বেঁচে থাকার জন্য ১৭ শতক কেন সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল

ইতিহাসের পাতায় ১৬-১৭ শতক মানেই বিভীষিকা। হাড়কাঁপানো লিটল আইস এজ, সূর্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ভাগ্য আর কুসংস্কারের বলি হওয়া হাজারো মানুষ যেন নরকবাস করছিল। কেন এই সময়টা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য অধ্যায়?

ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস যুদ্ধ থার্টি ইয়ার্স ওয়ারওয়েলকাম কালেকশন

আমাদের অনেকেরই একটা বিষয় নিয়ে কিছুটা আফসোস আছে। সেটি হলো, আমরা যদি আগে জন্মাতাম! রাজা-বাদশাহদের যুগ, তলোয়ারবাজি আর দূষণমুক্ত পরিবেশ! কিন্তু বিশ্বাস করো, তুমি যদি ১৬-১৭ শতকের মধ্যে জন্মাতে, তাহলে তোমার জীবন হয়তো বিভীষিকায় পরিণত হতো। কেন বলছি এ কথা?

ইতিহাসবিদেরা এই সময়টাকে বলেন দ্য জেনারেল ক্রাইসিস। বাংলায় একে সর্বজনীন সংকট বলতে পারো। শুনতে খুব ভারিক্কি মনে হলেও সহজ কথায় এর মানে হলো, পৃথিবীর ইতিহাসে এর চেয়ে জঘন্য সময় খুব কমই এসেছে। যুদ্ধ, মহামারি, দুর্ভিক্ষ আর হাড়কাঁপানো আবহাওয়া পৃথিবীটাকে তখন নরক বানিয়ে ফেলেছিল। কেন এই শতাব্দী এত ভয়ংকর ছিল? চলো, একটু ঘেঁটে দেখা যাক।

সপ্তদশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ভিলেন কোনো রাজা বা সেনাপতি ছিলেন না, ছিল আবহাওয়া। পৃথিবী তখন এক অদ্ভুত জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। বিজ্ঞানীরা একে বলেন লিটল আইস এজ। সূর্য যেন হঠাৎ করেই ছুটি নিয়েছিল। ১৬৪৫ থেকে ১৭১৫ সাল পর্যন্ত সূর্যের উপরিভাগে সৌরকলঙ্ক প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। ফলে পৃথিবী তেমন তাপ পায়নি। এর ফলাফল ছিল ভয়াবহ। ইউরোপের টেমস বা দানিউবের মতো বড় বড় নদী শীতে পুরোপুরি জমে বরফ হয়ে যেত। লন্ডনে টেমস নদীর ওপর বরফের আস্তরণ এত পুরু হতো যে তার ওপর রীতিমতো মেলা বসতো, দোকানপাট চলত!

আরও পড়ুন

শুনতে রোমাঞ্চকর মনে হলেও এর পেছনের বাস্তবতা ছিল করুণ। অতিরিক্ত শীতে ফসল ফলত না। গবাদিপশু জমে মরে যেত। আর ফসল না থাকা মানেই তো দুর্ভিক্ষ।

স্কটল্যান্ড থেকে শুরু করে জাপান পর্যন্ত মানুষ তখন বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার জ্বালায় হাহাকার করেছে। ফ্রান্সে খাদ্যের অভাবে মানুষ এত দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে মহামারির ধাক্কা সামলানোর শক্তিও তাদের ছিল না। ক্ষুধার্ত মানুষের মেজাজ এমনিতেই খিটখিটে থাকে, তার ওপর যদি শুরু হয় ধর্ম আর ক্ষমতার লড়াই, তবে তো কথাই নেই। এই শতকেই ইউরোপ দেখেছিল ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস যুদ্ধ থার্টি ইয়ার্স ওয়ার। নাম শুনেই বোঝা যায়, ৩০ বছর ধরে চলেছিল এই যুদ্ধ। ১৬১৮ সালে শুরু হয়ে শেষ হয় ১৬৪৮ সালে।

নামে ৩০ বছরের যুদ্ধ হলেও এর প্রভাব ছিল কয়েক প্রজন্ম ধরে। এই যুদ্ধে মধ্য ইউরোপের, বিশেষ করে জার্মানির অবস্থা এমন হয়েছিল যে কিছু কিছু এলাকার জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছিল। ইতিহাসবিদদের মতে, এই যুদ্ধে জার্মানির প্রায় ২০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষ মারা গিয়েছিল, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনুপাতের চেয়েও বেশি! সেনারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিত, লুটতরাজ করত। আর যুদ্ধের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছড়াত প্লেগ।

আরও পড়ুন

শুধু ইউরোপ নয়, এশিয়ায় তখন চলছিল মিং রাজবংশের পতন আর কুইং রাজবংশের উত্থানের রক্তক্ষয়ী লড়াই। চীনে এই ক্ষমতার পালাবদলে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। মানুষ যখন প্রকৃতি বা যুদ্ধের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে, তখন সে বলির পাঁঠা খুঁজতে থাকে। সপ্তদশ শতাব্দীতে এই বলির পাঁঠা হয়েছিলেন নিরীহ নারীরা।

ধরো, আবহাওয়া খারাপ, দোষ গিয়ে পড়ত গ্রামের কোনো বুড়ির ওপর! ফসল হচ্ছে না? ওই নারী নিশ্চয়ই কালোজাদু করেছে! এই কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে ইউরোপ এবং আমেরিকায় হাজার হাজার নারীকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে জ্যান্ত পুড়িয়ে বা পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল।

সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো, এই পাগলামিটা তখন সরকারি এবং ধর্মীয়ভাবে স্বীকৃত ছিল। ম্যাথিউ হপকিন্স নামে এক কুখ্যাত উইচফাইন্ডার জেনারেল একাই ইংল্যান্ডে শত শত নারীকে হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন। প্রতিবেশীর ওপর সন্দেহ আর অবিশ্বাস এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে কেউ নিরাপদ ছিল না। কারও চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ একটু বিড়বিড় করলেই হয়তো তাকে ডাইনি ভেবে বিচারকের হাতে তুলে দেওয়া হতো!

আরও পড়ুন

বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার এই সময়টা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘প্রকৃতি তখন আমাদের ধ্বংস করতে চাইছিল, আর মানুষেরা একে অপরকে ধ্বংস করার জন্য জোট বেঁধেছিল।’

এখন হয়তো আমাদের ইন্টারনেটের স্পিড একটু কম হলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়; কিন্তু সেই সময়ের কথা একটু চিন্তা করো। তাদের ঘরের ছাদ ফুটো, বাইরে হাড়কাঁপানো তুষারপাত, ঘরে খাবার নেই, পাশের গ্রামে যুদ্ধ চলছে, কারও স্ত্রীকে হয়তো গ্রামের মোড়লরা ডাইনি সন্দেহে খুঁজছে! সেই তুলনায়, আমাদের এই বর্তমান সময়টা কিন্তু মন্দ না, কী বলো?

সূত্র: আইএফএল সায়েন্স, ব্রিটানিকা এবং হিস্ট্রি ডটকম

আরও পড়ুন