জেলিফিশের জন্য বন্ধ হয়ে গেল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

পাম্পিং স্টেশন এই শীতলীকরণ ব্যবস্থার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

সম্প্রতি ইউরোপের একটি বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশাল আকারের জেলিফিশের ঝাঁক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির শীতলীকরণ ব্যবস্থায় ঢুকে পড়ায় এর কার্যক্রম আংশিকভাবে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ।

প্ল্যান্ট পরিচালনাকারী সংস্থা ইলেকট্রিসিটি অব ফ্রান্স (ইডিএফ) জানিয়েছে, ‘উত্তর ফ্রান্সের গ্রেভলাইনস পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিশাল সংখ্যক জেলিফিশের অপ্রত্যাশিত উপস্থিতির কারণে ছয়টি চুল্লির মধ্যে তিনটি রবিবার মধ্যরাতের ঠিক আগে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।’ সংস্থাটি আরও জানায়, ‘চতুর্থ চুল্লিটি গত ১১ আগস্ট সোমবার ভোরে বন্ধ করা হয়েছে।’

জেলিফিশ মূলত ঝাঁক বেধে চলে। যখন অনুকূল তাপমাত্রা, সঠিক পরিমাণে পুষ্টি উপাদান এবং কম শিকারি থাকে তখন জেলিফিশের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে সেই অঞ্চলে। অনেক সময় এরা বিশাল ঝাঁক তৈরি করে। এই ঝাঁকগুলোতে লাখ লাখ জেলিফিশ থাকতে পারে।

আরও পড়ুন

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পাম্পিং স্টেশনের মূল কাজ হলো শীতলীকরণ ব্যবস্থা (Cooling System) সচল রাখা। এটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রচুর পরিমাণে তাপ উৎপন্ন হয়। এই তাপ দিয়ে পানিকে বাষ্পে রূপান্তরিত করা হয়, যা টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করে। টারবাইন ঘোরানোর পর এই বাষ্পকে আবার পানিতে পরিণত করতে হয়, যাতে তাকে পুনরায় ব্যবহার করা যায়। এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার জন্যই শীতলীকরণ ব্যবস্থা।

পাম্পিং স্টেশন এই শীতলীকরণ ব্যবস্থার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। এটি সমুদ্র, নদী বা হ্রদের মতো কোনো নিকটবর্তী উৎস থেকে বিশাল পরিমাণে পানি টেনে আনে। এই পানি চুল্লির ভেতরের বাষ্পকে ঠান্ডা করে আবার তরল অবস্থায় ফিরিয়ে আনে। যদি কোনো কারণে এই পাম্পিং স্টেশন কাজ করা বন্ধ করে দেয় তাহলে শীতলীকরণের প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যায়। এতে চুল্লির তাপমাত্রা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যেতে পারে, যা বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।

প্রায় ৫০ লাখ বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ইডিএফ-এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জেলিফিশগুলো প্ল্যান্টের অ-পারমাণবিক অংশের পাম্পিং স্টেশনের ফিল্টার ড্রামে জমা হয়। তবে এর ফলে প্ল্যান্টের নিরাপত্তা ও পরিবেশের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি।

আরও পড়ুন
বিশ্বজুড়ে অনেক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র জেলিফিশের ঝাঁক দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে
ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

ইডিএফ জানিয়েছে, চুল্লি বন্ধ করে দেওয়াটা বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্বাভাবিক নিরাপত্তাব্যবস্থারই অংশ ছিল এবং কর্মীরা এখন সেগুলোকে নিরাপদে পুনরায় চালু করার চেষ্টা করছেন। কোম্পানিটি এই বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।

আমেরিকান সোসাইটি অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্সের মতে, উত্তর সাগরের ধারে অবস্থিত এই প্ল্যান্টের কুলিং টাওয়ার থেকে আসা উষ্ণ পানি ব্যবহার করে একটি বাণিজ্যিক মাছের খামার পরিচালিত হয়। তবে এই উষ্ণ পানির তাপমাত্রার সঙ্গেই বিশাল জেলিফিশের উপস্থিতির যোগসূত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

যদিও জেলিফিশের শরীরের ৯৫ শতাংশই পানি, তবুও এদের বিশাল ঝাঁক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে। কারণ এই ঝাঁকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের শীতলীকরণ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়।

আরও পড়ুন

ওশেনিক ইনভার্টেব্রেট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জানিয়েছে, অতিরিক্ত মাছ ধরা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং উপকূলীয় অঞ্চলের উন্নয়নের কারণে জেলিফিশের সংখ্যা এখন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি বর্তমানে একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। বিশ্বজুড়ে অনেক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র জেলিফিশের ঝাঁক দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। ২০১১ সালে ইসরায়েল, জাপান এবং স্কটল্যান্ডের প্ল্যান্টগুলোতে জেলিফিশের কারণে কাজ বন্ধ ছিল। ২০১৩ সালে সুইডেনের একটি চুল্লিও জেলিফিশের আক্রমণের কারণে অচল হয়ে গিয়েছিল।

গতবছর সেপ্টেম্বরে পূর্ব চীনের বৃহত্তম কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের শীতলীকরণ ব্যবস্থায় বিশাল সংখ্যক জেলিফিশের প্রবেশ ঘটে। এর ফলে কর্মীদের প্রায় ১০ দিন ধরে ১৫০ টনেরও বেশি জেলিফিশ পরিষ্কার করতে হয়েছে।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস

আরও পড়ুন