বাংলাদেশের সব জমি বাংলাদেশিদের মধ্যে সমান ভাগ করে দিলে একজন কতটুকু পাবে
কিশোর আলোতে সম্প্রতি একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। লেখাটির শিরোনাম, ‘পৃথিবীর সব জমি সবার মধ্যে সমান ভাগ করে দিলে একজন কতটুকু পাবে?’ এই লেখা পড়েছে বহু মানুষ। এই লেখা পড়ে অনেকে জানতে চেয়েছেন, আমাদের বাংলাদেশিদের কী খবর? আমাদের দেশের জমি আমাদের মধ্যে ভাগ করলে একজন কতটুকু করে জমি পাবে?
বিশ্বের হিসাবে জানা গেছে, মরুভূমি, অ্যান্টার্কটিকার জমাট বরফের এলাকা, হিমালয়ের খাড়া পাহাড় ইত্যাদি যদি জমি হিসেবে ধরা হয়, তবে একজনের ভাগে পড়বে ৫ একর জমি। আবার যদি কৃষিজমি বাদ দিয়ে হিসাব করা হয়, তবে মাত্র দুই একর জমি পড়বে। বিশ্বের মোট জমির হিসাবটা আনুমানিক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা একটা আনুমানিক হিসাব করার চেষ্টা করব।
তুমি হয়তো জানো, বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশের একটি বাংলাদেশ। ছোট্ট একটা দেশে কোটি কোটি মানুষ বাস করে। এখানে পারিবারিক যত ঝামেলা হয়, তার অধিকাংশ ঘটে জমিজমার ভাগ নিয়ে। আমরা এখানে শুধু ভাগের হিসাবটাই দেখব। যদি সবাইকে সমান ভাগ করে দেওয়া যেত, তবে একজন কতটুকু ভূমির মালিক হতো, আমরা সেটা এই লেখায় আনুমান করতে চাই।
এখন তো ২০২৫ সাল চলছে। আমাদের শেষ জনশুমারি হয়েছিল ২০২২ সালে। আমরা আমাদের আনুমানিক হিসাবের সুবিধার্থে ২০২২ সালের জনসংখ্যার হিসাব করব না। আমরা দেখব ২০২৫ সালের হিসাব। কারণ, ২০২২ সালের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেড়েছে। ২০২৫ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ইউএনএফপিএ-র আনুমানিক হিসাবে ১৭ কোটি ৫৭ লাখ। বাংলাদেশে প্রতিদিন ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার ৫০০ শিশু জন্মগ্রহণ করে। দৈনিক মৃত্যুবরণ করে প্রায় ২ হাজার ৭০০ থেকে ৩ হাজার মানুষ। সুতরাং, বুঝতেই পারছ বাংলাদেশে প্রতিদিন অনেক শিশু বাড়ছে!
প্রথমে জানিয়ে রাখি, আমাদের সমাজবিজ্ঞানের বইগুলোতে বলা আছে, বাংলাদেশের মোট ভূপৃষ্ঠ ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার। তবে এর মধ্যে নদ–নদীসহ ভেতরের জলাশয়ও আছে। তবে এই হিসাবে বাংলাদেশের সমুদ্রদীমা নেই। কেবল জমির হিসাব ধরলে ২০২৩ সালের বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১ লাখ ২৯ হাজার ৯৮০ বর্গকিলোমিটার ভূমি পাওয়া যাবে।
আবার দেশে আছে বেশ কিছু বনভূমি। বনভূমির ভেতরে কিছু মানুষ বাস করে। সেটাকে আমরা বাসযোগ্য ধরছি না। বনের হিসাবটাও আমরা আমাদের ভাগ থেকে বাদ দেব। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক হিসাবে বাংলাদেশের বনভূমির আয়তন প্রায় ১৮ হাজার ৮৩৪ বর্গকিলোমিটার (২০২৩)। এভাবে আমরা নদ-নদী এবং বনভূমি বাদ দিয়ে পাই ১ লাখ ২৯ হাজার ৯৮০ (নদ-নদী ছাড়া জমি) ১৮ হাজার ৮৩৪ (বন) = ১ লাখ ১১ হাজার ১৪৬ বর্গকিলোমিটার (ট্রেডিং ইকোনমিকসের হিসাব থেকে)।
এবার জনসংখ্যার কথা বলা যাক। ২০২৫ সালের জন্য ইউএনএফপিএর আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৫৭ লাখ মানুষ। এটাকে আমরা চূড়ান্ত জনসংখ্যা হিসেবে ধরে নিচ্ছি।
এখন ভাগ করা যাক। ১ লাখ ১১ হাজার ১৪৬ বর্গকিলোমিটার জমি যদি ১৭ কোটি ৫৭ লাখ মানুষের মধ্যে ভাগ করা হয়, তবে মাথাপিছু জমি দাঁড়ায় প্রায় ০.০০০৬৩ কিলোমিটার, অর্থাৎ প্রায় ৬৩৩ বর্গমিটার। এটিকে আরও পরিচিত এককে বদলে ফেলি। হেক্টর হিসাব করলে ০.০৬৩ হেক্টর জমি। একর হিসাবে প্রায় ০.১৫৬ একর বা প্রায় ১৫.৬ শতক। আঞ্চলিক মাপে প্রায় আধা বিঘা (৩৩ শতাংশে ১ বিঘা ধরা হলে)।
হিসাবটা সহজভাবে বললে, তোমার-আমার ভাগে প্রায় ৬ হাজার ৮০০ বর্গফুটের মতো জায়গা থাকবে। একটি বড় আকারের ভবনের প্লট হবে। দেড়টা বাস্কেটবল কোর্ট বানানো যাবে এই জায়গায়।
তোমার মনে আছে কি না, বিশ্বে আমরা পেতাম পাঁচ একর, দেশে এসে আমাদের হিসাবটা হয়ে গেল ০.১৫৬ একর। এ থেকে আমরা অনুমান করতে পারি, বিশ্বের গড় জমির তুলনায় আমরা পাই ৩২ ভাগের এক ভাগ। বিশ্বনাগরিক হিসেবে আমরা যে জমি পেতাম, একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমরা পাব তার তুলনায় ৩২ গুণ কম।
০.১৫৬ একর একর জমি পাব শুনে ভালোই মনে হচ্ছে। এত ঘনবসতির একটি দেশে আমার ভাগে পড়েছে ১৫ দশমিক ৬ শতক, কম কিসে? তবে আমাদের হিসাবটা এখানেই থামানো যাচ্ছে না। মাথাপিছু এই ৬৩৩ বর্গমিটারের মধ্যে আছে পাহাড়ের ঢাল, নদীর চর, নদীভাঙন এলাকা, বন্যায় ডুবে যাওয়া এলাকা, লবণাক্ত উপকূল অঞ্চল। এরপর আছে রাস্তাঘাট, স্কুল-হাসপাতাল, বাজার, কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাঠ, খেলার জায়গা, মানে যাকে আমরা বলি কমন স্পেস। সবার জন্য যে জায়গাটুকু লাগে। সব যদি ব্যক্তি ভাগ করে নিয়ে যায়, তবে চলার জন্য রাস্তা থাকবে না। চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল থাকবে না। তো এসব জায়গা ছাড়লে একজনের ভাগে জায়গা আরও কমে যায়। ফলে যে জমিটুকু আমরা কাগজে-কলমে পেলাম, বাস্তবে বাসযোগ্য জায়গা তার চেয়ে ছোট।
আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। কৃষিজমিটুকু যদি এভাবে ব্যক্তিকে ভাগ করে দেওয়া হলে বিপদ হবে। কেউ যদি নিজের জায়গায় কৃষি করতে না চায়, তখন খাদ্যনিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি হবে।
পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, এই হিসাবটা সময়ের সঙ্গে বদলাবে। বনভূমির আয়তন বাড়বে বা কমবে। নদীভাঙনে আমরা জমি হারিয়ে ফেলন ইত্যাদি। তবু ২০২৫ সালের বাংলাদেশে নদ–নদী, সমুদ্র আর বনভূমি বাদ দিয়ে সবার জন্য সমান ভাগ ধরলে প্রতে৵ক মানুষ মোটামুটি ৬৩৩ বর্গমিটার জায়গা পাবে।
সূত্র: বিশ্বব্যাংকের হিসাব ও সরকারি তথ্য
সতর্কতা: এই লেখা কোনো পরিসাংখ্যিক হিসাব নয়, শুধু আনন্দের জন্য আনুমানিক হিসাব