পৃথিবীর সবচেয়ে ধীরগতির প্রাণী কোনগুলো

একটা পাতা হজম করতে স্লথের কয়েক দিন লেগে যায়ছবি: গেটি ইমেজেস

গতির কথা উঠলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে চিতা বা বাজপাখির কথা। দৌড়ে এদের সঙ্গে টক্কর দেওয়া শুধু মুশকিলই নয়; প্রায় অসম্ভব। কে কত দ্রুত যেতে পারে, তা নিয়ে আমাদের আগ্রহের শেষ নেই; কিন্তু কখনো উল্টোটা ভেবে দেখেছ? মানে ধীরগতির কথা বলছি আরকি। বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির প্রাণীটির কথা কখনো ভেবেছ? সবচেয়ে ধীরগতির প্রাণীটা আসলে কতটা ধীর? ঘণ্টায় ওরা কতটা পথ পাড়ি দিতে পারে? চলো, আজ পৃথিবীর অলস প্রাণীদের রাজ্য থেকে ঘুরে আসা যাক।

তবে ওই রাজ্যে যাওয়ার আগে একটি কথা বলে রাখি। আমরা যাদের অলস বলছি, ওরা কিন্তু আসলে অলস নয়। ওই গতিই ওদের জীবনের আসল ছন্দ। জেমস ম্যাকলেইন নামের একজন বিজ্ঞানী আছেন। তিনি যেমন বলেন, ‘আমরা ধরেই নিই যে গতি মানেই ভালো; কিন্তু অনেক প্রাণীর কাছে এ ধারণার কোনো মানেই নেই।’

তাই ধীরগতির প্রাণীদের গল্প শুনে হেসো না যেন। আমাদের কাছে যেমন গতি মানেই ভালো, ওদের কাছে তা না–ও হতে পারে। এমনকি উল্টোটাও হতে পারে। মানে ওদের মধ্যে ধীরগতির প্রতিযোগিতাও তো হতে পারে! যাহোক, এবার মূল প্রশ্নের উত্তরে যাই।

আরও পড়ুন

পৃথিবীর সবচেয়ে ধীরগতির প্রাণী কোনটি? প্রথমেই পানির তলা থেকে শুরু করি। অবশ্য এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া একটু মুশকিল আছে। কারণ, গতি মাপার বিভিন্ন উপায় আছে। যদি আমরা ধরে নিই, একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব যেতে কার কত সময় লাগে, তাহলে সম্ভবত সবচেয়ে ধীরগতির প্রাণী হবে সি অ্যানিমোন। দেখতে অনেকটা ফুলের মতো। এই সামুদ্রিক প্রাণী যখন নতুন বাড়ির খোঁজে বের হয়, তখন সে এক ঘণ্টায় মাত্র ৪ থেকে ৬ ইঞ্চি এগোতে পারে! বাকি সময়টা সে এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে। এই গতি কতটা ধীর তা কি বুঝতে পারছ? তুমি যদি ওদের গতিতে হাঁটো, তাহলে ঘণ্টায় হয়তো তোমার স্কেলটার সমান দূরত্ব হাঁটতে পারবে। নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত লাগবে তাই না?

তবে শুধু এই প্রাণীটাই পানির তলের ধীর প্রাণী নয়। তালিকার পরের নামটি হলো বামন সি-হর্স। এই খুদে সি-হর্সকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ধীরগতির সাঁতারু। কারণ, এরা খাড়া হয়ে সাঁতার কাটে। তা ছাড়া এদের পিঠের ছোট্ট পাখনায় তেমন জোর নেই। মাত্র দেড় মিটার সাঁতার কাটতে এদের লাগে প্রায় এক ঘণ্টা!

আরও পড়ুন

তবে এই ধীরগতির কারণে ওদের লাভই হয়। সি-হর্স তার লম্বা লেজ দিয়ে সমুদ্রের ঘাস বা শেওলা আঁকড়ে ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়। ফলে ওদের খাবার, মানে ছোট ছোট জলজ পোকা নিজে থেকেই ওদের কাছে ভেসে আসে। তাই খাবারের জন্য ছোটাছুটির কোনো দরকারই হয় না। তা ছাড়া, ওদের শরীর শক্ত হাড়ের মতো প্লেট দিয়ে ঢাকা থাকে। এতে শিকারি প্রাণীদের কবল থেকেও বেঁচে যায়। ফলে পালিয়ে যাওয়ার জন্যও ছুটতে হয় না। তাহলে এত তাড়াহুড়া করে ওদের লাভ কী বলো!

তবে সি-হর্স জীবনে একবারই একটু দ্রুত ছোটে। আর এ কাজটা করতে হয় সঙ্গী খোঁজার সময়। এ সময় ওরা একে অপরের সঙ্গে নাচে। এই নাচ ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলতে পারে। এটাই ওদের জীবনের সবচেয়ে বড় নড়াচড়া! সঙ্গী বাছাই হয়ে গেলে ওদের জীবন আবার আগের ছন্দে ফিরে আসে।

সমুদ্রের আরও গভীরে গেলে দেখা মিলবে গ্রিনল্যান্ড শার্কের। প্রায় ২৪ ফুট লম্বা এই বিশাল হাঙর বরফশীতল পানিতে ভেসে বেড়ায় অলসভাবে। যেন ওদের জীবনে অলস সময় কাঠানো ছাড়া আর কোনো কাজই নেই! ঘণ্টায় মাত্র তিন কিলোমিটার গতিতে এরা চলাফেরা করে। এরা মূলত মরা প্রাণীর দেহাবশেষ খেয়ে বেঁচে থাকে। আর মৃত প্রাণী তো আর দৌড়ে পালায় না, তাই ওদেরও দ্রুত ছোটার দরকার হয় না। আর ওদের যা দেহ, খুব অল্প প্রাণীও ওদের শিকার করার সাহস করবে!

আরও পড়ুন
ডাঙার ধীর প্রাণীদের তালিকায় আছে গ্যালাপাগোস কচ্ছপ
ছবি: গেটি ইমেজেস

এবার ডাঙার কথায় আসা যাক। এখানকার সবচেয়ে ধীরগতির প্রাণী হতে পারে বানানা স্লাগ। কলা দেখে যেমনটা মনে হয়—হলদে আর পিচ্ছিল, ওদের দেখতেও অনেকটা সে রকম। এরা ঘণ্টায় মাত্র ০.০০৯৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়।

শামুক বা স্লাগের মতো মলাস্কা পর্বের প্রাণীরা সাধারণত ধীরগতিরই হয়। যেমন আমাদের অতি পরিচিত বাগানের শামুক ঘণ্টায় ০.০৪৮ কিলোমিটার বেগে চলে। বানানা স্লাগের চেয়ে এই গতি একটু বেশি। মজার ব্যাপার হলো, মশা-মাছির মতো ছোট পোকারা কিন্তু এদের চেয়ে অনেক দ্রুত ছুটতে পারে।

ডাঙার ধীর প্রাণীদের তালিকায় আছে গ্যালাপাগোস কচ্ছপ। এই বিশাল কচ্ছপ ঘণ্টায় মাত্র ০.২৬ কিলোমিটার বেগে হাঁটে। তুমি যদি হেঁটে এক ঘণ্টায় ২৬ কিলোমিটার যাও, তাহলে এই কচ্ছপ ওই সময়ের মধ্যে যাবে মাত্র এক কিলোমিটার। বোঝো এদের হাঁটার গতি!

স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে ধীর হলো গাছের বাসিন্দারা। যেমন স্লো লোরিস। নামের মধ্যেই যেন এদের পরিচয় লুকিয়ে আছে। এই ছোট্ট প্রাণীটি খুব সাবধানে, ধীরে ধীরে গাছের ডালে ঘুরে বেড়ায়। ওদের বড় বড় চোখ দিয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে এত ধীরগতিতে চলে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মনে হবে, ওরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। যদিও এরা ঘণ্টায় প্রায় ১.৮ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে।

আরও পড়ুন

তাহলে প্রশ্ন হলো, ধীরগতির চ্যাম্পিয়নশিপ হলে, সেরার মুকুট উঠবে কার মাথায়? এখানে আরেকটা প্রশ্ন থেকে যায়। গতি মাপার কি আর কোনো উপায় নেই? অনেক বিজ্ঞানী বলেন, প্রাণীর শরীরের আকারের সঙ্গে তার গতি তুলনা করা উচিত। যেমন একটি পিঁপড়া এক সেকেন্ডে যতটুকু যায়, তা তার শরীরের আকারের তুলনায় অনেক বেশি। সেই হিসেবে পিঁপড়া মানুষের চেয়ে দ্রুত চলাচল করে। এসব দিক বিবেচনা করলে সবচেয়ে ধীরগতির প্রাণী হলো থ্রি-টোড স্লথ।

স্লথ শুধু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেই সময় নেয় না; বরং ওদের জীবনের প্রতিটি কাজই হয় অত্যন্ত ধীরগতিতে। আর ওদের এই ধীরগতির পেছনে অনেক কারণ আছে। প্রথমত, আত্মরক্ষা। স্লথ দৌড়ে পালাতে পারে না, তাই ওরা ছদ্মবেশ ধারণ করে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। দ্বিতীয়ত, ধীরগতির হলেও স্লথ কিন্তু মানুষের চেয়ে তিন গুণ বেশি শক্তিশালী। এই শক্তি দিয়েই ওরা গাছের ডালে ভালোভাবে ঝুলে থাকতে পারে। তা ছাড়া এদের হজম প্রক্রিয়া অনেক ধীর। স্লথের ধীরগতির আসল রহস্য হলো এর মেটাবলিজম বা হজমপ্রক্রিয়া। এরা মূলত গাছের পাতা খায়, যাতে খুব কম শক্তি থাকে। এই অল্প শক্তি দিয়ে টিকে থাকার জন্য সে সবকিছুই খুব ধীরে করে। একটা পাতা হজম করতে স্লথের কয়েক দিন লেগে যায়! আর সপ্তাহে মাত্র একবার ওরা মলত্যাগের জন্য গাছ থেকে নিচে নামে। এই ধীরগতির জন্যই স্লথ এখনো ভালোভাবে টিকে আছে।

তাহলে মূল কথা হলো, শরীরের সঙ্গে বিবেচনা না করলে জলে ও স্থলে আলাদা ধীরগতির প্রাণী পাওয়া যাবে। তবে ওপরে আমরা শুধু দূরত্বের হিসেবে পানি ও ডাঙার প্রাণী নিয়ে আলোচনা করেছি। আর দেহের তুলনায় ধীরগতির কথা এগিয়ে থাকবে স্লথই!

সূত্র: লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুন