রামানুজনের পাই–এর সূত্রে যেভাবে মিলল ব্ল্যাক হোলের ইঙ্গিত
বৃত্তের ক্ষেত্রফল বা পরিধি বের করতে পাই লাগে—এটা নিশ্চয়ই স্কুলে বহুবার জেনেছ। পাই হলো ৩ দশমিক ১৪–এর মতো একটি সংখ্যা; যার দশমিকের পরে অসংখ্য ঘর আছে। এটি কিন্তু শুধু বৃত্তের অঙ্কেই কাজে লাগে তা নয়। বিজ্ঞানীরা সুপারকম্পিউটার দিয়ে এর ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন–সংখ্যক অঙ্ক পর্যন্ত বের করেছেন।
কিন্তু জানো কি, ১০০ বছর আগে ভারতীয় গণিতবিদ শ্রীনিবাস রামানুজন পাইয়ের যে সূত্র বের করেছিলেন, সেগুলোই আজ আবার দেখা মিলছে আধুনিক উচ্চ শক্তি-পদার্থবিজ্ঞানে! অর্থাৎ মহাবিশ্ব–সম্পর্কিত জটিল তত্ত্বে ফিরে এসেছে সেই তত্ত্ব।
ভারতের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের (আইআইএসসি) সেন্টার ফর হাই এনার্জি ফিজিকস (সিএইচইপি) বিভাগের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে জানিয়েছেন, রামানুজনের ১০০ বছরের পুরোনো কাজ আজকের আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
জনপ্রিয় গবেষণা পত্রিকা ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস-এ প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষ করে পানি যখন ফুটে বাষ্প ও তরলের পার্থক্য হারায় (পারকোলেশন), বায়ুপ্রবাহের বিশৃঙ্খল বা এলোমেলো অবস্থা (টার্বুলেন্স) এমনকি মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় এবং শক্তিশালী বস্তুগুলোর মধ্যে একটি ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে এই সূত্রগুলো পাওয়া যায়।
রামানুজন কে ছিলেন
শ্রীনিবাস রামানুজন ছিলেন এক বিস্ময়প্রতিভা। ১৮৮৭ সালে ভারতের মাদ্রাজ প্রদেশের তাঞ্জোর জেলার ইরোডে শহরের শ্রীনিবাস আর কোমলতাম্মাল দেবীর ঘরে তাঁর জন্ম।
ছোটবেলা থেকে মৌলিক সংখ্যা নিয়ে রামানুজনের আগ্রহ ছিল। পাই (বৃত্তের পরিধি আর ব্যাসের অনুপাত) বা ২-এর বর্গমূলের মান দশমিকের পর অনেক দূর পর্যন্ত বলে যেতে পারতেন তিনি। প্রাইমারি পেরিয়ে যখন হাইস্কুলে পড়তে শুরু করলেন, তখনই লোকজন টের পেল, এটা শুধু মুখস্থের ব্যাপার নয়। এমন সবকিছু তিনি বলেন বা করেন, যা কোনো বই-পুস্তকে আছে কি না সেটাই কেউ বলতে পারে না।
অল্প বয়সেই গণিতের প্রতি তাঁর আগ্রহ এত গভীর ছিল যে সাধারণ পাঠ্যবই তাঁর কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি। বাড়িতে একটি পুরোনো গণিতের বই পেয়ে তিনি নিজেই উচ্চতর গণিত শিখে নেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি না থাকা সত্ত্বেও তিনি সংখ্যাতত্ত্ব, অসীম ধারা, পার্টিশন তত্ত্ব, এলিপ্টিক ফাংশনসহ বহু ক্ষেত্রে নতুন সূত্র আবিষ্কার করেন।
পরে মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টে কেরানির চাকরি করতে করতেই তিনি খাতার পর খাতা ভরে নতুন সমীকরণ লিখতেন। এরই মধ্যে মাদ্রাজ শহরে রামানুজনের নাম ছড়িয়ে পড়ে গণিতের জাদুকর হিসেবে। পরে ইংল্যান্ডের গণিতবিদ জি এইচ হার্ডির দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের সুযোগ পান। ছোট্ট জীবনে অসংখ্য গবেষণাপত্র প্রকাশ করে তিনি গণিতের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
রামানুজনের মাথায় পাইয়ের বিস্ময়কর সূত্র
১৯১৪ সালে মাদ্রাজ থেকে কেমব্রিজ যাওয়ার আগে রামানুজন পাই গণনার জন্য ১৭টি গাণিতিক সূত্রের একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সূত্রগুলো এত কার্যকর ছিল যে কয়েকটি টার্ম ব্যবহার করেই দ্রুত পাইয়ের বহু সঠিক অঙ্ক বের করা যেত।
পরে সুপারকম্পিউটার যে অ্যালগরিদম ব্যবহার করে ২০০ ট্রিলিয়ন অঙ্ক পর্যন্ত পাই নির্ণয় করেছে—তার শিকড় রামানুজনের সেই সূত্রের ভেতরেই আছে।
সিএইচইপির অধ্যাপক ও এই গবেষণা দলের জ্যেষ্ঠ গবেষক অনিন্দ্য সিনহা বলেন, আজ যে চুদনভস্কি অ্যালগরিদম ব্যবহৃত হয়, তার শিকড় রামানুজনের কাজেই আছে।
রামানুজনের সূত্র এত নিখুঁত কেন?
অনিন্দ্য সিনহা ও তাঁর ছাত্র ফাইজান ভাট প্রশ্ন তুললেন—রামানুজনের সূত্র এত নিখুঁত কেন? তিনি কি কেবল গণিতকেই অনুসরণ করেছিলেন, নাকি এর পেছনে প্রকৃতির কোনো গভীর সত্য লুকিয়ে আছে? তাঁরা খোঁজ নিলেন কনফরমাল ফিল্ড থিওরি নামের একটি তত্ত্বে। এই তত্ত্ব বোঝায় এমন সিস্টেম, যেগুলোকে ছোট–বড় করা হলেও সিস্টেমের চেহারা একই থাকে।
এ ধরনের বৈশিষ্ট্যের বাস্তব উদাহরণ হলো—পানি ও বাষ্প যখন সংকটবিন্দুতে একই রকম লাগে; মাধ্যমে কিছুর ছড়িয়ে পড়া, অর্থাৎ পারকোলেশন; তরলে অস্থিরতার শুরু এবং ব্ল্যাকহোলের কিছু তাত্ত্বিক বর্ণনা
অনিন্দ্য ও ফাইজান দেখলেন, কনফরমাল ফিল্ড থিওরি তত্ত্বে রামানুজনের সূত্রগুলো স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসছে। অর্থাৎ শত বছর আগে রামানুজন যে সূত্র লিখেছিলেন, তা আজ মহাবিশ্ব বোঝার গণিতেও খাটছে।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে প্রভাব
রামানুজন শুধু যে পাইয়ের সূত্রই বের করেছেন তা নয়; বরং তিনি নিজের অজান্তে ব্ল্যাকহোল, টার্বুলেন্স আর মহাবিশ্বের গভীর রহস্যও ছুঁয়ে গিয়েছেন।
রামানুজন যেমন দ্রুত পাই বের করতে পারতেন, তেমনি তাঁর সূত্র ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এখন জটিল হিসাব অনেক সহজে করতে পারছেন। এর ফলে এখন তরলের অস্থিরতা বা টার্বুলেন্স বোঝা সহজ; পারকোলেশন বা মাধ্যমে কিছুর ছড়িয়ে পড়া বিশ্লেষণে সুবিধা; ব্ল্যাকহোলের কিছু বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যায় নতুন পথ এবং বড় বড় সমীকরণ সমাধানে সময় কম লাগছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, রামানুজনের শতবর্ষ পুরোনো সূত্র আধুনিক উচ্চ শক্তির পদার্থবিজ্ঞানের গণনাকে দ্রুত ও আরও সহজসাধ্য করতে নতুন প্রয়োগ দিতে পারে। তবে এর বাইরে সিনহা ও ভাট মূলত বিস্মিত হয়েছিলেন রামানুজনের গণিতের সৌন্দর্যে।
ফাইজান ভাট বলেন, সুন্দর গণিতের মধ্যে বাস্তব জগতের প্রতিচ্ছবি থাকে, যা ঠিক ওই গণিতকেই প্রতিফলিত করে।
আর অধ্যাপক অনিন্দ্য সিনহা বলেছেন, রামানুজন হয়তো জানতেন না, কিন্তু তিনি কেবল পাইয়ের সূত্র বের করেননি; তাঁর সূত্রে লুকিয়ে ছিল মহাবিশ্বের ভাষা, টার্বুলেন্স আর পারকোলেশনের মতো আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের গভীর রহস্য।
লেখা: রোহিনি সুব্রামানিয়াম, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স
সূত্র: ফিজ অর্গ।