বিজ্ঞানীরা জীবন্ত মগজের মডেল তৈরি করেছেন, সম্ভাবনা অনন্ত
বিশ্বের দ্রুততম সুপারকম্পিউটারগুলোর একটি রাখা আছে জাপানের কোবে শহরের কৃত্রিম এক দ্বীপে। কম্পিউটারটির নাম ফুগাকু। এই সুপারকম্পিউটারের ভেতরে বিজ্ঞানীরা চালু করেছেন এক অভিনব মডেল। ইঁদুরের সেরিব্রাল কর্টেক্স বা মস্তিষ্কের বহির্ভাগের ডিজিটাল রূপ তৈরি করা হয়েছে এই কম্পিউটারে।
এই মডেলে প্রায় এক কোটি কৃত্রিম নিউরন আছে। যার মধ্যে আছে কোটি কোটি সংযোগ। ঠিক জীবন্ত মস্তিষ্কের মতোই নিউরনগুলোতে বৈদ্যুতিক সংকেত ছুটে বেড়ায়। সিদ্ধান্ত নেওয়া বা অনুভূতি তৈরি হওয়ার মতো কার্যকলাপও এখানে দেখা যায়। সব কিছুই ঘটে কম্পিউটারের ভেতরে।
এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, একটি সম্পূর্ণ সেরিব্রাল কর্টেক্স কম্পিউটারে ডিজিটালি তৈরি করা সম্ভব। শুধু মস্তিষ্কের গঠন না, নিউরনের বৈদ্যুতিক আচরণও এতে যুক্ত করা হয়েছে। মানে এটি কেবল একটি থ্রিডি ছবি না। জীববিজ্ঞানের নিয়ম মেনে চলা একটি বাস্তবসম্মত সিমুলেশন।
এই কাজে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালেন ইনস্টিটিউটের জীববৈজ্ঞানিক মানচিত্র। কর্টেক্সের স্তর ধরে ধরে কোষের ধরন অনুযায়ী পুরো কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। পরে জাপানের ফুগাকু সুপারকম্পিউটারে এটি চালু করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা এর ভিজ্যুয়াল উপস্থাপন তৈরি করেছেন। ফলে বিজ্ঞানীরা নিউরনের সিনাপস পর্যন্ত জুম করে দেখতে পারেন।
এই গবেষণার একজন সহলেখক অ্যান্টন আরখিপভ। তিনি বলেছেন, সবচেয়ে বড় সাফল্য শুধু এর আকার না। আসল বিষয় হলো মস্তিষ্কের প্রকৃত জৈব সংযোগ ঠিকভাবে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। কোন কোষ আরেকটি কোষের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং কীভাবে পুরো কর্টেক্সে কার্যকলাপ ছড়িয়ে পড়ে, এখানে সেটা জানা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ছোট মডেল অনেক সময় ভুল ফল দেখাতে পারে।
এই ডিজিটাল কর্টেক্স চালু করলে এটি অস্বাভাবিক আচরণ করে না। একেবারে চুপও হয়ে যায় না। জীবন্ত ইঁদুরের মস্তিষ্কের মতো স্থিতিশীল ছন্দে কাজ করে। এতে বোঝা যায়, মডেলটি শুধু দেখতে নয়, আচরণেও বাস্তবের কাছাকাছি।
এই প্রযুক্তি এখনই ব্যবহার করা হতে পারে রোগের গবেষণায়। আলঝেইমার এপিলেপসি বা ভুলে যাওয়া রোগ। আবার অটিজমের মতো রোগে মস্তিষ্কের সংযোগ ধীরে ধীরে বদলে যায়। বাস্তবে এই পরিবর্তন শুরুতেই ধরা পড়ে না। কিন্তু ডিজিটাল মডেলে এসব পরিবর্তন বসিয়ে দেখা যায়, ঠিক কী প্রভাব পড়ে। কোন পরিবর্তন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা আগেই বোঝা সম্ভব হতে পারে।
তবে বিজ্ঞানীরা আরও বড় কিছু নিয়ে ভাবছেন। চেতনা কোথা থেকে আসে, সচেতনতা কীভাবে তৈরি হয় তা জানতে চান তাঁরা। আরখিপভ মনে করেন, এই ধরনের বাস্তবসম্মত মডেল একদিন এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাহায্য করতে পারে।
তিনি বলেন, ‘মস্তিষ্কের সব প্রক্রিয়াই আসলে ভৌত প্রক্রিয়া। তাই তাত্ত্বিকভাবে সিলিকনের যন্ত্রেও চিন্তা বা অনুভূতি তৈরি হওয়া অসম্ভব নয়। তবে তিনি এটাও বলেন, সব ধরনের হার্ডওয়্যারে চেতনা থাকা সম্ভব হতে পারে না। একই রকম কার্যকলাপ দেখা গেলেও সব যন্ত্রে সচেতন অভিজ্ঞতা তৈরি নাও হতে পারে।’
এই বিষয়ে অন্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে সন্দেহ আছে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক পিটার কপোলা বলেন, ‘চেতনা মাপার কোনো নিশ্চিত উপায় আমাদের নেই। কোনো মডেল সত্যিই কিছু অনুভব করছে কি না, তা বোঝার পরীক্ষা এখনো নেই। শরীর এবং কর্টেক্সের নিচের অংশ ছাড়া পূর্ণ চেতনা সম্ভব কি না, সেটিও বড় প্রশ্ন।’
এই ডিজিটাল মডেলেও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন শেখার ক্ষমতা বা নিউরনের রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এখনো পুরোপুরি যুক্ত হয়নি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘এটি এখনো একটি ধারণার প্রমাণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।’
তবুও এই কাজটি মস্তিষ্ক বোঝার পথে একটি বড় ধাপ। আপাতত এর লক্ষ্য, রোগের ধরণ বোঝা এবং চিকিৎসা উন্নত করা।
সূত্র: পপুলার মেকানিকস