রোমানি জিপসিদের ভাষায় এত বাংলা শব্দ এল কোথা থেকে
ইনস্টাগ্রামের একটি ছোট্ট ভিডিও আমার নজর কাড়ল। দুজন লোক পাশাপাশি বসে নিজেদের ভাষায় কিছু শব্দ বলছেন। একজনের ভাষা হলো রোমানি জিপসি। ইউরোপীয় প্রাচীন যাযাবর জনগোষ্ঠীর ভাষায় তিনি কথা বলতে পারেন। অন্যজন উর্দু ও পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলেন। দেখা গেল, দুজনের ভাষার মধ্যে খুব মিল। খেয়াল করলাম, এই দুজনের ভাষার সঙ্গে আমাদের বাংলা ভাষারও বেশ মিল আছে।
রোমানি জিপসি, উর্দু, পাঞ্জাবি কিংবা বাংলা ভাষা, সব কটির মূল বা শিকড় দক্ষিণ এশিয়ায়। এগুলো ইন্দো-আর্য ভাষা বংশের অংশ। যেমন আমাদের তিন ভাষায় পানিকে পানি বলা হয়। রোমানি জিপসিতে আমারও, তোমারও, উর্দু বা বাংলায় আমার–তোমার ব্যবহার করা হয়। একইভাবে পুরাতনকে তিন ভাষায় বলা হচ্ছে পুরানো–পুরানো–পুরানো। উর্দু–পাঞ্জাবি–বাংলায় এক–দুই–তিন, রোমানি জিপসিতে এক–দই–ত্রিন। একইভাবে কালা, কালো ইত্যাদি। এমন বহু শব্দ দূরের এই দুই ভাষাভাষীর ভাষায় মিলে যায়। এই ভাষার সঙ্গে আমাদের বাংলা ভাষারও অদ্ভুত মিল।
এই ভিডিওতে অবশ্য রোমানি ভাষার লোক রহস্যের সমাধান করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রহস্য হলো, রোমানি জিপসিরা এক হাজার বছর আগে ভারত থেকে ইউরোপে মাইগ্রেশন করেছিল। তাই দূরত্ব দুই মহাদেশের হলেও একই পূর্বপুরুষ থাকায় ভাষাগত মিল থেকেই গেছে। ভিডিওটি দেখা যাবে এখানে।
বিশ্বজুড়ে সাত হাজারের বেশি ভাষা প্রচলিত আছে। কিন্তু ভাষাগুলো সমানভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। দেখা যায়, কোনো বন বা পাহাড়ি উপত্যকায় ঘন ঘন ভাষা বদলে গেছে। সেখানে এক গ্রাম থেকে পাশের গ্রামেই আলাদা ভাষার প্রচলন হয়েছে। পাহাড় ডিঙিয়ে ওপাশে গেলেই একটা শব্দ নতুনভাবে উচ্চারণ করছে মানুষ। আবার কোথাও হাজার কিলোমিটারজুড়ে প্রায় একই ভাষা মানুষ ব্যবহার করছে। ভাষাবিজ্ঞানীরা দেখেছেন, যেখানে মানুষের গোষ্ঠী প্রাকৃতিক কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, যেমন ঘন বন, দুর্গম পাহাড়, নদী বা সমুদ্র, সেখানে ছোট ছোট দলগুলো নিজেদের আলাদা সমাজ বা জগৎ তৈরি করে। এই বিচ্ছিন্নতা ভাষাকে নিজের মতো বদলে দিতে পারে। নতুন প্রজন্ম নিজেদের কণ্ঠে নতুন শব্দ আনে, ধ্বনি বদলে যায়, শব্দের মানে বদলে যায়। এভাবে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ নতুন ভাষা তৈরি হয়।
অন্যদিকে যেখানে জীবনের অনিশ্চিত ঝড়–বন্যা, বরফ, খাদ্যের অভাব দেখা দেয়, সেখানে মানুষ টিকে থাকার জন্য বড় নেটওয়ার্কে একত্র হয়। বড় গোষ্ঠীতে টিকে থাকা সহজ। কিন্তু ভাষা তখন আলাদা থাকতে পারে না। এক ভাষা আরেকটির সঙ্গে মিশে যায়, মিলে যায়। আলাদা ধ্বনিগুলো ধীরে ধীরে এক হয়ে একই ভাষায় রূপ নেয়। আলাদা ভাষা তখন টিকে থাকার জন্য পার্থক্যের তুলনায় মিলের দিকে বেশি সরে আসে।
কিন্তু এসব ব্যাখ্যা সব ক্ষেত্রে খাটে না। কোথাও ভাষা তৈরি হয়েছে প্রজন্মের ভাঙনে। এক গোষ্ঠী যেখানে দুই ভাগে ভেঙে গেছে, তাদের ভাষাও আলাদা হয়ে গেছে। কোথাও আবার বেশি জনবসতি হওয়ায় তৈরি হয়েছে বহু গোষ্ঠী, বহু সংস্কৃতি ও বহু ভাষা। আবার কোথাও এমন এলাকা আছে, যেখানে ভাষার বৈচিত্র্য বিজ্ঞানীরা এখনো নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি। ভাষার মানচিত্র পৃথিবীর মানচিত্রের মতো বৈচিত্র্যময়। সব প্রশ্নের সরল উত্তর পাওয়া যায় না।
রোমানি ভাষা ও ভারতীয় ভাষাগুলোর বেশ মিল আছে। রোমানি জনগোষ্ঠী যখন ভারত ছেড়ে পশ্চিমে যাত্রা করেছিল, তখন যাত্রাপথে তারা গ্রিস, তুরস্ক, বলকান, মধ্য ইউরোপ ইত্যাদি ভাষার সংস্পর্শে এসেছে। এভাবে তাদের কিছু শব্দ হারিয়ে গেছে এবং কিছু শব্দ বদলেছে। কিছু শব্দ তারা অন্য ভাষা থেকে ধার করেছে। তবু ‘পানি’, ‘কালা’, এক–দুই–তিন’ ইত্যাদি শব্দ হাজার বছরের ঝড়ঝাপটায়ও টিকে গেছে।
ভাষার মিলের আরেকটি কারণ আছে। পৃথিবীর সব মানুষ একই অঙ্গ দিয়ে কথা বলে, একইভাবে শ্বাস নেয়। একই জিব, দাঁত ও মুখের ভেতরের জায়গা ব্যবহার করে কথা বলে। তাই ভাষার ছন্দ বা ধ্বনি কখনো কখনো একে অপরের কাছাকাছি হয়ে যায়। এ ছাড়া মানুষের মস্তিষ্ক নিজের মাতৃভাষার ছাঁচ ধরে নতুন ভাষা শোনে। ফলে যেসব শব্দ ‘একই রকম’ শোনায়, অনেক সময় সেটা আমাদের নিজের কানে বিভ্রান্তি তৈরি করে।
মানুষ যখন পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, তখন ভাষা মানুষের সঙ্গে যাত্রা করে। শব্দগুলো সময়ের সঙ্গে বদলায়, কিন্তু শিকড়টা কখনো মুছে যায় না। আমরা যখন কোনো দূরদেশের ভাষায় নিজের ভাষার শব্দের মতো কিছু শুনি, তখন আমরা আসলে শুনি ওই ভাষাভাষী মানুষের ঘুরে বেড়ানো, নিজেদের টিকিয়ে রাখা, নতুন জায়গায় নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার গল্প।
সূত্র: ডুয়োলিঙ্গো ও পিবিএস ডটঅর্গ