জাপানের স্কুলে শিশুরা কেন ২০ বছর পরের নিজেকে চিঠি লেখে
মানুষ প্রথম চিঠি লেখা শুরু করে খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার (বর্তমান ইরাক অঞ্চল) মানুষের হাত ধরে শুরু হয় বার্তা পাঠানোর এই পদ্ধতি। মানুষ তখন কাদামাটির ফলকে বার্তা লিখে পাঠাত। সেই ফলক শুকিয়ে বা পুড়িয়ে সংরক্ষণ করা হতো, যেন লেখাগুলো টিকে থাকে বছরের পর বছর। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, এগুলো ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম চিঠি।
শুধু মেসোপটেমিয়াতেই নয়, প্রাচীন মিসরে প্যাপিরাস পাতায় চিঠি লেখা হতো। চীনে প্রথমদিকে চিঠি লিখতে ব্যবহার হতো বাঁশের ফালি বা সিল্কের কাপড়। এরপর খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে চীন আবিষ্কার করল কাগজ। সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল চিঠির ইতিহাস। মানুষ বাঁধা পড়ল কাগজের চিঠির অদ্ভুত এক মায়ায়।
প্রতিটি চিঠিতে মানুষের নিজস্ব একটা পরিচয় থাকে। হাতের লেখার ছাপ, নিজস্ব ভাষার আবেগ, সব মিলিয়ে চিঠির কোনো তুলনা হয় না। চিঠির প্রতি মানুষের আগ্রহ আর ব্যাপক চাহিদার কারণে ১৬শ শতাব্দীতে ইউরোপে ডাকব্যবস্থা চালু হয়। ইংল্যান্ডে ১৬৩৫ সালে প্রথমবার সাধারণ মানুষের জন্য রাজকীয় ডাক খোলা হয়। ডাকটিকিটের ব্যবহার শুরু হয় ১৮৪০ সালে ইংল্যান্ডে। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত পেনি ব্ল্যাক, বিশ্বের প্রথম ডাকটিকিট।
এবার আসি বাংলায় কীভাবে চিঠির প্রচলন শুরু হলো। আমাদের অঞ্চলে চিঠির ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। প্রাচীন ভারতবর্ষে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে চিঠি ছিল রাজরাজড়াদের অন্যতম ভরসা। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মৌর্য যুগে সম্রাট অশোকের আমল থেকেই দূত মারফত আদেশ ও বার্তা পৌঁছে দেওয়ার প্রচলন ছিল। সেই সময় ঘোড়সওয়ার দূতরা রাজপ্রাসাদ থেকে রাজ্যে রাজ্যে চিঠি বয়ে নিয়ে যেত।
বেলজিয়ামে একবার ৩৭টি বিড়ালকে ডাকপিয়ন বানানো হয়েছিল, বিড়ালের গলায় ব্যাগ ঝুলিয়ে চিঠি পৌঁছে দিতে হতো আরকি। তবে বিড়াল মাঝপথে ঘুমিয়ে পড়ত।
মধ্যযুগে সুলতানি আমল ও মোগল আমলে চিঠির আরও প্রচলন শুরু হয়। মোগল সম্রাটরা ‘ডাকচৌকি’ নামে বিশেষ ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। প্রতিটি চৌকিতে ঘোড়সওয়ার প্রস্তুত থাকত। একজন দূত এসে খবর দিলে সঙ্গে সঙ্গে অন্যজন নতুন ঘোড়ায় চড়ে তা নিয়ে এগিয়ে যেত। এভাবে দ্রুত দূরত্ব অতিক্রম হতো। তখন এটাকে বলা হতো ‘হাওয়া মহল’।
তবে আসল পরিবর্তন আসে ইংরেজদের হাত ধরে। ১৭৭৪ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় প্রথম সরকারি ডাকঘর স্থাপন করে। তখন থেকে সাধারণ মানুষের চিঠি পাঠানো সহজ হয়ে যায়। পরে বাংলার শহর ও গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে ডাকঘরের শাখা।
১৮৫৪ সালে ভারতীয় ডাকব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আসে। তখন প্রথমবারের মতো ডাকটিকিট চালু হয়। সেই টিকিট লাগিয়ে সাধারণ মানুষ কয়েক পয়সার বিনিময়ে দূরে থাকা আত্মীয়কে চিঠি পাঠাতে পারত। তখন চিঠিই হয়ে ওঠে প্রেম, বন্ধুত্ব, পারিবারিক খবর আর সামাজিক সম্পর্কের সেতুবন্ধ।
সে সময় চিঠির জন্য মানুষের পাগলামি ছিল চরমে। ১৮৬০ সালের দিকে আমেরিকায় অনেক লোক খামে না ভরে সরাসরি নারকেলের খোসায় ঠিকানা লিখে ডাকযোগে পাঠাত। ডাকঘর সত্যিই তা পৌঁছে দিত! খাম ছাড়া চিঠি, তাও মানা যায়। তবে আয়ারল্যান্ডে এক কৃষক আলুর গায়ে ঠিকানা লিখে চিঠি পাঠিয়ে দেন বন্ধুকে। আর ডাকপিয়নও চিঠি ঠিকই পৌঁছে দিয়েছিল।
বেলজিয়ামে একবার ৩৭টি বিড়ালকে ডাকপিয়ন বানানো হয়েছিল, বিড়ালের গলায় ব্যাগ ঝুলিয়ে চিঠি পৌঁছে দিতে হতো আরকি। তবে বিড়াল মাঝপথে ঘুমিয়ে পড়ত।
তবে চিঠি নিয়ে সবচেয়ে মজার ঘটনাটি ফরাসি ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগো ও তাঁর প্রকাশকের। ভিক্টর হুগো তাঁর প্রকাশককে শুধু একটি ‘?’ লিখে চিঠি পাঠান। উত্তরে প্রকাশক পাঠান শুধু ‘!’ (মানে বই বিক্রি হচ্ছে)। এই চিঠিকেই পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ছোট চিঠি হিসেবে ধরা হয়।
চিঠি সময় ও দূরত্বকে কমিয়ে দেয়। ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় সমুদ্র থেকে একটি বোতল উদ্ধার হয়। ভেতরে ছিল ১৩২ বছর পুরোনো জার্মান নাবিকের চিঠি।
চিঠি ছিল প্রেমের অনন্য মাধ্যম, পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা চিঠি লিখেছিলেন একজন ফরাসি, যিনি ১৮৭০ সালে তাঁর প্রেমিকাকে ৭৪৭ মিটার লম্বা এক চিঠি পাঠান! আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার হাজার হাজার কিশোরী অচেনা সৈন্যদের চিঠি লিখত, যাদের অনেকেই পরে বিয়ে পর্যন্ত করে।
চিঠি ধীরে ধীরে সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করে। পুলিৎজার জয়ী বিখ্যাত বই দ্য কালার পারপল (অ্যালিস ওয়াকার, ১৯৮২) আগাগোড়াই একটি চিঠিনির্ভর বই। বিশ্বের দীর্ঘতম চিঠিভিত্তিক উপন্যাসগুলোর একটি ‘ক্লারিসা’ (স্যামুয়েল রিচার্ডসন, ১৭৪৮)।
আবার শিল্পী-সাহিত্যিকদের চিঠিও হয়ে উঠেছে বিখ্যাত বই। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত সব চিঠির সংকলনের নামই ‘ছিন্নপত্র’। আরও আছে ‘লেটারস অব ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ’, ‘লেটারস অব জেন অস্টিন’, ‘সিলেকটেড লেটারস অব এমিলি ডিকেনসন’ অথবা ‘লেটারস অব কাফকা’র মতো বিখ্যাত সব বই
চিঠি সময় ও দূরত্বকে কমিয়ে দেয়। ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় সমুদ্র থেকে একটি বোতল উদ্ধার হয়। ভেতরে ছিল ১৩২ বছর পুরোনো জার্মান নাবিকের চিঠি। আর ১৯৬৯ সালে চাঁদ থেকে নভোচারী নিল আর্মস্ট্রং ‘মুন লেটার’ পাঠান পৃথিবীর জন্য (স্মারক ডাক হিসেবে)।
জাপানে কিন্তু এখনো নিয়ম করে চিঠি লেখা হয়। জাপানে কিছু স্কুলে শিশুরা ২০ বছর পরের নিজেকে চিঠি লেখে। সেই চিঠি লকারে রাখা হয়।
সময়ের সঙ্গে চিঠির প্রতি মানুষের ভালোবাসায় ভাটা পড়েছে। মানুষ এখন বুঁদ হয়ে আছে দ্রুতগতির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এখন এক ক্লিকে মুহূর্তের মধ্যে মেসেজ পাঠানো যায়। দিনের পর দিন চিঠির জন্য অপেক্ষায় আর কে থাকে?
জাপানে কিন্তু এখনো নিয়ম করে চিঠি লেখা হয়। জাপানে কিছু স্কুলে শিশুরা ২০ বছর পরের নিজেকে চিঠি লেখে। সেই চিঠি লকারে রাখা হয়। ২০ বছর পর খোলা হয় এসব চিঠি। প্রতিবছর ২৩ জুলাই লেটার রাইটিং ডে পালন করে জাপান।
তাই চিঠি শুধু বার্তা নয়, চিঠি একধরনের অনুভূতি। হয়তো তাই আজও কেউ চিঠি পেলে যত্ন করে রেখে দেয়। ভবিষ্যতে কখনো আবার খুলে দেখা হয় পুরোনো দিনের স্মৃতিকে।
তাই তুমিও লিখে ফেলতে পারো সুন্দর একটা চিঠি। নিজের জন্য, বন্ধুর জন্য, কিংবা ভবিষ্যতের জন্য।