১৩০০–তে ১২৮৫ নম্বর পাওয়া নিবিড় কর্মকার কত ঘণ্টা পড়ত

মা–বাবার সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষায় সেরা নিবিড় কর্মকারছবি: জুয়েল শীল

১০ জুলাই ২০২৫। বেলা দুইটার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা হয়েছে। তবে বিদ্যালয়গুলোতে আরও কিছু সময় আগে পৌঁছেছে ফলাফল। শিক্ষা বোর্ড থেকে এক কিলোমিটার দূরে নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উল্লাস চলছিল, তবে সেখানে ভিন্ন এক উল্লাস দেখা গেল শিক্ষার্থীদের।

বিদ্যালয়ের ২৭৩ জন জিপিএ-৫ পেলেও একজনের ফলাফল নিয়ে পুরো বিদ্যালয় আলাদাভাবে উচ্ছ্বসিত ছিল তখন। নিবিড় কর্মকার। শুধু জিপিএ-৫ নয়, বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১ হাজার ৩০০ নম্বরের মধ্যে পেয়েছে ১ হাজার ২৮৫। নিজের নম্বর দেখে নিজেই অবাক হয়ে যায় নিবিড়। ততক্ষণে বিদ্যালয়জুড়ে গুঞ্জন শুরু হয়, এবার সারা দেশে প্রথম হয়েছে নিবিড়।

প্রথম নাকি দ্বিতীয় সেটি আর জানা যায়নি। কারণ, শিক্ষা বোর্ড এবার জিপিএ ভিত্তিতে মেধাতালিকা প্রকাশ করেনি। তবে পাওয়া গেল নিবিড়কে। বিদ্যালয়ে উল্লাস শেষে ঘরে ফিরে গেছে সে। পরদিন তার খোঁজ পাওয়া গেল, চট্টগ্রাম নগরের আন্দরকিল্লা এলাকায় রাজাপুকুর লেনের একটি ভবনে। সেখানে বাবা, মা ও ছোট বোনকে নিয়ে বসবাস করে নিবিড়।

আরও পড়ুন

ঘরে ঢুকতেই দরজা খুললেন নিবিড়ের বাবা জীবন কর্মকার। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা তিনি। ছেলের ফলাফলের আনন্দ তার চোখেমুখে। পাশেই সোফায় মাকে জড়িয়ে আছে নিবিড়। এত নম্বর নিবিড় কীভাবে পেল? নিবিড় কী তাহলে পুরো দিন পড়ে? আর কিছু কি করে নিবিড়? নাকি শুধু বই নিয়েই থাকে সারা দিন? —এমন আরও অনেক প্রশ্ন নিয়ে বসে যাই নিবিড়ের সামনে। হাসিমুখেই জবাব দিতে থাকে সে।

নিবিড় বলল, সে সারা দিন নয়, বরং সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টাই পড়ালেখা করে। আর বাকি সময় তার কাটে বিদ্যালয়ে আর শিক্ষকদের কাছ থেকে নানা ধরনের নতুন বিষয়ে জানতে। তবে যেটুকু সময় সে পড়ে, তা মন দিয়েই পড়ে নিবিড়। না হলে রসায়নের বিক্রিয়া আর পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র যে গুলিয়ে ফেলবে সে!

‘ভালো ফল হবে আশা করেছিলাম, তবে নম্বর কেমন আসবে, তা নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। নম্বর দেখার পর নিজেরই অনেক ভালো লেগেছে,’ নিবিড় বলল। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তা এই ফলাফলের অন্যতম শক্তি বলে মনে করে নিবিড়। সে জানায়, ‘কোনো বিষয়ে আটকে গেলে প্রথমেই শিক্ষকদের কাছে গেছি।’

নিবিড়দের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলায়। যদিও তার বেড়ে ওঠা পুরোপুরি চট্টগ্রাম নগরে। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি কেটেছে ইস্পাহানি আদর্শ হাইস্কুলে। এরপর নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে। ছোট সমৃদ্ধি কর্মকার বর্তমানে নবম শ্রেণিতে পড়ছে। আর তাদের মা রিপা রায় একসময় বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। এখন পুরোটা সময় সন্তানদের দেন তিনি।

আরও পড়ুন

যেভাবে কেটেছে স্কুলের দিনগুলো

নিবিড় কর্মকার
ছবি: জুয়েল শীল

২০১৯ সালের কথা। সদ্য চতুর্থ শ্রেণি পাস করে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তির অপেক্ষায় খুদে নিবিড়। সরকারি স্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় টিকে ভর্তি হয় চট্টগ্রাম নগরের নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে। এরপর এ বিদ্যালয়ের কেটেছে ছয় বছর। হঠাৎ নতুন স্কুলে এসে কিছুটা ঘাবড়ে যায় নিবিড়। তবে দিন যেতেই মিশে যায় সবার সঙ্গে। নিজের মেধায় শিক্ষকদের নজরে দ্রুত চলে আসে সে।

নিবিড়ের বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, নিবিড় ভর্তির পর থেকেই প্রতি শ্রেণিতে শীর্ষ রেজাল্ট করেছে। নিবিড় ছাড়াও নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে এসএসসির সব শিক্ষার্থীকে শিক্ষকেরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন। তাদের যেকোনো বিষয়ের সমস্যার সমাধান করেছেন শিক্ষকেরা। তবে নিবিড়ে চেষ্টা আর পরিশ্রম ছিল একটু বেশি।

‘স্কুলের ক্লাস শেষে শিক্ষকদের কাছ থেকে আলাদা করে পড়া বুঝে নিতাম। বিশেষ করে নবম-দশমে শিক্ষকদের কাছে সব সময় ছুটে গিয়েছি। কিছু না বুঝলে তাঁরা সময় নিয়ে বুঝিয়ে দিতেন’, বলল নিবিড়। আর বাসায় শিক্ষকের ছিল কি না, প্রশ্নের জবাবে সে জানায়, ‘কখনো ছিল না। কিছু না বুঝলে শিক্ষকেরাই বুঝিয়ে দিতেন।’

নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুর রহমান। জানতে চাইলে নিবিড়ে ফলাফল সম্পর্কে তিনি জানালেন, নিবিড় খুবই বিনয়ী ও ভদ্র। নিয়মিত পড়াশোনা করেছে। এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় স্কুলে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে সে। তিনি আরও বলেন, ‘টেস্ট পরীক্ষায় ১ হাজার ১৫০ নম্বরের মধ্যে ১ হাজার ৪০ পেয়েছিল নিবিড়। তখনই বুঝেছি সে বোর্ডে ভালো করবে।’

নিবিড়ের বাবার জীবন কর্মকার ছেলেকে পাঠ্যবইয়ে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে এসেছেন শুরু থেকে। তিনি মনে করেন পাঠ্যবইগুলো আয়ত্ত করলে পরীক্ষায় ভালো করা সম্ভব। তিনি বলেন, ‘আমরা বাসায় কোনো টিচার রাখিনি। ছেলেকে সব সময় মূল বই পড়তে বলতাম। গাইড থেকে সহায়তা নিত সে, তবে মূল ছিল পাঠ্যবই।’

আরও পড়ুন

পড়াশোনার বাইরে আরও জগৎ

নিবিড়ের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের বসার ঘরে অনেকগুলো ট্রফি আর ক্রেস্ট দেখা গেল। কোনোটি রচনা প্রতিযোগিতার, কোনোটি অলিম্পিয়াডের; আবার কোনোটি দেশাত্মবোধক গানের। অর্থাৎ পড়ালেখার বাইরেও নিবিড়ের অন্য একটি জগৎ ছিল। শুধু পড়াশোনার মধ্যেই আটকে রাখেনি নিজেকে। সহশিক্ষা কার্যক্রমেও ছিল তার যথেষ্ট আগ্রহ।

নিবিড়ের মা রিপা রায় জানান, ‘নিবিড়কে ছোট থেকেই বিভিন্ন পরীক্ষা-প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে উৎসাহ দিয়েছি আমরা। বিভিন্ন ধরনের রচনা প্রতিযোগিতা, পরীক্ষা, এগুলোতে যেত সে। এতে আস্তে আস্তে তার ভয় কেটে গেছে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যাতে ঘাবড়ে না যায়, তাই শুরু থেকে আমরা খেয়াল রেখেছি।’

এবার জানা গেল আরেকটু ভিন্ন তথ্য। আঁকাআঁকিও করত নিবিড়। করোনা মহামারি সময় আঁকা এক ছবি দেখালেন তার বাবা। বললেন, ‘শুরুতে আঁকাআঁকির প্রতি ঝোঁক ছিল তার। পরে পড়ালেখার কারণে আর সেভাবে করা হয়ে ওঠেনি। মাঝেমধ্যে আঁকাআঁকি করে নিজের মতো করে। আমরা তাকে কখনো বাধা দেইনি।’

বই পড়তেও পছন্দ করে নিবিড়। জানায়, সাধারণত সায়েন্স ফিকশন পড়তে ভালো লাগে তার। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, গ্রহ-তারার খোঁজ, এলিয়েনদের নিয়ে নতুন তথ্য আর বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে জানতে ভালোবাসে নিবিড়। তবে এর বাইরে গল্প-কবিতাও পড়ে নিবিড়। বিদ্যালয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে বই পেয়েছিল নিবিড়।

আরও পড়ুন

এসবের বাইরে নিবিড় ঘুরতে ভালোবাসে। তার পরিবার মনে করে, শুধু পড়ালেখার মধ্যে আটকে রাখলে তার মানসিক বিকাশ হবে না। তাকে সবার সঙ্গে মিশতে হবে। তার আশপাশ সম্পর্কে জানতে হবে। তাই পরিবারের পক্ষ থেকে সব সময় তাকে এবং তার বোনকে সেভাবেই যত্ন নেওয়া হয়েছে। আর তাই নিজের অর্জনে মা–বাবার প্রতি বেশি কৃতজ্ঞ।

এখানেই থামছে না নিবিড়

নিবিড়ের ফলাফল তালিকায় দেখা যায়, সে চারটি বিষয়ে ১০০–তে ১০০ পেয়েছে। এর মধ্যে আছে গণিত, উচ্চতর গণিত ও রসায়ন। কীভাবে পেলে? এমন প্রশ্নে নিবিড় কিছুটা হেসেই বলল, ‘অনুশীলন করেছি নিয়মিত।’ অর্থাৎ পরীক্ষায় কোনো বিষয়ে ভালো ফলাফলের সূত্র হলো নিয়মিত পড়াশোনা ও চর্চা করা।

‘প্রতিটি পরীক্ষা শুরুর আগে নার্ভাস হয়ে যেতাম। প্রশ্ন কেমন আসবে তা নিয়ে,’ নিবিড় বলল। তখন কীভাবে সামনে নিতে? ‘মা-বাবা ও শিক্ষকদের বলতাম। তারা সব সময় অভয় দিতেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অনেক আন্তরিক ছিলেন। সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ, সবার চেষ্টায় আজ এখানে আমি,’ নিবিড় মুখে হাসি নিয়েই জবাব দিল।

ছেলের পাশে বসা রিপা রায় বললেন, ‘ওকে কখনো চাপ দিইনি। নিজে থেকেই পড়াশোনায় আগ্রহী ছিল। নিয়মিত স্কুলের দিকনির্দেশনা মেনেই পড়াশোনা করেছে। শিক্ষকেরা ছিলেন খুব আন্তরিক। ঘরে আমরা শুধু খেয়াল রেখেছি, ওর পড়ালেখার পরিবেশটা ঠিক আছে কি না। তবে এসএসসি পরীক্ষার আগে কয়েকটি কোচিংয়ে কেবল মডেল টেস্ট দিয়েছে।’

নতুন পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উদ্দেশে নিবিড়ের বাবা জীবন কর্মকার বলেন, ‘সন্তানদের কখনো চাপ দেওয়া ঠিক না। তাকে বোঝাতে হবে। যার যেটুকু মেধা, সেটুকুর মধ্যে তাকে সর্বোচ্চ ফলাফল করার উৎসাহ দিতে হবে। সন্তানদের পাশে বসে তাদের কথা শুনতে হবে। মা–বাবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলে সন্তানেরা নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দিতে পারে।’

এবার স্বপ্ন কী, এমন প্রশ্নে নিবিড়ের সোজা জবাব, ‘বুয়েট’। নিজেকে একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেখতে চায় সে। তবে তার আগে পেরোতে হবে এইচএসসির ধাপ। ‘চট্টগ্রামের স্বনামধন্য সরকারি কলেজগুলোই তালিকায় থাকবে। দেখা যাক, কোন কলেজে আসে।’ এইচএসসিতেও নিজের সর্বোচ্চটা দিতে চায় নিবিড়। তার ইচ্ছা একজন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশের জন্য কাজ করা।

আরও পড়ুন