উইন্ড টারবাইন আস্তে ঘুরেও কীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে
তুমি কি কখনো বড়সড় উইন্ড টারবাইন বা বায়ুকল দেখেছ? সরাসরি না দেখলেও টিভিতে হয়তো দেখেছো। সেই বিশাল পাখাগুলো যখন ঘোরে, তখন তোমার মনে হতেই পারে, আরে, এগুলো তো খুবই ধীরে ধীরে ঘুরছে। এতো আস্তে ঘুরে কীভাবে আবার বিদ্যুৎ তৈরি করে? দেখতে মনে হলেও আসলে এই ধীর গতির পেছনে লুকিয়ে আছে এক বিশাল বৈজ্ঞানিক কৌশল। এই টারবাইনগুলো কেবল বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করে। চলো জেনে নেওয়া যাক, এই বিশাল পাখাগুলো ধীরে ঘুরলেও কীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
টারবাইন বা বায়ুকল এখনকার দিনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ শক্তির উৎস। এই টারবাইনগুলো পরিবেশের জন্য খুবই ভালো। কারণ এরা কয়লা বা তেলের মতো ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস বাতাসে ছড়ায় না। এদের মূল কাজ বাতাসের শক্তিকে প্রথমে যান্ত্রিক শক্তিতে অর্থাৎ ঘূর্ণন শক্তিতে বদলানো। আর সেই যান্ত্রিক শক্তি থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করা।
একটি টারবাইনের প্রধানত তিনটি অংশ থাকে। প্রথমটি টাওয়ার। এটি লম্বা কাণ্ডের মতো অংশ যা মাটির সঙ্গে যুক্ত থাকে। দ্বিতীয়টি হলো ব্লেড ও রটার। তিনটি ব্লেড একটি কেন্দ্রীয় হাবের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই পুরো অংশটিকে রটার বলা হয়। তৃতীয়টি হলো ন্যাসেল। এটি একটি বাক্সের মতো অংশ। যা ব্লেডগুলোর ঠিক পিছনে থাকে এবং এর ভেতরে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী জেনারেটরটি রাখা থাকে।
অনেকেই উইন্ড টারবাইন বা বায়ুকলকে একটা ছোট উইন্ডমিলের মতো মনে করে। দূর থেকে বিশাল টারবাইন দেখতে ছোট মনে হলেও, আসলে এটি অনেক বড় একটি কাঠামো। মূলত, একটি উইন্ড টারবাইনের একেকটি পাখা বা ব্লেড প্রায় ৬০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। একটি মাঝারি আকারের যাত্রীবাহী বিমানের ডানার দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ৩০ মিটার। বোঝাই যাচ্ছে কত বড় ব্লেড। যদিও এতো বড় ব্লেড বানাতে হালকা ও মজবুত জিনিস ব্যবহার করা হয়, তবুও সেগুলোর ওজন কিন্তু কম না। সাধারণত, দশ টনেরও বেশি ওজনের এমন তিনটি বিশাল পাখাকে স্বাভাবিকভাবে ঘোরানোটা বেশ কষ্টসাধ্য।
এখন অনেকের মনে হতে পারে টারবাইনের পাখা যখন এতো বড় এবং ঘোরানো কঠিন, তবে এটিকে ছোট করা হয় না কেন? এর কারণ হলো বাতাস ধরার জায়গা। পাখা যত বড় হয়, সেটির ওপর বাতাস লাগার জায়গাও তত বেশি হয়। পাখা যদি খুব ছোট করে দেওয়া হয়, তবে এর ওপর কম বাতাস লাগবে এবং চাপও কম পড়বে। আর চাপ কম পড়লে জেনারেটরের মাধ্যমে যে বিদ্যুৎ তৈরি হয়, তার পরিমাণও অনেক কমে যায়। সহজ কথায়, বেশি বিদ্যুৎ তৈরি করার জন্যই পাখাগুলোকে এত বড় করে বানানো হয়।
যদি বেশি বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য ছোট পাখা ব্যবহার করে জেনারেটরের সংখ্যা বাড়ানো হয়, তবে তাতে তৈরির খরচ অনেক বেড়ে যাবে। অর্থাৎ, ছোট পাখা ব্যবহার করে একই পরিমাণ বিদ্যুৎ বানাতে গেলে উল্টো খরচ বেশি হবে। তাই, বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি করা ও খরচকে কমাতে মাঝারি থেকে বড় আকারের ব্লেড ব্যবহার করা হয়।
বাইরে থেকে টারবাইনের পাখাগুলো ধীরে ঘুরতে দেখা গেলেও, ভেতরে রয়েছে এক বিশেষ গিয়ারবক্স। পাখাগুলো যখন ঘোরে, তখন এরা ভেতরের একটি বিশাল গিয়ারকে ঘোরায়। আর সেই গিয়ারটি একটি ছোট গিয়ারকে চালায়। এই প্রক্রিয়ায় ঘূর্ণনের গতি অনেক গুণ বেড়ে যায়। ঠিক যেমন গাড়ির গিয়ার কাজ করে। ফলে পাখা ধীরে ঘুরলেও ভেতরের জেনারেটরটি খুব দ্রুত গতিতে ঘুরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
তবে, টারবাইনের তৈরি হওয়া শক্তি শুধু গতির ওপর নির্ভর করে না। বরং ঘোরানোর ক্ষমতা বা টর্কের ওপরও নির্ভর করে। পাখাগুলো ইচ্ছা করেই খুব দ্রুত ঘোরানো হয় না। কারণ এই বিশাল পাখাগুলো দ্রুত ঘুরলে যে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়, তাতে পাখাগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই, যখন বাতাস খুব তীব্র হয়, তখন টারবাইনটি পাখা রক্ষা করার জন্য নিরাপত্তা মোড চালু করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।
টারবাইনের পাখাগুলো খুব জোরে ঘুরলে কিন্তু আসলে বিদ্যুৎ তৈরির দক্ষতা কমে আসে। এর কারণ হলো, পাখা ঘোরার সময় বাতাসের পথে বাধা সৃষ্টি করে। গতি বাড়লে এই বাধাও বাড়ে, ফলে বাতাসের শক্তিকে আর ভালোভাবে কাজে লাগানো যায় না। যদি পাখা অসম্ভব দ্রুত ঘোরে, তবে তা বাতাসকে আটকে দেওয়া একটি বোর্ডের মতো কাজ করবে। ফলে বাতাসের শক্তি ব্যবহারের হার হবে প্রায় শূন্য। অন্যদিকে, পাখা যদি না ঘোরে তবে কোনো বিদ্যুৎই তৈরি হবে না। এতো কিছু বিবেচনা করেই বিজ্ঞানীরা এই সর্বোত্তম গতিটি ঠিক করেছেন। যাতে টারবাইনটি নিরাপদ থাকে এবং এর ক্ষমতার সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স, ইনভার্টার, হাউ স্টাফ ওয়ার্কস