বৈদ্যুতিক বাতি কে আবিষ্কার করেছেন, এডিসন নাকি অন্য কেউ

টমাস আলভা এডিসনছবিটি এআই দিয়ে তৈরি

আমাদের মাথায় কোনো ভালো বুদ্ধি এলেই আমরা বলি, ‘আইডিয়া এসেছে!’ তখন মাথার ওপর একটি বাতি জ্বলে ওঠার ছবি আঁকা হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো ছবি বোঝাতে বৈদ্যুতিক বাতির ছবিই বেশি ব্যবহৃত হয়। বৈদ্যুতিক বাতি নিঃসন্দেহে ইতিহাসের অন্যতম সেরা আবিষ্কার।

এই আবিষ্কারের কথা মনে হলেই কার নাম মাথায় আসে? টমাস এডিসন, তাই না? কিন্তু এই গল্পের পেছনে আরও অনেকে লুকিয়ে আছেন। কোনো বড় আবিষ্কারই একজন মানুষের হাতে হয় না। এর পেছনে থাকে বহু মানুষের মেধা ও পরিশ্রম। চলো, আজ বৈদ্যুতিক বাতির আসল গল্পটি জানা যাক।

১৮৭০-এর দশকে মানুষ রাতে আলো জ্বালাত গ্যাস বা কেরোসিনের বাতি দিয়ে। কিন্তু এগুলো ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এসব থেকে আগুন লাগার ভয় ছিল। বাতাসও দূষিত হতো। আবার মোমবাতির আলো ছিল খুবই কম। তাই সবাই নিরাপদ ও উজ্জ্বল আলোর অপেক্ষায় ছিল।

আরও পড়ুন

তখন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী টমাস এডিসনসহ অনেকেই এই সমস্যার সমাধানে কাজ শুরু করেন। তাঁদের সবার লক্ষ্য ছিল একটাই—কীভাবে কাচের গোলকের ভেতরে থাকা একটি সরু সুতার মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ পাঠিয়ে সেটি না পুড়িয়ে উজ্জ্বলভাবে জ্বালিয়ে রাখা যায়। মানে একটি কাচের গোলকের ভেতরে থাকবে একটি সরু সুতা। সেই সুতার মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ পাঠানো হবে। তবে সুতাটি পুড়বে না, বরং উজ্জ্বলভাবে জ্বলতে থাকবে।

যুক্তরাজ্যের রসায়নবিদ জোসেফ সোয়ান ১৮৭৮ সালে একটি ভাস্বর বাতি তৈরি করেন। তিনি এর পেটেন্টও নেন। নিজের বাড়ি সেই বাতি দিয়ে আলোকিত করেছিলেন জোসেফ। এরপর ১৮৮১ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে একটি বড় বিদ্যুৎ প্রদর্শনী হয়। সেখানে টমাস এডিসনসহ আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী নিজেদের তৈরি বাতি দেখান। তবে এডিসনের বাতিটিই ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বল ও দীর্ঘস্থায়ী। তাই তাঁর বাতিই সেরা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

কিন্তু এডিসনের আসল কৃতিত্ব শুধু একটি বাতি আবিষ্কারে ছিল না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু বাতি বানালে চলবে না। মানুষের ঘরে ঘরে আলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি পুরো ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।

আরও পড়ুন

এই ভেবে তিনি আরও কিছু জিনিস আবিষ্কার করেন। বিদ্যুৎ তৈরির জন্য একটি শক্তিশালী ডায়নামো বানান। মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুৎ পাঠানোর জন্য তারের নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। বাতি লাগানোর জন্য ল্যাম্প বা বাতিদানিও তৈরি করেন তিনি। এমনকি তিনি মিটারও আবিষ্কার করেন। এই মিটার দিয়ে মাপা হতো, কোন বাড়িতে কতটুকু বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। এর মাধ্যমে তিনি গ্রাহকদের কাছ থেকে বিল নিতে পারতেন।

১৮৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যানহাটান শহরে তিনি এই পুরো ব্যবস্থাটি সফলভাবে চালু করেন। এভাবেই এডিসনের আবিষ্কার শুধু পরীক্ষাগারে সীমাবদ্ধ না থেকে একটি বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়।

এডিসন অবশ্য একা একা এসব কাজ করেননি। তাঁর একটি গোপন অস্ত্র ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির মেনলো পার্কে ছিল তাঁর বিশাল গবেষণাগার। তিনি সেই গবেষণাগারকে বলতেন আবিষ্কারের কারখানা বা ইনভেনশন ফ্যাক্টরি। সেখানে তিনি অনেক দক্ষ বিজ্ঞানী ও টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেন। তিনি নিজে হয়তো স্কুলের গণ্ডি পেরোননি, কিন্তু তিনি জানতেন, কাদের সাহায্য নিলে কাজটি সফল হবে। জেপি মরগ্যানের মতো বড় বিনিয়োগকারীদেরও তাঁর গবেষণায় অর্থ বিনিয়োগে রাজি করান এডিসন।

আরও পড়ুন

ঐতিহাসিকেরা বলেন, এডিসনের সেরা আবিষ্কার হয়তো এই গবেষণাগারটিই। একটি দল নিয়ে গবেষণা করার এই পদ্ধতিকেই আজ আমরা ‘গবেষণা ও উন্নয়ন’ বা আরঅ্যান্ডডি বলি। আজকের দিনের বড় বড় আবিষ্কার, যেমন ইন্টারনেট বা জীবনরক্ষাকারী ভ্যাকসিন এই পদ্ধতিতেই তৈরি হয়েছে।

এডিসনের বাতি আবিষ্কারের পর সারা পৃথিবীতে বিপ্লব ঘটে যায়। কারখানার মালিকেরা রাতে কাজ চালানোর জন্য বাতি লাগান। সিনেমা হল, দোকান বা ক্রিসমাস ট্রি সাজাতেও ব্যবহৃত হতে থাকে বাতি। এমনকি রাতে বেসবল খেলারও আয়োজন করা হয় বাতি দিয়ে। চিকিৎসকেরা ছোট বাতি ব্যবহার করে রাতে অপারেশন শুরু করেন। দিন ও রাত সম্পর্কে মানুষের ধারণাই পুরোপুরি বদলে যায়।

আজ আমরা একটি সুইচ টিপেই আলো জ্বালাই। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। টমাস এডিসনের সেই প্রথম বাতিটি ছিল এই বৈদ্যুতিক বিপ্লবের একটি প্রাথমিক ধাপ। তাই বোঝাই যাচ্ছে, বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কার কোনো একজন জাদুকরের কাজ নয়। এটি ছিল বহু মানুষের বহু বছরের সম্মিলিত চেষ্টার ফল।

সূত্র: দ্য কনভার্সেশন-এর ‘কিউরিয়াস কিডস’ অবলম্বনে

আরও পড়ুন