ভৌতিক গল্প 'নিঝুমপুরের হানাবাড়ি'
মফস্সল শহর নিঝুমপুরের সীমানা ছাড়িয়ে যেখান থেকে জঙ্গল শুরু হয়েছে, ঠিক সেখানেই জবুথবু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ বাড়িটা। পুরোনো আমলের ছোট ছোট ইট দিয়ে তৈরি প্রাচীন বাড়িটায় বহু বছর আগে সাদা রং করা হয়েছিল, এখন সেই রং ধুয়েমুছে গেছে, খসে পড়েছে পলেস্তারা। জায়গায় জায়গায় লাল ইট বেরিয়ে পড়েছে—দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন ছোপ ছোপ রক্ত লেগে আছে। জানালার কপাটগুলো ভাঙা, কয়েকটা তো খুলে পড়েই গেছে। সামনের বারান্দার কাঠের বিমগুলো হেলে পড়েছে—অবস্থা এমন যে একটু জোরে বাতাস বইলেই মনে হয় পুরো বারান্দাটাই ভেঙে পড়ে যাবে। ওপরের তলার জানালা দুটো যেন কালো, নির্ঘুম এক জোড়া চোখ—নিষ্পলক তাকিয়ে আছে নিঝুমপুর শহরের দিকে। বেশ কিছু মরা গাছ ঘিরে আছে বাড়িটাকে। গাছগুলো সব বাঁকা আর মোচড়ানো।
বাড়িটার খুব কাছে যেতে সাহস করে না কেউ। যারা খুব বেশি সাহসী, তারা বড়জোর অদূরের পাকা রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে বাড়িটার দিকে। বহু বছর হয়ে গেছে কেউ থাকে না বাড়িটাতে। এমনকি চোরছ্যাঁচড় পর্যন্ত গা ঢাকা দেওয়ার জন্য যায় না সেখানে। বহু বছর ধরে খালি পড়ে থাকতে থাকতে বাড়িটা এখন পরিণত হয়েছে হানাবাড়িতে।
জোর গুজব আছে, বাড়িটা নাকি ভুতুড়ে। শহরের সবাই বলে, অশুভ কিছু একটা বাস করে সেখানে। যদি কেউ সাহস করে সেখানে রাত কাটাতে যায়, তবে আর কখনো ফিরে আসে না সে। বেমালুম গায়েব হয়ে যায়! আগে নাকি বেশ কয়েকবার ঘটেছে এমন ঘটনা।
আর এসব কুখ্যাতির কারণেই হানাবাড়িটা ওদের তিন বন্ধুর এতটা পছন্দ। ফজলু, শামীম আর সাজ্জাদ—তিনজনই নিঝুমপুর হাইস্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে। স্কুলে যদি ‘শয়তানি’ নামে কোনো সাবজেক্ট থাকত, তাহলে প্রতিবছর ওরা তিনজন যথাক্রমে ফার্স্ট, সেকেন্ড ও থার্ড হতো। স্কুলের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষকেরা পর্যন্ত ওদের তিনজনের যন্ত্রণায় রীতিমতো অতিষ্ঠ। তিন বন্ধু মিলে একটা ক্লাব তৈরি করেছে, গালভরা একটা নামও দিয়েছে সেটার—‘ডেঞ্জার ক্লাব’। এই ক্লাবের মূল উদ্দেশ্য হলো নিরীহ টাইপের ছেলেপেলেদের ধরে ধরে নানান কায়দায় ভয় দেখানো।
এই মুহূর্তে ডেঞ্জার ক্লাবের তিন সদস্য দাঁড়িয়ে আছে শহরের শেষ প্রান্তের নির্জন রাস্তাটার ধারে, তাকিয়ে আছে হানাবাড়িটার দিকে। একটু আগেই সন্ধ্যা নেমেছে। ফ্যাকাশে চাঁদের আলোয় হানাবাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অজান্তেই ফজলুর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
‘মিশু ভেতরে গেছে কতক্ষণ হলো?’ পাশে দাঁড়ানো দুই সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করল সে।
‘মাত্র দশ মিনিট,’ উত্তর দিল শামীম।
‘আরও পঞ্চাশ মিনিট বাকি,’ এবার কথা বলে উঠল দলের তৃতীয় সদস্য সাজ্জাদ। ‘কী মনে হয়, পারবে ও?’
‘মিশুর সাহস আছে,’ ফুর্তিমাখা কণ্ঠে বলল ফজলু।
‘বড়জোর আর পাঁচ মিনিট! তারপরই লেজ তুলে দৌড়ে বের হয়ে আসবে,’ বলল শামীম। দৃশ্যটা কল্পনা করে হেসে ফেলল সে।
ওর কথা শুনে খিকখিক করে হেসে উঠল সাজ্জাদ আর ফজলু।
মিশু ওদের চেয়ে এক ক্লাস নিচে পড়ে। আজ সন্ধ্যায় কোচিং থেকে ফেরার পথে ছেলেটাকে পাকড়াও করেছে ওরা। তারপর ওর ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে বলেছে, ব্যাগ ফেরত চাইলে ওই বাড়ির ভেতরে এক ঘণ্টা থাকতে হবে। কাকুতি-মিনতি করে কাজ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছে মিশু। তারপর দশ মিনিট কেটে গেছে।
হঠাৎ চিৎকারটা শুনতে পেল ওরা। কণ্ঠটা ওদের পরিচিত। তীব্র আতঙ্কে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে মিশু! পরমুহূর্তেই ঝট করে বাড়িটার সদর দরজাটা খুলে গেল, সেখান দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এল কিশোর বয়সী একটা ছেলে। হোঁচট খেতে খেতে ভাঙা বারান্দাটা থেকে নিচে নামল সে, তারপর মরা গাছগুলোর ভেতর দিয়ে তিরবেগে ছুট লাগাল। হাত দুটো হাওয়ায় ভাসিয়ে পাগলের মতো ছুটছে, যেন খোদ কাউন্ট ড্রাকুলা তাড়া করেছে ওকে। মাথাটা হেলে আছে পেছন দিকে, মুখ থেকে একটানা চিৎকারে বের হয়ে আসছে, চোখ দুটো মনে হচ্ছে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে।
‘মিশু—কী দেখেছিস ভেতরে?’ কাছে আসতেই চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল সাজ্জাদ।
‘ক-কেউ আমার মুখ ছুঁয়েছিল!’ দৌড়াতে দৌড়াতেই আতঙ্কিত কণ্ঠে চিৎকার করে বলল মিশু।
পরমুহূর্তেই ওদেরকে পাশ কাটিয়ে ছুটে চলে গেল রাস্তার ওপাশে।
‘মনে হয় মাকড়সার জাল লেগেছিল ওর মুখে,’ নিচু কণ্ঠে বলল সাজ্জাদ।
‘ওকে থামাতে হবে!’ চেঁচিয়ে উঠল ফজলু। এতক্ষণে যেন হুঁশ ফিরে এসেছে ওর।
‘মিশু! এই—মিশু!’ ওর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে পেছন পেছন ছুটতে শুরু করল সবাই। কিন্তু ইতিমধ্যে অনেক দূরে চলে গেছে ছেলেটা, কয়েক সেকেন্ড পরেই মোড়ের ওপাশে হারিয়ে গেল।
‘ও বাসায় গিয়ে বলে দেবে সবকিছু!’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল শামীম।
হাঁটুতে হাত রেখে ঝুঁকে পড়ল ফজলু, হাঁসফাঁস করতে করতে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।
‘এখন কী করব আমরা?’ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল সাজ্জাদ।
‘কী আর করব!’ খিকখিক করে হাসতে হাসতে বলল ফজলু। ‘কাল স্কুলে এলে ব্যাগ ফেরত দিয়ে দেব। কেউ কিছু বললে বলব, রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি। ওর সঙ্গে আমাদের দেখাই হয়নি! তবে আজকে যা মজা হলো না! আবার করতে হবে কাজটা!’ বলে গলা ফাটিয়ে হাসতে লাগল সে।
একমুহূর্ত পর বাকি দুজনও যোগ দিল হাসিতে।
তারপর শহরের দিকে হাঁটতে শুরু করল ওরা। ফেরার পথে হানাবাড়িতে পাঠানোর জন্য নতুন ‘শিকার’ নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিল। তিনজনই ওরা একমত হলো, ক্লাসের নতুন ছাত্র অনিক খুব ভালো শিকার হতে পারে।
*
পরদিন। স্কুল শেষে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছে অনিক। শীতের শেষ দিক। চারপাশে গাছ থেকে লাল আর হলুদ পাতাগুলো ঝরে পড়ছে। রাস্তা পার হতে যাবে, এমন সময় দেখতে পেল, সাজ্জাদ ছুটে আসছে ওর দিকে। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে অনিককে ওদের ডেঞ্জার ক্লাব সম্পর্কে বলতে শুরু করল সে।
‘আমাদের ক্লাবটা কিন্তু শুধু সাহসী ছেলেদের জন্য,’ ব্যাখ্যা করল সে। ‘ক্লাবে যোগ দেওয়ার জন্য সাহসের প্রমাণ দিতে হবে। সে জন্য রাতের বেলা শহরের শেষ মাথার ওই হানাবাড়িটার ভেতরে এক ঘণ্টা কাটাতে হবে।’
কথাটা শুনেই হাঁটা থামিয়ে সন্দিহান দৃষ্টিতে সাজ্জাদের দিকে তাকাল অনিক।
‘ওই বাড়িটায় নাকি সত্যি সত্যি ভূত আছে?’
‘আরে ধুর!’ হাসতে হাসতে বলল সাজ্জাদ, ‘এসব গাঁজাখুরি গপ্পো বিশ্বাস করো তুমি?’
‘দেখো, আমার আসলে অত সাহস নেই।’ শান্ত কণ্ঠে বলল অনিক। কথাটা বলেই আবার হাঁটতে শুরু করল সে, এবার দ্রুত পায়ে। তাড়াহুড়া করে ওর পিছু নিল সাজ্জাদ।
‘দেখো, আমরা সত্যিই চাই তুমি আমাদের ক্লাবে যোগ দাও,’ বলল সাজ্জাদ। ‘একটা খালি বাড়িতে মাত্র এক ঘণ্টা থাকতে হবে। পারবে না? খুবই সোজা কাজ!’
কাঁধ ঝাঁকাল অনিক।
‘ম-মনে হয় পারব না,’ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল সে।
ঠিক সেই মুহূর্তে শামীম আর ফজলু দৌড়ে এসে যোগ দিল ওদের সঙ্গে।
‘তা কী ঠিক করলে?’ জিজ্ঞেস করল ফজলু, ‘যোগ দেবে আমাদের ডেঞ্জার ক্লাবে?’
‘না! আমি ভেতরে যেতে চাই না,’ নিচু কণ্ঠে কথাটা বলেই এক দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করল সে। তারপর মোড় ঘুরে চোখের আড়াল হয়ে গেল।
‘তোমরা সবাই ঢুকেছিলে ওই বাড়িটায়? ছিলে এক ঘণ্টা?’ উত্তর না দিয়ে দুই হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে পাল্টা প্রশ্ন করল অনিক।
‘আমাদের ঢোকার দরকার নেই,’ বলল ফজলু। ‘আমরাই তো ক্লাবটা শুরু করেছি। আমরা জানি, আমাদের সাহস আছে। কিন্তু নতুন সদস্যদের সেটা প্রমাণ করতে হবে।’
চিন্তিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল অনিক।
হাঁটতে হাঁটতে একটা মোড় ঘুরল চার কিশোরের দলটা। এখান থেকে হানাবাড়িটা দেখা যায়।
‘দেখেছ, দিনের বেলা দেখে তো একদমই ভয় লাগে না,’ বলল সাজ্জাদ।
বাড়িটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল অনিক, হাত দুটো এখনো প্যান্টের পকেটে গোঁজা। একটু একটু কাঁপছে ও। ভয়ে নাকি শীতে, কে জানে!
‘তো, তোমরা কেউ আমার সঙ্গে ভেতরে যাবে?’ অবশেষে বলল সে।
‘না। আমরা কেউ তোমার সঙ্গে ভেতরে যাব না,’ ফজলু বলল। ‘তবে আমরা বাইরে তোমার জন্য অপেক্ষা করব।’
‘রাজি হয়ে যাও,’ উৎসাহ দিল সাজ্জাদ। ‘অনেক মজা হবে! স্কুলে তোমার নাম ফাটবে!’
কয়েকবার ঢোঁক গিলল অনিক, বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল, যেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করছে। তারপর মাথা নাড়ল।
‘না! আমি ভেতরে যেতে চাই না,’ নিচু কণ্ঠে কথাটা বলেই এক দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করল সে। তারপর মোড় ঘুরে চোখের আড়াল হয়ে গেল।
‘ছেলেটা একেবারেই ভিতু,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল সাজ্জাদ। ‘এতটা ভিতু না হলে ভুজুংভাজুং দিয়ে রাজি করানো যেত।’
‘শোন, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।’ থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল ফজলু।
‘কী বুদ্ধি?’ উৎসাহী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল শামীম। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সাজ্জাদ।
‘সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে, আঙুল বাঁকা করাই নিয়ম। অনিক যদি ভালোয় ভালোয় রাজি না হয়, তাহলে ওকে আমরা জোর করে বাড়িটার ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে পারি।’
তারপর পরিকল্পনাটা খুলে বলল সে।
*
পরদিন সন্ধ্যায় কোচিং থেকে বাসায় ফিরে অনিক দেখতে পেল, ওর পোষা বিড়ালটাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিড়াল খুঁজতে বের হয়ে রাস্তায় সাজ্জাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ওর। সে জানাল, বিড়ালটাকে হানাবাড়িটার আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে ওরা। সঙ্গে সঙ্গে সাজ্জাদের সঙ্গে হানাবাড়ির সামনের রাস্তাটায় চলে এল সে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল ফজলু আর শামীম। অনিক আসতেই ওরা বলল, একটু আগেই বাড়ির বারান্দার দিকে যেতে দেখেছে বিড়ালটাকে। দেরি না করে সেদিকে এগোতে শুরু করল ওরা।
আকাশে এক ফালি চাঁদ উঠেছে। উত্তরের পাহাড় থেকে বয়ে আসা হিমেল বাতাসে বারবার কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল ওরা। হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে সেই ভয়ংকর বাড়িটার সামনে চলে এল ওরা। বাড়িটার সামনে আসতেই হুট করেই অনিকের মনে হলো, বিড়াল-টিরাল আসলে মিথ্যা কথা, ওদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল সে, দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু তৈরি হয়েই ছিল ফজলু আর শামীম। চোখের পলকে দুপাশ থেকে ওর দুই হাত চেপে ধরল ওরা।
‘এই—ছাড়ো! কী করছ?’ চমকে উঠে চিৎকার করল অনিক। হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল।
কিন্তু দুজনই ওরা গায়েগতরে অনিকের চেয়ে বড় আর শক্তিশালী। কাজেই প্রতিরোধের চেষ্টা করে বিশেষ সুবিধা করতে পারল না। ওকে দুপাশ থেকে ধরে অনায়াসে টেনে নিয়ে চলল ওরা। ওদের সামনে সামনে হাঁটছে সাজ্জাদ। টেনেহিঁচড়ে ওকে বারান্দায় তুলল ওরা, তারপর সোজা চলে এল সদর দরজার সামনে।
‘না! ছাড়ো আমাকে! প্লিজ!’ এবার কাকুতি-মিনতি শুরু করল অনিক।
‘ভয়ের কিছু নেই, অনিক। কিছুই হবে না তোমার, ভূত বলতে কিছু নেই,’ শান্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলল ফজলু। ‘ভেতরে যাও। মাত্র এক ঘণ্টা। আমরা বাইরে তোমার জন্য অপেক্ষা করব।’
ধাক্কা দিয়ে ভারী দরজাটা খুলে ফেলল সাজ্জাদ।
ফজলু আর শামীম ওর হাত দুটো ছেড়ে দিয়ে ভেতরের দিকে ঠেলে দিল ওকে। শেষ মুহূর্তে খপ করে সাজ্জাদের হাতটা ধরে ফেলল অনিক।
‘প্লিজ! ভীষণ ভয় লাগছে আমার! একদম পারব না!’
শীতল বাতাসের বেগ আরও বেড়েছে, কুয়াশার দল যেন কুণ্ডলী পাকিয়ে ওদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়িটার সামনে চলে এল ওরা, কাঁপতে কাঁপতে বারান্দায় উঠল। দরজাটা খোলার চেষ্টা করল সাজ্জাদ, কিন্তু আঙুলের নিচ থেকে পিছলে গেল দরজার হাতলটা। সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল ফজলু। দুজনে মিলে ভারী দরজাটা ঠেলে খুলে ফেলল।
‘তোমাকেই তোমার সাহসের প্রমাণ দিতে হবে, অনিক,’ আবেগহীন কণ্ঠে বলল ফজলু, ‘এক ঘণ্টা পর দেখা হবে। বিদায়!’
পরমুহূর্তেই জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে ওকে বাড়ির ভেতরে ঠেলে দিল সে। সঙ্গে সঙ্গেই ভারী দরজাটা টান মেরে বন্ধ করে দিল।
কাজ শেষে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াল ওরা।
দশ মিনিট, বিশ মিনিট করে আধঘণ্টা চলে গেল।
‘দারুণ খেল দেখাচ্ছে অনিক!’ বাড়ির অন্ধকার জানালার দিকে চোখ রেখে ফুর্তিমাখা কণ্ঠে বলল ফজলু।
‘আমি তো ভেবেছিলাম দুই মিনিটও টিকবে না।’ বলল শামীম।
পরস্পরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। চাঁদটা মেঘের আড়ালে চলে যাওয়ায় চারদিকে গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে। আরও বিশ মিনিট কেটে গেল।
‘পুরো এক ঘণ্টাই কাটিয়ে দেবে ও।’ ঘড়ি দেখে নিয়ে বলল শামীম।
অবশেষে এক ঘণ্টা পূর্ণ হলো।
কিন্তু সবকিছু যেমন ছিল, তেমনই রইল। আগের মতোই অন্ধকার ও নিশ্চুপ হয়ে রইল বাড়িটা।
আরও দশ মিনিট কেটে গেল।
‘কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে,’ অবশেষে বিড়বিড় করে বলল ফজলু।
‘অনিকের এতক্ষণে বেরিয়ে আসার কথা,’ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল শামীম।
ওদের সবার পিঠ বেয়ে ঠান্ডা একটা শিরশিরে শিহরণ বয়ে গেল। সবাই বুঝতে পারছে, বাড়িটার ভেতরে খারাপ কিছু একটা ঘটেছে। খুব খারাপ কিছু।
‘অনিক যে তোর সঙ্গে এসেছে, কেউ দেখেছে?’ ফিসফিস করে সাজ্জাদকে জিজ্ঞেস করল ফজলু।
‘অনেকেই দেখেছে,’ জবাব দিল সাজ্জাদ। ‘ওর কিছু হলে কপালে খারাবি আছে আমাদের।’
‘ভেতরে যেতে হবে আমাদের,’ জোর দিয়ে বলল শামীম। ‘অনিককে খুঁজে বের করতে হবে।’
ভীত চোখে পরস্পরের দিকে তাকাল তিন কিশোর।
অন্ধকার ওই বাড়িটার ভেতরে ঢোকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই কারোরই।
‘আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখি,’ কাঁপতে থাকা পা দুটোকে স্থির করার চেষ্টা করতে করতে বলল সাজ্জাদ। ‘ওর হাতে ঘড়ি নেই। হয়তো টেরই পায়নি এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে!’
‘চল,’ আচমকা ফজলুর হাত টেনে ধরে বলল শামীম। ‘আর দেরি করা ঠিক হবে না। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।’
শীতল বাতাসের বেগ আরও বেড়েছে, কুয়াশার দল যেন কুণ্ডলী পাকিয়ে ওদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়িটার সামনে চলে এল ওরা, কাঁপতে কাঁপতে বারান্দায় উঠল। দরজাটা খোলার চেষ্টা করল সাজ্জাদ, কিন্তু আঙুলের নিচ থেকে পিছলে গেল দরজার হাতলটা। সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল ফজলু। দুজনে মিলে ভারী দরজাটা ঠেলে খুলে ফেলল।
জংধরা কবজায় ঘর্ঘর শব্দ তুলে খুলে গেল দরজা। ভেতরে কবরের মতো ঘুটঘুটে অন্ধকার।
‘অনিক?’ ভয় পাওয়া কণ্ঠে ডাকল সাজ্জাদ। ‘অনিক! কোথায় তুমি?’
নিকষ অন্ধকারে ওর গলাটা ক্ষীণ আর ফাঁপা শোনাল।
কিন্তু কোনো উত্তর এল না।
‘অনিক? অনিক?’ এবার তিনজনই ডাকতে শুরু করল।
সাহস সঞ্চয় করে পরস্পরের হাত ধরে ঘরের ভেতর পা রাখল ওরা। এক কি দুই কদম এগিয়ে যেতেই পায়ের নিচের মেঝে থেকে বিশ্রী কড়কড় শব্দ হতে লাগল। দমকা হাওয়া এসে ঝাঁকুনি দিতে লাগল জানালার পুরোনো কাচগুলোকে।
‘অনিক, শুনতে পাচ্ছ? অনিক?’
কোনো উত্তর নেই।
হঠাৎ কানে তালা লেগে যাওয়ার মতো বিকট একটা শব্দ হলো। তীব্র আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল ওরা।
ওদের পেছনে সদর দরজাটা ঝট করে বন্ধ হয়ে গেছে!
‘ব-বাতাসে হয়েছে,’ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল ফজলু।
দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চারপাশ আরও গভীর অন্ধকারে ঢেকে গেল।
তবে সেই অন্ধকার বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।
সিঁড়ির ওপরে জ্বলে উঠল ফ্যাকাশে একধরনের আলো।
দেখে মনে হচ্ছে যেন অসংখ্য জোনাকি জড়ো হয়েছে সেখানে।
হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে রইল তিন বন্ধু। ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল আলোটা।
তারপর ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল ওটা—যেন শূন্যে ভেসে এগিয়ে আসছে এক খণ্ড ঝিকিমিকি মেঘ।
সবার আগে সংবিৎ ফিরে পেল ফজলু।
‘বের হতে হবে এখান থেকে! এখনই,’ চিৎকার করে উঠল সে।
তবে এরই মধ্যে দেরি হয়ে গেছে। ওদের পা যেন কেউ আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে মেঝের সঙ্গে। চেষ্টা করেও টেনে তুলতে পারছে না।
ঝিকিমিকি মেঘের মতো সেই জিনিসটা ছড়িয়ে পড়ল ওদের চারপাশে। সেই মেঘের ভেতরে মানুষের মতো দুটো অবয়ব দেখতে পেল ওরা। অর্ধস্বচ্ছ, কুয়াশার মতো দুটো মানব অবয়ব। একটা পুরুষ আর একটা নারী। আগুনে পোড়া গনগনে কয়লার মতো লাল চোখ ওদের। সেই চোখগুলো একধরনের নির্মম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। নিঃশব্দে ভেসে বেড়াচ্ছে ওরা দুজন, ধীরে ধীরে চক্কর কাটছে ওদের ঘিরে।
আর কিছু বোঝার বাকি রইল না ওদের। এই বাড়ি সম্পর্কে যা যা শুনেছে, তার কোনোটাই গুজব নয়। সবই নির্মম বাস্তব! এই বাড়িটা সত্যিই অশুভ!
‘অনিক? অনিক ক-কোথায়,’ কথা বলার চেষ্টা করল ফজলু। গলা দিয়ে কোনোমতে চিঁচিঁ আওয়াজ বের হলো।
‘তোমাদের বন্ধুর কথা বলছ?’ কথা বলে উঠল পুরুষ পিশাচটা। শুকনা পাতার ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের মতো রুক্ষ আর ফ্যাসফেসে কণ্ঠ। ‘ও তো সেই কখন বের হয়ে গেছে। পেছনের দরজা দিয়ে।’
‘আমরা ওকে যেতে দিতে চাইনি,’ এবার কথা বলে উঠল মহিলা পিশাচ। কবর থেকে উঠে আসা লাশের মতো খ্যানখ্যানে কণ্ঠ তার।
‘আমরা ওকে যেতে দিতে চাইনি,’ আবার বলল সে। ‘কিন্তু আমাদের সঙ্গে একটা চুক্তি করেছিল ও।’
‘কী চুক্তি?’ প্রশ্নটা আপনা–আপনি বের হয়ে গেল ফজলুর মুখ থেকে।
খলখল করে হেসে উঠল পিশাচটা, তারপর বলল, ‘ও আমাদের কথা দিয়েছিল, যদি আমরা ওকে ছেড়ে দিই, তাহলে তিনটা ছেলে আসবে ওর জায়গা নিতে।’
‘আর তোমরা এসে গেছ!’ আবার কথা বললে উঠল পুরুষ পিশাচটা। দাঁতবিহীন বিকৃত মুখটায় ছড়িয়ে পড়ল বীভৎস হাসি। ‘হ্যাঁ! তোমরা এসে গেছ।’
‘ভয় পেয়ো না, খোকারা,’ শূন্যে ভেসে ওদের আরও কাছে চলে এল মহিলা, খ্যানখ্যানে কণ্ঠে বলল, ‘বরং নিজেদের এখানে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো। কারণ, এখন থেকে তোমরা এখানেই থাকবে—চিরকাল!’
(আর এল স্টাইনের দ্য হাউস অব নো রিটার্ন–এর ছায়া অবলম্বনে)