ভূত-বাবাজিকে। তবে এগুলো আসলে কুসংস্কার।

মডেল: দ্রাহা | ছবি: সুমন ইউসুফ

শুধু যে মানুষ মরেই ভূত হয়, এমন নয়। বহু জীবজন্তু, পশু-পাখি মরেও দিব্যি ভূত হয়ে যায় প্রায়ই। বিশেষত কালো কুকুর ও কালো বিড়াল মরে ভূত হওয়ার হার বেশি বলে জানা যায়; অন্তত অফিসের গাবদা গাবদা রিপোর্ট এমন কথাই বলে। শুধু কী জীবজন্তু, খোদ একটা গাড়ি বা জাহাজও ভূত হতে পারে। সাধারণত পাহাড়ি খাদে পড়ে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া গাড়ি কিংবা বহু যাত্রীসহ সমুদ্রে ডুবে যাওয়া জাহাজও ভূতে পরিণত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। যেদিন ওই দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সাধারণত ওই তারিখে ফিরে আসে ওই ভূতগাড়ি কিংবা জাহাজ। কোনো কোনো পুরোনো গাছ, বিশেষ করে বট আর তেঁতুলগাছও নাকি ভূত হয়ে ভয় দেখায় মানুষকে। বাঁশগাছের ক্ষেত্রে ভূত হওয়ার অপবাদ রয়েছে। পাড়াগাঁয়ে রাতের বেলা একাকী পথ চলতে যদি দেখা যায় একটি বাঁশ হেলে পড়ে আছে, তবে তা ডিঙাতে নেই; ডিঙালেই নাকি পড়তে হয় ভূতের খপ্পরে। আর যদি না ডিঙিয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে কোনো বিপদ হয় না, বাঁশটা মিলিয়ে যায় আপনাতেই।

গ্রাম কিংবা শহর—সবখানেই অল্পবিস্তর ভুতুড়ে বাড়ির খোঁজ পাওয়া যায়। এসব বাড়িতে নাকি রাতে শোনা যায় অট্টহাসি, কিংবা নূপুরের শব্দ। অথবা হঠাৎ হঠাৎ দেখা মেলে সাদা কাপড় পরা কোনো অশরীরীর। বাতাস ছাড়াই আপনাতেই দড়াম করে বন্ধ হয়ে যায় দরজার কপাট। বলা নেই-কওয়া নেই, হঠাৎ করে বয়ে যায় হাড় কাঁপানো ঠান্ডা বাতাস। এসব করে ভূতসমাজের সদস্যরা যেন জানান দেন, ‘তেনারা’ আছেন। এসব বাড়িকেই হানাবাড়ি বলে।

আরও পড়ুন

পরলোকগত আত্মা, সাদা কথায় ভূতের সঙ্গে যোগাযোগের ভারি চমত্কার একটি কায়দা হলো ‘প্ল্যানচেট’। কজন মিলে অন্ধকার ঘরে একে অন্যের হাত ধরে গোল হয়ে বসে একাগ্রচিত্তে নির্দিষ্ট কোনো মৃত ব্যক্তির কথা ভাবলেই ওই মৃতের আত্মা এসে ভর করে প্ল্যানচেটে বসা একজনের ঘাড়ে—যাকে বলা হয় মিডিয়াম। তারপর মিডিয়ামের মাধ্যমে ভূতের সঙ্গে সাক্ষাৎকারপর্ব চালানো যায়। প্ল্যানচেটে আসলেই ভূত নামে কি নামে না, সে বিষয়ে তর্ক থাকলেও প্ল্যানচেটের অছিলায় বন্ধুদের জমায়েত হয় বলে বেশ একটা পিকনিক-পিকনিক ভাব যে তৈরি হয়, তাতে কোনো দ্বিমত নেই।

প্ল্যানচেটে আসলেই ভূত নামে কিনা সে নিয়ে বিতর্ক কিন্তু অনেক দিনের
মডেল: সাফি, মাশরাবা, আলভী, মৌনতা ও রাফি | ছবি: সুমন ইউসুফ

কিন্তু অনেকেই হয়তো জানে না, ভূতের আতঙ্কের চেয়েও তীব্র অনেক ভয় এই জগতে আছে। চারপাশে এত এত খাবার, কিন্তু ক্ষুধার্ত কারও জন্য খাবার কিছু নেই, চরম বিপদে পড়ে শত চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে আসবে না, এর চেয়ে ভয়ংকর আর কি কিছু হয়? তবে ভূতের ভয় জয় না করতে পারলেও এসব ভয় কিন্তু আমরা চাইলেই দূর করতে পারি।

নানি-দাদির কোলে বা পাশে বসে ভূতের গল্প শুনে শুনে বড় হওয়ার আনন্দ অতুলনীয়। ভূতের সিনেমা দেখে ভয় পাওয়ার মজাই আলাদা। বৃষ্টিভেজা রাতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ভূতের গল্প পড়ার আনন্দের কোনো জুড়ি নেই। এসবই ভীষণ দামি, ভীষণ প্রিয়।

তবে, অশরীরী ভূতের ভয়ের রাজ্যের বাইরেও আরও যেসব ভয়ংকর-ভয়াল ব্যাপার রয়েছে, সেগুলো যেন আমরা কখনো ভুলে না যাই।