আজ তলস্তয়ের মৃত্যুদিন, মৃত্যুর ১০ দিনে আগে কেন তিনি বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন

লিও তলস্তয়ছবি: ফ্রিপিক ডটকম

লিও তলস্তয়ের নাম শুনলেই ওয়ার অ্যান্ড পিস, আন্না কারেনিনার কথা তোমার মনে পড়তে পারে। ১৯১০ সালের ঠিক এই সময় তিনি রাশিয়াজুড়ে আলোড়ন তুলেছিলেন এক অদ্ভুত ঘটনার জন্য। তাঁর মৃত্যুর দশ দিন আগে, ৮২ বছর বয়সে তিনি হঠাৎ মাঝরাতে নিজের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন, এসব প্রশ্নে পুরো দেশ তখন টালমাটাল।

তলস্তয়ের জীবনে তখন বড় ধরনের মানসিক টানাপোড়েন চলছিল। বহু বছর ধরে তিনি পরিবার, বিয়ে, সন্তান, ধর্ম, এসবের মূল্য নিয়ে লিখেছেন, কথা বলেছেন। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে তাঁর নিজের মধ্যে অনেক বদল দেখতে পান। তিনি অর্থডক্স চার্চ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। বিয়ে নিয়ে বিরক্ত ছিলেন। এমনকি নিজের সম্পত্তি ও বইয়ের কপিরাইটও ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। স্ত্রী সোফিয়া আন্দ্রেয়েভনার সঙ্গে তখন প্রায়ই ঝগড়া হতো। তখন তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হয়ে উঠেছিল তাঁর অনুগত শিষ্য ভ্লাদিমির চের্তকভ।

আরও পড়ুন

বাড়ির পরিবেশ যত তিক্ত হচ্ছিল, ততই তলস্তয়ের মনে হচ্ছিল, তাঁকে পালাতে হবে। বহুবার চেষ্টা করেও পারেননি। অবশেষে ১৯১০ সালের ১০ নভেম্বর গভীর রাতে তিনি নীরবে বেরিয়ে পড়লেন। সঙ্গে শুধু কিছু জামাকাপড়, আর তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ড. মাকোভিৎসকি। যাকে ঘর থেকে বাইরে এনে হঠাৎ বললেন, চলো।

তিনি কোথায় যাচ্ছেন, তিনিও জানতেন না। ট্রেন বদলে বদলে কখনো তুলা, কখনো বেলিওভ, কখনো আবার নিজের সন্ন্যাসিনী বোনের কাছে শামোরদিনো কনভেন্টে গিয়ে উঠলেন। সাংবাদিকরা পুরো ঘটনাকে গোয়েন্দা-কাহিনির মতো অনুসরণ করছিল। পত্রিকায় ছাপা হচ্ছিল, ‘আজ তলস্তয় ক্যাফেতে ডিম খেলেন।’

এরপর তিনি দক্ষিণে বুলগেরিয়া যাওয়ার কথা ভাবলেন। কিন্তু পথে ঠাণ্ডায় ভয়ংকর অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিউমোনিয়ার মতো লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসক তাঁকে ট্রেন থেকে নামিয়ে নেন লিপেৎস্ক অঞ্চলের ছোট স্টেশন আস্তাপোভোতে।

আরও পড়ুন

তলস্তয়ের শেষ দিন: আস্তাপোভো স্টেশনের একটি ছোট ঘরে

স্ত্রী সোফিয়ার সঙ্গে তলস্তয়
ছবি সংগৃহীত

১৩ নভেম্বর তাঁকে স্টেশনমাস্টারের সাধারণ বাড়ির একটি ঘরে রাখা হয়। তখনকার জন্য ঘরটা আরামদায়ক ছিল। তলস্তয় প্রায় অচেতন। শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। ডাক্তাররা চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু তিনি বললেন, ‘আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও, যা হওয়ার হোক।’

সেই সময় পিটার্সবার্গ থেকে শুরু করে রাশিয়ার সবখানে তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে সরকারি পর্যায়ে উদ্বেগ ছিল। স্টেশনে পুলিশের ভিড়, সাংবাদিকের ভিড়, বাইরে অসংখ্য মানুষ। সবাই জানতে চাইছে, কেমন আছেন এই মহান লেখক।

তাঁর ঘনিষ্ঠ শিষ্য চের্তকভ তাঁর কাছে সবার আগে ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু স্ত্রী সোফিয়াকে তলস্তয় দেখা দিতে চাননি। অতীতের ঝগড়া তাঁকে আঘাত করেছিল, তিনি স্ত্রীকে এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন। সোফিয়া কেঁদে কেঁদে দরজার বাইরে বসেছিলেন। কিন্তু পরিবার ও ডাক্তাররা তাঁকে ঢুকতে দেয়নি।

আরও পড়ুন

শেষ মুহূর্তে, যখন তলস্তয়ের চেতনা নেই, তখন স্ত্রীকে সামনে নিয়ে আসা হয়। সোফিয়া নীরবে তাঁর কপালে চুমু খেয়ে বলেছিলেন, ‘ক্ষমা করে দিও।’ তলস্তয় তখন আর শুনতে পারছিলেন না।

২০ নভেম্বর ১৯১০

আজকের এই দিন ভোরের দিকে লিও তলস্তয় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তাঁর মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রাশিয়ার ইয়াসনয়া পলিয়ানায়। হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে তাঁকে বিদায় জানায়। তাঁর নির্দেশ ছিল, দাফন হবে কোনো নিয়ম ছাড়া, নিঃশব্দে, একেবারে সরলভাবে। তাই আজও তাঁর সমাধি দেখবে শুধু একটি সবুজ টিলার মতো। কোনো ক্রস নেই, কোনো বিশাল স্মৃতিস্তম্ভ নেই।

সূত্র: রাশিয়া বিয়ন্ড

আরও পড়ুন