বিজ্ঞানীরা ‘ভয়াবহ’ জিনিস খুঁজে পেয়েছেন অ্যান্টার্কটিকার সাগরতলে
অ্যান্টার্কটিকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঠান্ডা, শুষ্ক ও দুর্গম মহাদেশ। এই মহাদেশের সৌন্দর্য ও রহস্যময়তা মানুষকে সব সময় আকৃষ্ট করেছে। তাই বিজ্ঞানীরা সব সময়ই এই শীতল মহাদেশের দিকে লক্ষ রাখেন। এবার অ্যান্টার্কটিকার হিমশীতল সমুদ্রের গভীরে বিজ্ঞানীরা যা খুঁজে পেয়েছেন, তা কেবল অবাক করার মতো নয়, রীতিমতো ভয়ংকর।
বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, সাগরতলের ফাটলগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ মিথেন গ্যাস বেরিয়ে আসছে। এই মিথেন গ্যাস আমাদের গ্রহকে দ্রুত গরম করে তোলে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই মিথেন নির্গমনের হার ‘আশ্চর্যজনক’। কারণ, খুব দ্রুত নতুন নতুন গ্যাস নির্গমনের উৎস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
এ ঘটনা বিজ্ঞানীদের মধ্যে গভীর আশঙ্কা তৈরি করেছে। কেননা, বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতের বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যে ধারণা বা পূর্বাভাস দিয়েছেন, এই অপ্রত্যাশিত মিথেন নির্গমনের ফলে তা আসলে ভুল প্রমাণিত হতে পারে। অর্থাৎ পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিপদ হয়তো আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি হতে চলেছে।
সাগরতলে হাজার বছর ধরে তৈরি হওয়া বিপুল পরিমাণ মিথেন জমা হয়ে আছে। এই অদৃশ্য ও জলবায়ুদূষণকারী গ্যাস সাগরতলের ফাটলের মাধ্যমে পানির সঙ্গে মিশে যেতে পারে। অনেক সময় এই মিথেন সাগরপৃষ্ঠে বুদ্বুদের স্রোত হিসেবেও দেখা যায়।
কিন্তু পানির নিচ থেকে বের হওয়া মিথেন নিয়ে বিজ্ঞানীরা খুব কমই জানেন। বিজ্ঞানীদের কাছে তেমন কোনো তথ্য নেই যে এই নির্গমন ঠিক কীভাবে কাজ করে, কতগুলো উৎস আছে, আর এই মিথেনের কতটা অংশ বায়ুমণ্ডলে পৌঁছায়! সাগরের নিচে বসবাসকারী মিথেন খাওয়া ব্যাকটেরিয়া এই গ্যাসের কতটা অংশ খেয়ে ফেলে বা শোষণ করে নেয়, এসব তথ্য অনেকটাই অজানা।
বিজ্ঞানীরা এই মিথেন নির্গমনকে আরও ভালোভাবে বুঝতে কাজ করছেন। কারণ, এই গ্যাস এত বেশি ক্ষতিকর যে এটি বায়ুমণ্ডলে এর প্রথম ২০ বছরে কার্বন ডাই–অক্সাইডের চেয়ে প্রায় ৮০ গুণ বেশি তাপ আটকে রাখে। অর্থাৎ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য এটি মারাত্মক বিপজ্জনক।
কিন্তু অ্যান্টার্কটিকায় মিথেন নির্গমনের বিষয়টি বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে কম জানা ছিল। তাই আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের একটি দল এই নির্গমনের উৎস খুঁজে বের করতে কাজে নেমে পড়েন। তাঁরা জাহাজ থেকে অ্যাকোস্টিক সার্ভের মাধ্যমে শব্দ দিয়ে জরিপের কাজ করছেন। দূর থেকে চালিত জলযান ‘আরওভি’ ও ডুবুরিদের ব্যবহার করে গবেষণা চালানো হচ্ছে। অ্যান্টার্কটিকার রস সাগরের একটি উপসাগরের ১৬ ফুট থেকে ৭৯০ ফুট গভীরতা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থান থেকে তাঁরা মিথেনের নমুনা সংগ্রহ করেছেন।
বিজ্ঞানীরা রস সাগরে যা খুঁজে পেয়েছেন, তা তাঁদের রীতিমতো অবাক করেছে। চলতি মাসের নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় তাঁরা জানান, রস সাগরের অগভীর পানিতে ৪০টির বেশি মিথেন গ্যাস নির্গমনের উৎস শনাক্ত হয়েছেন। এত বেশিসংখ্যক নির্গমনের উপস্থিতি তাঁরা আশা করেননি।
এই ৪০টির বেশি মিথেন নির্গমনের উৎসের মধ্যে এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে বিজ্ঞানীরা আগে কখনোই কিছু পাননি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগে অ্যান্টার্কটিকায় মিথেন বের হওয়ার নিশ্চিত ঘটনা ছিল মাত্র একটি। কিন্তু এখন এটি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। গবেষকদের মূল চিন্তা হলো, নতুন নির্গমনগুলো বিপুল পরিমাণ মিথেন গ্যাসকে সরাসরি বায়ুমণ্ডলে পাঠিয়ে দিতে পারে। এর ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিপদ আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে। কারণ, এখন পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের পূর্বাভাসে এই নতুন উৎসের মিথেনকে ধরা হয়নি। এর পাশাপাশি, এই মিথেন সামুদ্রিক পরিবেশ ও প্রাণীদের জন্যও মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন।
এই অঞ্চলে কেন এত মিথেন গ্যাস নির্গত হচ্ছে, তা এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে স্পষ্ট নয়। তবে গবেষকেরা দেখছেন যে নির্গমনগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রভাবিত হচ্ছে কি না। এসব নির্গমনকে আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য বিজ্ঞানীরা এ সপ্তাহে দুই মাসের জন্য অ্যান্টার্কটিকায় যাচ্ছেন।
সূত্র: সিএনএন, এবিসি নিউজ