ভূত শব্দটি এল কোথা থেকে

ভূত হলো কাল্পনিক শক্তি। অর্থাৎ বাস্তবে এটি নেই। তবু মানুষ ভূতের ভয় পায়অলংকরণ: সাফায়েত সাগর

ভূত নিয়ে ভাবতে বসলেই বিপদ। কত রকম ভূত যে রয়েছে! আর ভূতের কত রকম অর্থও যে আছে! মেছো ভূত, গেছো ভূত, জোকা ভূত, বেঘো ভূত, গোভূত, কন্ধকাটা। তারপর ধরো শাঁকচুন্নি, চোরাচুন্নি, পেতনি, ঝেঁয়ো পেতনি, পেঁচাপেঁচি, ব্রহ্মদৈত্য, দেও, আলেয়া, নিশি, ডাকিনী, কানাভুলো, রাক্ষস, খোক্ষস, ডাইনি। খুঁজলে আরও অনেক নাম পাওয়া যাবে। তবে নাম থাক, নাম শুনিয়ে ভয় পাইয়ে দিতে চাই না। বরং ভূত শব্দ আর এর অর্থ নিয়ে ভাবা যাক।

ভূত হলো কাল্পনিক শক্তি। অর্থাৎ বাস্তবে এটি নেই। তবু মানুষ ভূতের ভয় পায়। এটি অশরীরী, মানে এর কোনো শরীর নেই। তবু বইপত্রে ভূতের ছবি আঁকা হয়। অনেকে একে আত্মা মনে করে। এই আত্মা মানুষের শরীরে ভর করতে পারে! আসলে পারে না, কিন্তু কেউ কেউ তা মনে করে।

তাহলে ভূত শব্দের প্রথম অর্থ—কল্পিত অশরীরী আত্মা। কিন্তু ভূত শব্দের আরও অনেক অর্থ আছে। পৃথিবীর সব জীবকেও ভূত বলে। কখনো হয়তো শুনে থাকবে—‘সর্বভূতে দয়া করো।’ এখানে সর্বভূত বলতে সব জীবকে বোঝানো হয়েছে। তার মানে পৃথিবীর সব জীবে দয়া করতে হবে।

আবার ভূত বলতে পাঁচটি মূল উপাদানকেও বোঝানো হয়। এগুলো হলো মাটি, পানি, আগুন, বাতাস আর শক্তি। একসময় মানুষ মনে করত, বিভিন্ন বস্তু এসব উপাদান দিয়ে তৈরি হয়। এদের একসঙ্গে পঞ্চভূত বলা হয়। পঞ্চভূতকে মানুষ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পারে।

আরও পড়ুন
ভূত বলতে পাঁচটি মূল উপাদানকেও বোঝানো হয়। এগুলো হলো মাটি, পানি, আগুন, বাতাস আর শক্তি।
অলংকরণ: সাফায়েত সাগর

ভূত শব্দের আরেক অর্থ অতীত। তখনো বানান একই। তবে উচ্চারণ হবে ভুতো। যেমন বলা যেতে পারে, ‘তিনি আমাদের স্কুলের ভূতপূর্ব শিক্ষক।’ মানে, তিনি আমাদের স্কুলের আগের শিক্ষক। ভূতপূর্ব শব্দের অর্থ—আগে ছিল, এখন নেই। সব রকম ভূতেরই উত্পত্তি ‘ভূ’ ধাতু থেকে। সংস্কৃত ভাষায় ‘ভূ’ ধাতুর অর্থ হওয়া বা থাকা। ভূ ধাতু থেকে ভবিষ্যৎ শব্দটিও তৈরি হয়েছে।

ধাতুর সঙ্গে বিভক্তি যোগ করে ক্রিয়া বানানো হয়। ভূ ধাতু থেকেও ক্রিয়া বানানো যায়। যেমন ছাত্ররা শিক্ষিত হচ্ছে—কথাটি সংস্কৃত ভাষায় ‘ছাত্রাঃ শিক্ষিতঃ ভবতি।’ তবে এত কঠিন করে ভাবার দরকার নেই। কারণ, আমরা কথা বলি বা লিখি শব্দ দিয়ে। কথা বলা বা লেখার জন্য শব্দের ধাতু নিয়ে ভাবতে হয় না।

ভূতের আগে অৎ যোগ করে হয় অদ্ভুত। বিস্ময়কর বা আশ্চর্যজনক বোঝাতে অদ্ভুত শব্দের ব্যবহার আছে। যেমন ‘এমন অদ্ভুত ঘুড়ি আমি আগে দেখিনি।’ আবার আরেকটি শব্দ আছে কিম্ভূত। কী রকম বোঝাতে কিংবা অদ্ভুত অর্থে কিম্ভূত শব্দ ব্যবহার করা হয়। সুকুমার রায়ের তো ‘কিম্ভূত’ নামে একটা ছড়াও আছে: ‘বিদঘুটে জানোয়ার কিমাকার কিম্ভূত,/ সারাদিন ধরে তার শুনি শুধু খুঁৎ খুঁৎ।’

ভূতসংক্রান্ত বিষয়কে বলা হয় ভুতুড়ে। যেমন ভুতুড়ে কাহিনি, ভুতুড়ে কাজ, ভুতুড়ে ঘটনা। তবে এগুলোর সঙ্গে আসলে ভূতের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক রয়েছে বিস্মিত হওয়ার বা অবাক হওয়ার। কখনো কখনো হয়তো এর ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। এ রকম ব্যাখ্যাতীত কাহিনি, কাজ বা ঘটনাকে আমরা ভুতুড়ে বলি। একইভাবে ভুতুড়ে কাণ্ড মানেও আজগুবি ঘটনা।

আবার ভূতের প্রভাবে কারও যদি সাধারণ বোধবুদ্ধি লোপ পায়, তখন তাকে বলে ভূতগ্রস্ত। একই ব্যাপার ভূতাবিষ্ট বা ভূতাবেশ শব্দ দিয়েও বোঝানো হয়। আরেকভাবে বলা যায়, ভূতে পাওয়া বা ভূতে ধরা। যিনি ভূতে ধরা মানুষের ভূত ছাড়ান, তাঁকে বলা হয় ভূতচালা। ভূতচালা মানে ভূতের চালক বা ভূতের ওঝা। তবে আসলে কাউকে ভূতে ধরে না। মানসিক রোগের কারণে মানুষ অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে। এটাকেই না বুঝে অনেকে বলে ভূতে ধরা। ভূতে ধরে না বলে আসলে ভূত ছাড়ানোরও ব্যাপার নেই।

তবে ‘ভূত ছাড়ানো’ বলে একটা বাগ্‌ধারা আছে। কারও চরিত্রে দোষ দেখা দিতে পারে। কিংবা আচরণে অস্বাভাবিক ব্যাপার লক্ষ করা যেতে পারে। তখন রাগ করে তাকে কেউ বলতেই পারে, ‘পিটিয়ে ভূত ছাড়াতে হবে!’ কিন্তু ভূতই যখন নেই, তখন ভূত ছাড়ানো বলতে কী বোঝানো হয়? বোঝানো হয়, অস্বাভাবিক আচরণ ঠিক করে ফেলতে হবে।

আরও পড়ুন

ভূত নিয়ে এ রকম বেশ কিছু বাগ্‌ধারা আছে। ধরা যাক, একজন হয়তো অন্য কারও জন্য অনেক পরিশ্রম করল। কিন্তু এর বিনিময়ে কিছু পেল না। তখন এ রকম অকারণ পরিশ্রমকে বলা হয় ভূতের বেগার খাটা। পরিশ্রম যদি পণ্ড হয় বা কাজে না আসে, তখনো বলা হয় ভূতের বেগার খাটা। মনের দুঃখে তখন মানুষ বলে, ‘ভূতের বেগার খাটলাম!’

আবার অনেক দিন পর কাউকে দেখে চমকে উঠলে বলা হয়—ভূত দেখা। যেমন, ‘বাসায় ঢুকেই স্কুলের স্যারকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম।’ আসলে ভূত কেউ দেখে না। কিন্তু স্যারকে হঠাৎ দেখে ভূত দেখার মতোই চমকে উঠতে হয়।

কারও কারও মাথায় কখনো কখনো দুষ্টবুদ্ধি চাপে। অন্যরা তখন বলে, ‘ওর ঘাড়ে ভূত চেপেছে।’ এটাকে মাথায় ভূত চাপাও বলে। এখানে ভূত বলতে আসলে দুষ্টবুদ্ধি বা খারাপ মতলব বোঝানো হয়। আবার খারাপ লোকের উত্পাত শুরু হলে বলা হয় ভূতের নাচন।

কথায় কথায় আমরা ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ করাও বলে থাকি। বাজে কাজে কেউ টাকাপয়সা খরচ করতে পারে। তখন বলা হয়, ‘ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ করছে!’ ব্যাপারটা এমন, ভূতের বাবা মারা গেছে। এখন তার শ্রাদ্ধের উদ্দেশ্যে টাকা খরচ করা হচ্ছে!

প্রয়োজন ছিল না, এমন গুরুভার বহন করলে বলা হয় ভূতের বোঝা বওয়া। আবার সংসারের বোঝা ঠেলেও কেউ দুঃখ করে বলতে পারে, ‘সারা জীবন ভূতের বোঝা বইলাম!’ এর সঙ্গে ভূতের বেগার খাটা বাগ্‌ধারার মিল আছে।

খারাপ লোক অনেক সময়ে বিপদে পড়ে ভালো কথা বলা শুরু করে। তখন বলা হয় ভূতের মুখে রাম নাম! এখানে ভূত বলতে ওই খারাপ লোকটাকেই বোঝানো হয়।

আরও পড়ুন
অলংকরণ: সাফায়েত সাগর

আসল জিনিসের মধ্যেও ঝামেলা থাকতে পারে। তখন বলা হয় শর্ষের মধ্যে ভূত। কিংবা কোনো ব্যক্তিকে আমরা পরিত্রাণের উপায় ভাবতে পারি। কিন্তু ওই ব্যক্তিই হয়তো ক্ষতির কারণ হলো। তখনো বলা যায় শর্ষের মধ্যে ভূত। একসময় ওঝারা ভূত ঝাড়ার জন্য শর্ষে ব্যবহার করত। কিন্তু সেই শর্ষের মধ্যেই যদি ভূত লুকিয়ে থাকে, তবে তা দিয়ে আর ভূত ছাড়াবে কীভাবে!

শুরুতে অনেক রকম ভূতের নাম দিয়ে শুরু করেছিলাম। শেষে আরেকটা ভূতের নাম দিয়ে শেষ করি। এই ভূতটাও অন্য সব ভূতের মতো বাস্তবে দেখা যায় না। এটাকে বলে ছাপাখানার ভূত। যখন কোনো বানান ভুল হয়, তখন দায় এড়ানোর জন্য ছাপাখানার ভূতের ওপর দোষ চাপানো হয়। আসলে মানুষের অসতর্কতার দরুন ছাপার ভুল হয়। একটু সতর্ক থাকলে এসব ভুল এড়ানো যায়। এ সুযোগে আসো ‘ভূত’ শব্দের বানান শিখিয়ে দিই।

শুধু ‘অদ্ভুত’ লিখতে হ্রস্ব উ-কার হয়। ভূত দিয়ে আর যত শব্দ আছে, সব শব্দেই দীর্ঘ ঊ-কার হয়। যেমন: কিম্ভূত, ভূতপূর্ব, অভূতপূর্ব, অঙ্গীভূত, অভিভূত, আবির্ভূত, উদ্ভূত, একীভূত, ঘনীভূত, দ্রবীভূত, পরাভূত, প্রভূত, বশীভূত ইত্যাদি। তবে একটু সাবধান! অদ্ভুত, কিম্ভূত আর ভুতুড়ে বাদে এখানকার অন্য শব্দগুলোর শেষে কিন্তু উচ্চারণ হবে ‘ভুতো’।

আরও পড়ুন