১৬ বছর ধরে ক্লাসের সবচেয়ে নিয়মিত এক শিক্ষার্থী

সবাইকে অবাক করে দিয়ে ক্লাসে ঢুকে পড়ল একটি বিড়ালপ্রতীকী ছবি: ফ্রিপিক

১৯৫২ সাল। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে তখন শরৎকাল। সেখানকার শিশুদের এক স্কুলে প্রতিদিনের মতো ক্লাসে শিক্ষক প্রবেশ করলেন। নাম ডাকার পর শিক্ষার্থীদের বললেন, যেন তারা তাদের পড়ার বই খুলে ডেস্কের ওপর রাখে। এরপর শিক্ষক শুরু করলেন পড়ানো। শিক্ষকের সঙ্গে শিশুরাও সুর করে পড়তে শুরু করল।

এমন সময় ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ। কেউ একজন দরজা খোলার চেষ্টা করছে। সবাই ভাবল, হয়তো প্রধান শিক্ষক ক্লাসে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন! অথবা অন্য কোনো শিক্ষক! নাকি নতুন কোনো শিক্ষার্থী?

সবাইকে অবাক করে দিয়ে ক্লাসে ঢুকে পড়ল একটি বিড়াল। কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সোজা গিয়ে শিক্ষকের পেছনে থাকা টেবিলে উঠে পড়ল বিড়ালটা। এরপর সটান হয়ে শুয়ে পড়ল টেবিলে।

নাদুসনুদুস এই বিড়ালটি দেখে সবাই অবাক। কোথা থেকে এল? আর কেনই বা এল? তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে খুব ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত।

আরও পড়ুন

ক্লাস থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করাই বৃথা। কোনোভাবেই সে ক্লাস থেকে বের হবে না। যখন ক্লাসের সবাই বুঝল সে ক্ষুধার্ত তখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বিড়ালটিকে দুধ খেতে দিলেন। দুধ খেয়ে বিড়ালটি বিদায় নেওয়ার নামও নিল না; বরং টেবিল থেকে নেমে ক্লাসের এক কোনায় গিয়ে এমনভাবে বসল, যেন এবার সে পাঠ গ্রহণ করার জন্য তৈরি।

ঘটনাটি আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসের অ্যালিসিয়ান হাইটস এলিমেন্টরি স্কুলের। সেই শ্রেণির সব পিরিয়ড শেষ হওয়ার পর সে–ও অন্যদের মতো এমনভাবে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল, যেন সেদিনের মতো বিদায় নিচ্ছে এক শিক্ষার্থী।

পরের দিন ক্লাস শুরু হওয়ার পর সে আবার এসে হাজির। তার পরের দিনও যথারীতি আগের মতোই ক্লাস করতে এল সে। ক্লাসে ঢুকে আগের মতোই দুধ খেল। তারপর তার বেছে নেওয়া স্থানে গিয়ে এমন ভাবে বসল, যেন ক্লাসের মনোযোগী ছাত্রটি তার পড়া বুঝে নিতে প্রস্তুত।

আরও পড়ুন

সেই যে শুরু এরপর একটি বা দুটি দিন নয়, একটি বা দুটি মাস নয়, এমনকি একটি বা দুটি বছর নয়, টানা ১৬ বছর সেই স্কুলে। আরও বিশেষ করে বললে, সেই ক্লাসের সবচেয়ে নিয়মিত ছাত্র ছিল সেই বিড়ালটি।

ফোর্থ গ্রেড বা চতুর্থ শ্রেণির এই ছাত্রের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রুম এইট’। কারণ, স্কুলের ৮ নম্বর রুমে ফোর্থ গ্রেডের ক্লাস নেওয়া হতো।

‘রুম এইট’–এর মালিককে খুঁজে পাওয়া যায়নি কোনো দিন। কেউ এসে দাবি করেনি, এটি তাদের বিড়াল। রাতের বেলায় সে কোথায় যেত অনেক চেষ্টা করে সেটা বের করা সম্ভব হয়নি। রাতে সে যেখানেই থাকুক, দিনের বেলায় সে স্কুলে আরও বিশেষ করে ফোর্থ গ্রেডের সেই রুমে এসে হাজির হতো।

এক সময় রুম এইট নামের বিড়ালটি ফোর্থ গ্রেড ও স্কুলের প্রতীকে পরিণত হলো। ইতিমধ্যে পুরো শহর জেনে গেলে রুম এইটের নাম। তারপর একসময় সারা আমেরিকা। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষটি হচ্ছে ১৬ বছরে রুম এইট একটি দিন ক্লাস মিস করেনি।

তার নিয়মিত রুটিনে ছেদ পড়ল ১৯৬৩ সালে। সে বছর অন্য এক বিড়ালের সঙ্গে মারামারি করতে গিয়ে মার খেয়ে রুম এইট বেশ আহত হলো। ফলে স্কুলে তাঁকে থাকতো হলো কিছুদিন। কিন্তু আট নাম্বার রুম সে ত্যাগ করেনি। এর কিছুদিন পর আবিষ্কার করা হলো সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত।

আরও পড়ুন

১৯৬৪ সালে যখন বিড়ালটি অসুস্থ হয়ে পড়ল, রুম এইট ওরফে ফোর্থ গ্রেডের ক্লাস টিচার ভার্জিনিয়া ভিনালেসন বিড়ালটিকে তাঁর নিজের বাসায় নিয়ে যান। রাতে সে মিসেস ভার্জিনিয়ার বাসায় থাকত; আর দিনের বেলায় রুম এইট ক্লাস করতে আসত রুম এইটে।

এলিসিয়ান স্কুল শুধু রুম এইট বা ফোর্থ গ্রেডের এক ছাত্র হিসেবে নয়, এই স্কুলের এক নিয়মিত ছাত্র হিসেবে বিড়ালটিকে সম্মান জানাতে শুরু করল। প্রতিবছর স্কুলের স্টুডেন্ট ইয়ারবুকে রুম এইটের ছবি ছাপা হতো লাগল।

১৯৫২ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত রুম এইটের ছবি স্কুলের ছাত্র হিসেবে নিয়মিতভাবে ছাপা হয়েছে। এরপর থেকে রুম এইটের ছবি স্কুলের স্টুডেন্ট ইয়ার বুকে ছাপা বন্ধ হয়ে গেল। কারণ, তত দিনে রুম এইট দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে।

১১ আগস্ট ১৯৬৮ সালে রুম এইট নামের বিড়ালটি মারা গেল। তার বয়স হয়েছিল সম্ভবত ২২ বছর। রুম এইট নামের বিড়ালটিকে লস অ্যাঞ্জেলেস পেট মেমোরিয়াল পার্কে সমাহিত করা হলো।

লস অ্যাঞ্জেলেসের অনেক পত্রিকায় তার মৃত্যুতে এক বিশেষ কলাম ছাপা হয়েছিল। কারণ, তাদের চোখে সে ছিল ক্লাসের সবচেয়ে নিয়মিত এক ছাত্র। যে কি না একটি দিনও ক্লাস মিস করেনি, অথবা সেই সময়ের সবচেয়ে শিক্ষিত বিড়াল।

আরও পড়ুন