ভয় জেনেও মানুষ কেন রোলার কোস্টারে ওঠে
রোলার কোস্টারে উঠে আসনে বসেছি। ভালোভাবে সিটবেল্ট বেঁধে নিলাম। পায়ের কাছেও আছে শরীর আটকে রাখার মতো ব্যবস্থা। ধীরে ধীরে ট্রেনটা খটখট শব্দ করে খাড়া ওপরের দিকে উঠছে। বুকের ভেতরটা ভয়ে ধপধপ করছে। হার্টবিট বা হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে অনেকটা। হাত-পা যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি নিচে পড়ে যাই। ঠিক তখনই শোঁ করে নিচে নেমে গেল ট্রেনটি! পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছে। মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে গগনবিদারী চিৎকার।
মাত্র মিনিটখানেকের এই রাইড। অথচ এর জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় মিনিটের পর মিনিট। মাঝেমধ্যে তো হার্ট অ্যাটাক বা দুর্ঘটনার খবরও শোনা যায়। তবু আমরা টাকা খরচ করে রোলার কোস্টারে উঠি। কেন এমনটা করি? এর পেছনে কি কোনো বিজ্ঞান আছে?
আসলে রোলার কোস্টারে চড়লে আমাদের শরীরে ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ রেসপন্স চালু হয়, অর্থাৎ মস্তিষ্ক ভাবে আমরা ভীষণ বিপদে আছি। ১৯৮০ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাইডে চড়ার পর মানুষের হৃৎস্পন্দন মিনিটে ৭০ থেকে বেড়ে ১৫৩ পর্যন্ত হয়ে যায়!
কিন্তু এত ভয়ের পরও আমরা রোলার কোস্টারে চড়তে মজা পাই কেন? কারণ, এর পেছনে আছে ‘ইউস্ট্রেস’। গ্রিক শব্দ ‘ইউ’ মানে ভালো। আমরা যখন জানি রোলার কোস্টারে চড়া নিরাপদ, তখন এই ভয় আমাদের কাছে আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে।
নেদারল্যান্ডসের দুই মনোবিজ্ঞানী একবার হাঁপানি বা অ্যাজমা রোগীদের নিয়ে এক কৌতূহলোদ্দীপক পরীক্ষা করেছিলেন। তাঁরা অ্যাজমায় আক্রান্ত ছাত্রদের জোর করে রোলার কোস্টারে চড়িয়ে দেন। ফলাফলে দেখা যায়, রাইড শেষে তাঁদের শ্বাসকষ্টের অনুভূতি কমে গেছে! অর্থাৎ এ ইতিবাচক চাপ বা ইউস্ট্রেস তাঁদের ভালো বোধ করতে সাহায্য করেছে।
তবে সবার কিন্তু রোলার কোস্টার ভালো লাগে না। কেন? এর জন্য দায়ী ডোপামিন নামের এক হরমোন। গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা রোমাঞ্চপ্রিয়, তাঁদের মস্তিষ্কে ডোপামিনের মাত্রা বেশি থাকে। বাঞ্জি জাম্পিং করা একদল মানুষের ওপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে, লাফ দেওয়ার পর তাঁদের রক্তে এনডরফিনের মাত্রা বেড়ে গেছে। যাঁদের এনডরফিন যত বেশি, তাঁদের আনন্দও তত বেশি।
কিন্তু যাঁদের মস্তিষ্কে ডোপামিনের কাজ কম, তাঁরা এসব রাইডে চড়লে আনন্দ তো পায়ই না, উল্টো অসুস্থ হয়ে পড়েন।
খেয়াল করে দেখবে, তরুণেরা রোলার কোস্টারে চড়ার জন্য পাগল হলেও বয়স্করা সাধারণত এর থেকে দূরে থাকেন। গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের এই থ্রিল বা রোমাঞ্চের আকাঙ্ক্ষা কমতে থাকে। ৫০ বছর বয়সের পর হার্টরেট দ্রুত ওঠানামা করলে শরীরের ক্ষতি হতে পারে। তাই মস্তিষ্ক প্রাকৃতিকভাবেই এসব থেকে দূরে থাকতে সংকেত দেয়।
তবে শেষ করার আগে জানিয়ে দিই, রোলার কোস্টার কিন্তু আধুনিক যুগের আবিষ্কার নয়। এর ইতিহাস বেশ পুরোনো। ১৮০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় পাহাড় থেকে নিচে কয়লা নামানোর জন্য একধরনের রেললাইন ছিল। ছুটির দিনে লোকজন শখ করে ওই কয়লার গাড়িতে চড়ে পাহাড় থেকে নিচে নামতেন। ওটাই ছিল আজকের আধুনিক রোলার কোস্টারের আদি পর্ব।
রোলার কোস্টার হলো গতি ও ভয়কে জয় করার আনন্দ এবং শরীরের অ্যাড্রেনালিন রাশের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। রোলার কোস্টারে চড়ে চিৎকার দেওয়ার মানে, ভয়ের মুখোশ পরে এক দারুণ আনন্দ উপভোগ করা!
সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান