অন্যকে আঘাত পেতে দেখলে আমাদের খারাপ লাগে কেন
কল্পনা করো, তুমি সিনেমা হলে বসে আছ। পর্দায় হঠাৎ কেউ পড়ে গেল। দেখবে, তোমার শরীরটাও অজান্তেই কেঁপে উঠেছে। পাশের মানুষটাও হয়তো একটু ভয় পেয়েছে। কেউ কেউ হয়তো পর্দা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। মনে হলো, ব্যথাটা যেন একটু হলেও নিজের শরীরেই লাগল।
এটা আমাদের সবার সঙ্গেই হয়। এতটাই সাধারণ অভিজ্ঞতা যে আমরা কখনো ভেবে দেখি না, কেন এমন হয়? কিন্তু আশ্চর্যের কথা হলো, বিজ্ঞানীরাও এত দিন ভালোভাবে এর কারণ জানতেন না। তবে এখন রহস্যের জট কিছুটা হলেও খুলেছে।
একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা যখন কাউকে ব্যথা পেতে দেখি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক শুধু দেখেই থেমে থাকে না। মস্তিষ্কের যে অংশ স্পর্শ বোঝে, সেই অংশ তখন সক্রিয় হয়ে ওঠে। মানে দেখার পাশাপাশি আমরা ব্যথাটা অনুভবও করি।
এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব রিডিংয়ের বিজ্ঞানী নিকোলাস হেজার। তাঁর দল দেখিয়েছে, শুধু চোখে দেখেই মস্তিষ্কে স্পর্শসংক্রান্ত এলাকাগুলো জাগিয়ে তোলা সম্ভব। তুমি যখন কাউকে গায়ে সুড়সুড়ি দিতে বা আঘাত পেতে দেখো, তখন তোমার মস্তিষ্কের সেই সব অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। তোমার নিজের শরীরে স্পর্শ লাগলে মস্তিষ্কের ওই অংশ যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাত, অন্যের শরীরে স্পর্শ লাগলেও তেমন প্রতিক্রিয়াই দেখায়। বাস্তবে কিন্তু তোমাকে কেউ স্পর্শ করেনি, কিন্তু মস্তিষ্ক তখন ছোঁয়ার একটা নকল অনুভূতি তৈরি করে ফেলে।
এ কারণেই সিনেমার পর্দায় কেউ ঘোড়া থেকে পড়ে গেলে, জোরে লাথি খেলে বা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলে আমরা নিজেরাও একটু কুঁকড়ে যাই। মনে হয়, ব্যথাটা আমাদেরও লাগল।
বিষয়টা বুঝতে গবেষকেরা ১৭৪ স্বেচ্ছাসেবীকে নিয়ে একটা পরীক্ষা করেন। তাঁদের ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয় আর একই সঙ্গে মস্তিষ্ক স্ক্যান করা হয়। ভিডিওগুলো ছিল এক থেকে চার মিনিটের মতো। ভিডিওর দৃশ্যগুলো নেওয়া হয়েছে ছয়টি জনপ্রিয় হলিউড মুভি থেকে। মুভিগুলো হলো ‘দ্য সোশ্যাল নেটওয়ার্ক’,‘ ইনসেপশন’, ‘ওশানস ইলেভেন’, ‘হোম অ্যালোন’, ‘এরিন ব্রকোভিচ’ ও ‘দ্য এম্পায়ার স্ট্রাইক্স ব্যাক’। শেষের মুভিটায় বেশ কিছু ব্যথা লাগার দৃশ্য আছে।
স্ক্যানের ফলাফল ছিল দারুণ মজার। দেখা গেল, আমাদের মস্তিষ্কে দেখা আর ছোঁয়ার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। মস্তিষ্কের দৃষ্টির একটা অংশ শরীরের মানচিত্রের সঙ্গে যুক্ত। পর্দার ওপরের দিকে যা দেখা যায়, সেটা মস্তিষ্কে শরীরের ওপরের অংশের সঙ্গে মিলে যায়। নিচের দিকে যা দেখা যায়, সেটা পায়ের দিকের অংশের সঙ্গে মেলে।
ধরো, রাতের অন্ধকারে তুমি বাথরুমে যাচ্ছ। চোখে ঠিকমতো কিছু দেখতে পাচ্ছ না। তখন হাত দিয়ে দেয়াল ছুঁয়ে দরজার অবস্থান বুঝে নাও। এই স্পর্শের অনুভূতিই মস্তিষ্ককে একটা মানচিত্র বানাতে সাহায্য করে। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে না, একসঙ্গে মিলে একটা স্পষ্ট ছবি বানায়।
এই আবিষ্কার আরও একটা বড় দিক খুলে দিচ্ছে। অটিজমের মতো অবস্থাগুলো বোঝার ক্ষেত্রেও এটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, আমরা যা দেখি, সেটা মনের ভেতরে অনুকরণ করেই অন্য মানুষের অনুভূতি বুঝতে শিখি। অটিস্টিক মানুষের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া ভিন্নভাবে কাজ করতে পারে।
সব মিলিয়ে, এই গবেষণা আমাদের মস্তিষ্কের গঠন নিয়ে একটা মৌলিক নিয়ম সামনে এনেছে। আর সেই সঙ্গে এমন এক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে যেটা আমরা সবাই বহুবার অনুভব করেছি, কিন্তু কখনো ঠিক বুঝতে পারিনি।
সূত্র: আইএফএল সায়েন্স