ভূত পেলাম কোথা থেকে

‘ভূত’ শব্দটা শুনলেই কেমন যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে অশরীরী ব্যাপারস্যাপার। আজকের দিনে কম্পিউটার, রোবট আর ইন্টারনেটের যুগে ভূতের আবার জায়গা কোথায়? কিন্তু বিশ্বাস করো, ভূতেরা আজও আছে, হয়তো তাদের চোখে দেখা যায় না, তারা থাকে আমাদের কল্পনায়, গল্পে আর সবচেয়ে বেশি বাসা বাঁধে মনের গহিনে।

অলংকরণ: সাফায়েত সাগর

ভূতেরা আসে কোথা থেকে

ভূত মানে কী? ভূত মানে নাকি এক অদ্ভুত আত্মা, মারা যাওয়ার পরও যে থেকে যায় পৃথিবীতে! কেউ বলে, তাদের বসবাস গাছের মগডালে; আবার কারও ধারণা, তারা লুকিয়ে থাকে পুরোনো, নির্জন সব বাড়িঘরে। আসলে কি জানো? ভূতের জন্ম আমাদের ভয় থেকে। যখন আমরা ছোট ছিলাম, তখন দাদি-নানি কিংবা মা আমাদের শোনাতেন ভূতের গল্প। গা ছমছমে সেসব গল্প শুনে ভয়ও পেতাম, আবার মজাও লাগত! ধীরে ধীরে আমাদের মনের ভেতরে গড়ে উঠেছিল ভূতের জন্য আলাদা এক রাজ্য। তবে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের কথাও শোনা যাক—ভূত আসলে মানসিক ভয়, অজানার প্রতি আতঙ্ক কিংবা সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারের ফসল। শৈশব থেকেই দাদি-নানির মুখে শোনা ভূতের গল্প আমাদের অবচেতনে গেঁথে যায়, যা পরবর্তী সময়ে অন্ধকারে বা একাকিত্বে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি বলব, ভয় পাওয়ার আর ভয় পাওয়ানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্ম দিয়েছে ভূতের জগৎ।

ভূতের গল্প মানেই মজার সব গল্প!

প্রাচীন যুগের মানুষদের মনে ভূতেরা রাজত্ব করেছে প্রবল প্রতাপে। সে সময় তাদের কাছে যেসব বস্তু যুক্তির বাইরে ছিল, সেই সব বস্তু বা বিষয় ছিল ভূত বা অশরীরীদের কাণ্ডকারখানা। কিন্তু বিজ্ঞানের কাছে ভূতদের পরাস্ত হতে হয়েছে। ভূত মন থেকে পালালেও ভূতের আগ্রাসন ঘটেছে সাহিত্যের মাধ্যমে। বিশ্বসাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যেও ভূতের গল্প অনেক আগেই ঢুকে পড়েছে। সেই প্রায় দেড় শ বছর আগে থেকেই ভূতের গল্প লিখছেন লেখকেরা। এই যেমন ধরো—লালবিহারী দে, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের মতো বিখ্যাত সব লেখকের নাম বলতে পারি। তাঁরা লিখেছিলেন এমন সব গল্প, যেগুলো পড়ে আমরা এখনো মজা আর ভয় পাই। তোমরা নিশ্চয়ই ঠাকুরমার ঝুলির নাম শুনেছ। সেখানেই তো আছে ভূত, পেতনি, ডাইনি আর কত রকমের ভূতের হট্টগোল! কিছু গল্প ভয় পাওয়ার জন্য, কিছু গল্প হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো।

আরও পড়ুন
আধুনিক ভূতের গল্পের চেনাজানা জগৎ একটু অন্য রকম। এখানে ভৌতিক রসের উপস্থিতিটাই হলো মূল শর্ত। পরিচিত অনুভবগুলোকে ছাপিয়ে বুক দুরু দুরু বা গা–ছমছম অন্য অনুভূতি আমাদের চারপাশে মনকে ভীত করে।

আগেই যেমনটা বলছিলাম—আধুনিক সাহিত্যজগতের ভূত তৈরি হলো আমাদের কল্পনাশক্তি দিয়ে। প্রবীর মুখোপাধ্যায় এ বিষয়ে ঠিকঠাক বলেছেন, ‘বীভত্স রসশিহরণ উপভোগ করা এবং অন্যকে ভয় দেখানো কিংবা অবিশ্বাসকে বিশ্বাস্য করে তোলা সাহিত্যের বহুকালের উপজীব্য বিষয়।’ বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের জগতে ভূতের গল্পের জন্ম উনিশ শতকের শুরুতে। সে সময় কিছু বই বের হয়েছিল। সেসবের নাম জেনে রাখতে পারো—লালবিহারী দে সংকলিত ইংরেজি বই ফোক টেলস অব বেঙ্গল (১৮৮৩), আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের রাক্ষস-খোক্ষস (১৩০০ বঙ্গাব্দ) ও ভূত-পেত্নী (১৩০২ বঙ্গাব্দ), যোগীন্দ্রনাথ সরকারের হবি ও গল্প (১৮৯৬) এবং দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি (১৯০৭), ঠাকুর দাদার ঝুলি (১৯০৯), দাদামশায়ের থলে (১৯১৩) প্রভৃতি। এই বইগুলোর বেশির ভাগ উপকথা আর রূপকথা। অবশ্য যোগীন্দ্রনাথ সরকার ও দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের নামটা একটু আলাদাভাবে বলতে হবে। কেননা, বাস্তবতা এবং গ্রামীণ লোকগাথাকে নিজেদের মতো করে গল্পে তুলে আনতে পেরেছিলেন তাঁরা।

ভূতের গল্পে পরিবেশটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ

ভূতের গল্প মানেই শুধু ভয় নয়, অনেক সময় গল্পে মজার সব চরিত্রও থাকে; কিন্তু ভূতের গল্পে একটা জিনিস খুব দরকার; আর তা হলো ভয় পাওয়ার পরিবেশ! যেমন ধরো, রাতের আঁধার, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, বাতাসে জানালার শব্দ, একলা ঘর, হঠাৎ বিদ্যুৎ চমক—এসব থাকলেই গল্পগুলো দারুণ জমে যায়! আর ভূতের গল্পের শেষে যদি রয়ে যায় একটুখানি ‘কি সত্যি নাকি?’ তাহলে তো আর কথাই নেই! চলো, তোমাদের একটু না হয় ব্যাখ্যা করেই বিষয়টা বোঝাই।

আধুনিক ভূতের গল্পের চেনাজানা জগৎ একটু অন্য রকম। এখানে ভৌতিক রসের উপস্থিতিটাই হলো মূল শর্ত। পরিচিত অনুভবগুলোকে ছাপিয়ে বুক দুরু দুরু বা গা–ছমছম অন্য অনুভূতি আমাদের চারপাশে মনকে ভীত করে। ভৌতিক গল্পের অভিজ্ঞতাটাই অতীতের। ‘ভূত’ শব্দের আরেকটি অর্থ হচ্ছে, যা সংঘটিত, বিগত। ভূতের গল্পের শুরু যদিও হয় বর্তমানে; তবুও গল্পে কেমন করে যেন অতীত এসে জুড়ে বসে। আর এখানেই আসছে পরিবেশের কথা। আর এই ফাঁকে তোমরা যারা ভূতের গল্প লিখতে চাও, তাদের জন্য রইল কয়েকটি টিপস—গল্পের এই পরিবেশ তৈরিতে লেখককে সচেতন থাকতে হয়। কথককে ধীরে ধীরে তৈরি করতে হয় পরিবেশ। আধুনিক শিক্ষিত পাঠকের মন অবিশ্বাসী, তাকে ভৌতিক অস্তিত্বে বিশ্বাস করাতে হয়। এমনভাবে পরিবেশ তৈরি করতে হয়, যেখানে কথক আর শ্রোতা, লেখক আর পাঠক হয়ে উঠবেন একা। গল্পের ভৌতিক রস জমিয়ে তুলতে পরিবেশ তৈরি করা সবচেয়ে জরুরি। রাতের অন্ধকার, বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, দমকা বাতাসে জানালার শার্সিতে অদ্ভুত শব্দ, বিদ্যুতের চমক, মেঘের গুড়গুড় আওয়াজ—এহেন পরিবেশে ভূতের গল্পের মতো মুখরোচক বোধ হয় কিছুই নেই। গল্পের শেষে ‘সংশয়’ সৃষ্টি আধুনিক ভূতের গল্পের একটি ইতিবাচক পয়েন্ট। এর সঙ্গে গা-ছমছমে অনুভবের আমেজ থাকলে তো কোনো কথাই নেই। এই রসের স্বাদ মিলবে না লোককথা বা রূপকথাতে। বিষয়টি ঠিকঠাক ব্যবহার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যদিও শুরুটা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; কিন্তু সঠিকভাবে বলতে গেলে বলা যায়, আধুনিক ভূতের গল্পের যথার্থ স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আধুনিক ভূতের গল্পগুলো একেকটি যেন আমাদের জীবনেরই জলছবি। পরশুরামের (রাজশেখর বসু) ‘ভূশণ্ডীর মাঠে’ গল্পে দেখি, ভূতের গল্পের মোড়কে বাঙালির দাম্পত্য–জীবনের গল্প। আবার তাঁরই গল্প ‘মহেশের মহাযাত্রা’ মহেশ নামে এক অতি অবিশ্বাসীর মুক্তি এবং যুক্তির বাইরের বিশ্বাস নিয়ে সংঘাত। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেও গড়ে উঠেছে ভূতের গল্প। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেলপথ খোলার সঙ্গে সঙ্গে লোকমুখে গড়ে উঠেছে স্টেশনে ভূত হানা দেওয়ার গল্প। বাংলায় ম্যালেরিয়া মহামারিতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্রামসংক্রান্ত প্রচলিত জনশ্রুতি নিয়ে বেশ কয়েকটি দারুণ ভূতের গল্প লেখা হয়েছে। বাঙালি গেরস্ত ভূতের নমুনা হিসেবে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ছোট কর্তা’ গল্পটি যেন বাঙালি ঘরের কন্যা দায়গ্রস্ত বাবার কথাই মনে করিয়ে দেয়।

বিদেশি সংস্কৃতির অন্যান্য বস্তুর মতো বিদেশি ভূত গবলিন, ভ্যাম্পায়ার, ওয়্যারউলফ, আধুনিক ‘পোল্টাজিস্ট ‘রা আমাদের দেশি ভূতের জায়গা দখল করে নিয়েছে।

আমাদেরও আছে হরেক রকমের ভূত!

এবার দেখা যাক আমাদের বাংলা সাহিত্যে কত প্রকারের ভূতের মজুত রয়েছে। বাংলার বিখ্যাত সব ভূতদের মধ্যে আছে ডাইনি, শাঁখচুন্নি, মেছোভূত, ব্রহ্মদৈত্য; তেমনি রয়েছে টেকো মাথায় ঝাঁপড়ি ভূত, গলাকাটা, পেঁচো, উল্কামুখী বা পেতনি, গুয়াসী, পান্তাভূত, কানি পিশাচি, জটাধারী, আচাকুয়া নামের অখ্যাত সব ভূত। শিশুসাহিত্যের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ভূতের গল্প। তবে এখনকার শিশুদের কাছে ভূত, আর ব্রহ্মদৈত্যদের তেমন কোনো পাত্তা নেই। বিদেশি সংস্কৃতির অন্যান্য বস্তুর মতো বিদেশি ভূত গবলিন, ভ্যাম্পায়ার, ওয়্যারউলফ, আধুনিক ‘পোল্টাজিস্ট ‘রা আমাদের দেশি ভূতের জায়গা দখল করে নিয়েছে। এখনকার শিশুরা ভূত আর ব্রহ্মদৈত্যের চেয়ে বেশি ভয় পায় জম্বি, ভ্যাম্পায়ার আর ওয়্যারউলফদের। শেষ করার আগে বলতে চাই, আমাদের আধুনিক জীবনে ভূতের কোনো স্থান না থাকলেও ভূতেরা আছে। আমাদের ব্যক্তিগত অবিশ্বাসের জগতের বাইরে যে সমষ্টিগত বিশ্বাসের জগৎ রয়েছে, ভূতেরা সেখানে আছে বহাল তবিয়তেই!

আরও পড়ুন