আমরাই কি শেষ প্রজন্ম যারা জোনাকি পোকা দেখেছি?
কয়েকদিন আগে গাজীপুরের কাশিমপুরে গিয়ে আমি রীতিমতো অবাক হয়েছি। মূল রাস্তার ধারে একটি অন্ধকার, বেশ ঝোপঝাড়ে ভরা জায়গায় হাজার হাজার জোনাকি জ্বলছে আর নিভছে। চারপাশে জোনাকি পোকার বিলুপ্তির কথা শুনে আসছি, তাই অবাক হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ, কতদিন জোনাকি দেখি না! এই শহরে জোনাকি পোকা এল কোথা থেকে?
একসময় গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় গ্রামে গেলে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি দেখতাম। এমনকি শহরের আশপাশের এলাকাতেও এদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ছোটবেলায় মশারির ভেতরে জোনাকি ধরে এনে আটকে রেখেছি। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম, জোনাকিগুলো কি এখনো জ্বলছে? বেশিরভাগ সময়েই নিভে যাওয়া বা মরে যাওয়া জোনাকি দেখতাম। তখন বুঝতে পারিনি, জোনাকি আমাদের চারপাশ থেকে হারিয়ে যাবে। এখন এই স্মৃতি ছোটদের মধ্যে তৈরি হওয়ার সুযোগ নেই। এখন খুব সহজে জোনাকি দেখা যায় না। কারণ প্রকৃতির এই জাদুকরী পোকাগুলো আমাদের চারপাশ থেকে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, পরিবেশ-প্রকৃতি যেভাবে ধ্বংস হচ্ছে, তাতে জোনাকির টিকে থাকায় ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, আমরাই হয়তো শেষ প্রজন্ম, যারা জোনাকি পোকার আলো দেখেছি।
জোনাকিদের জীবন বিপন্ন হওয়ার কারণ
জোনাকি পোকা বা ‘ফায়ারফ্লাই’ হলো বিটলজাতীয় একটি পোকা, যাদের টিকে থাকার জন্য কিছু নির্দিষ্ট পরিবেশগত শর্ত দরকার পড়ে—যেমন পরিষ্কার পানি, ভেজা মাটি এবং অন্ধকার, শান্ত রাত। নগরায়ন, দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব পরিবেশ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
জোনাকি নিয়ে একটা তথ্য জেনে রাখা উচিত। এটি দিয়ে জোনাকিদের আরও ভালো চেনা যাবে। জোনাকিদের মধ্যে ছেলে জোনাকি পাঁচ সেকেন্ডে একবার পুচ্ছ জ্বালে। আর মেয়ে জোনাকিরা প্রতি দুই সেকেন্ডে একবার জ্বালে। তো জোনাকি দেখলে এখন বুঝতে পারবে জোনাকিটা ছেলে নাকি মেয়ে।
চারদিকে এত আলো
শহরের রাস্তা, বিলবোর্ড, ঘরের বাতি, যানবাহনের লাইট—আলোর কোনো অভাব নেই। যেখানে মানুষ আছে, সেখানেই এখন কৃত্রিম আলোর ছড়াছড়ি। এই অতিরিক্ত কৃত্রিম আলো জোনাকি পোকার প্রজননে সবচেয়ে বড় বাধা। জোনাকিরা নিজেদের সঙ্গীকে আকৃষ্ট করতে যে জৈব আলো তৈরি করে, সেই সংকেত কৃত্রিম আলোর নিচে চাপা পড়ে যায়। বায়োসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় জানা গেছে, রাতের অতিরিক্ত আলোই জোনাকি পোকার প্রজননে বাধার অন্যতম প্রধান কারণ।
একইভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে দ্রুত বনভূমি উজাড় হচ্ছে এবং জলাভূমি ভরাট করা হচ্ছে। জোনাকি পোকার প্রাকৃতিক বাসস্থানগুলো এভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এরা ভেজা, ছায়াযুক্ত জায়গায় থাকতে পছন্দ করে। বাসস্থান ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এরা আর টিকে থাকতে পারছে না।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূষণের প্রভাব
জোনাকি পোকার লার্ভা ভেজা মাটিতে থাকে এবং ছোট শামুকসহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গ খেয়ে বড় হয়। কিন্তু কৃষিকাজে ব্যবহৃত কীটনাশক এবং শহরে মশা মারার জন্য ফগিং, এই দুই মিলে জোনাকি পোকা এবং এদের খাবারের উৎস ধ্বংস করে। তাই তুমি ধানখেতে এদের খুব বেশি দেখবে না। কারণ এখানে প্রচুর রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এছাড়া পানি ও মাটির দূষণ এদের পরিবেশকে প্রায় বসবাসের অনুপযোগী করে তুলেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন জোনাকিদের জীবনচক্রের জন্য একটি বড় হুমকি। খরা, হঠাৎ বন্যা এবং তাপমাত্রার পরিবর্তন তাদের প্রজনন প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়। কিছু প্রজাতির ডিম ফোটার জন্য একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার প্রয়োজন হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক জায়গায় আর পাওয়া যায় না।
জোনাকি পোকার কেন টিকে থাকা দরকার
জোনাকি পোকা শুধু আমাদের শৈশবকে রঙিন করে না, এর টিকে থাকা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্যও জরুরি। লার্ভা অবস্থায় তারা শিকারী হিসেবে কাজ করে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। যদি তারা প্রকৃতিতে না থাকে, তবে অন্য ক্ষতিকর পোকা বেড়ে যেতে পারে।
তবে আশার কথা হলো, কিছু গবেষক মনে করেন, আমরাই জোনাকির আলো দেখার শেষ প্রজন্ম—এমনটা নাও হতে পারে। বরং আমাদের পরেও বহু প্রজন্ম জোনাকি দেখতে পাবে, তাদের নিয়ে গান গাইবে বা কবিতা লিখবে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু গবেষকের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কিছু অঞ্চলে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় জোনাকি পোকার সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। আমাদের দেশেও প্রচুর বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি এলে ঘাস ও লতাপাতা দ্রুত বাড়ে। ভেজা বা আর্দ্র পরিবেশ পেলে জোনাকি পোকারা অনুকূল অবস্থা ফিরে পায়। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, অনুকূল পরিবেশ পেলে জোনাকির সংখ্যা আবার বাড়তে পারে।
এখন আমাদের করণীয় কী?
জোনাকি পোকাকে বাঁচাতে হলে আমাদের সবারই কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত বনজ পরিবেশ ধ্বংস করা যাবে না। ঝোপঝাড় রক্ষা করতে হবে। দ্বিতীয়ত জলবায়ু পরিবর্তন থেকে জীবজগতকে রক্ষা করার জন্য কাজ করতে হবে। রাতে অপ্রয়োজনীয় বাতি নিভিয়ে রাখা, অতিরিক্ত রাসায়নিক বা কীটনাশক ব্যবহার না করা, এবং ঝরা পাতা কুড়িয়ে পরিষ্কার না করে সেগুলোকে প্রকৃতিতে মিশে যেতে দেওয়া, এসব ছোট ছোট পদক্ষেপও জোনাকি পোকাকে রক্ষা করতে পারে।
আমাদের জলাভূমি, নদীর তীর এবং বনভূমি রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জোনাকি পোকারা টিকে থাকলে আমাদের পরিবেশও রক্ষা হবে। দিনশেষে এর উপকার হবে আমাদেরই।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান ও দ্য ডেইলি স্টার