জনপ্রিয় ছাগল ফ্র্যাঙ্কির আমেরিকা ভ্রমণ

সাত সমুদ্র পাড়ি দেয় মানুষ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে মনিক নামের একটি মুরগিরও সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার ঘটনা নিশ্চয়ই অনেকের জানা। টানা দুই বছর ওই মুরগি গাইরেক সুডি নামের এক অভিযাত্রীর সঙ্গী হয়ে ঘুরেছে নানা সমুদ্রে। আর এবার এক অভিযাত্রী দম্পতির সঙ্গী হয়েছে ছাগল। আমেরিকার অন্তত ২৫টি অঙ্গরাজ্য এবং ৬০ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ফ্র্যাঙ্কি নামের এই ছাগল দেশটির সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা ছাগল।

গৃহপালিত এই ছাগলটি নাইজেরিয়ান বামন জাতের। বছরের বেশ কয়েক মাস ফ্র্যাঙ্কি মালিক কেট ব্যাটলস ও তাঁর স্বামী চ্যাডের সঙ্গে একটি এয়ারস্ট্রিমে করে আমেরিকা ভ্রমণ করে। এয়ারস্ট্রিম হলো বিশেষ ধরনের গাড়ি। অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি আধুনিক এয়ারস্ট্রিমে রান্নাঘর, বাথরুম, শোবার জায়গাসহ অন্যান্য আধুনিক সুবিধা থাকে।

কেট ব্যাটলস বলেছেন, ‘আমরা জানতাম না যে এটি (ছাগল) ভ্রমণে কতটা ভালো করবে। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কি ভ্রমণ উপভোগ করে। ফ্র্যাঙ্কি দুর্দান্ত ভ্রমণসঙ্গী।’

এই দম্পতি বেশ কয়েক বছর ধরে একসঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিম, মধ্য-পশ্চিম, মনটানা, ওয়াইওমিং ও আইডাহোর মরুভূমিতে ভ্রমণ করেছেন। ইনস্টাগ্রামে ফ্র্যাঙ্কিসহ এই দম্পতির একটি যৌথ পেজ আছে। এতে তাঁদের ফলোয়ারের সংখ্যা বর্তমানে ২১ হাজার ৮০০।

কেট ব্যাটলস ও চ্যাড সব সময় একটি ছাগল পুষতে চাইতেন। এটা জেনে এক বন্ধু টেনেসির একটি খামারে নিয়ে গিয়ে তাঁদেরকে ফ্র্যাঙ্কি উপহার দেন। সেখান থেকে ফ্র্যাঙ্কিকে কোলে করে নিয়ে আসেন নর্থ ক্যারোলাইনা রাজ্যের অ্যাশভিলে তাঁদের বাড়িতে। ফ্র্যাঙ্কি দ্রুত তাঁদের পরিবারের অংশ হয়ে ওঠে।

এর এক বছর পরে কেট ও চ্যাডের সন্তানেরা পড়াশোনার জন্য বাড়ি ছেড়ে অন্যান্য জায়গায় চলে যায়। একা হয়ে পড়েন কেট ও চ্যাড। এ সময় তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, নিয়মিতভাবে একটি নতুন শহর ও রাজ্য বেছে নিয়ে ভ্রমণ করবেন। এই ভাবনা থেকেই ২০১৬ সালে একটি পুরোনো এয়ারস্ট্রিম আর্গোসি কিনে নেন। ১৯৭৬ সালের মডেলের কেনা এয়ারস্ট্রিমটি নিজেদের মতো করে মেরামত করে সাজিয়ে নেন। চ্যাড নিজেই গাড়িটির সংস্কারকাজ করেন। আর কেট পেশায় একজন লেখক ও শিল্পী। তাই তিনি গাড়িতে শৈল্পিকভাবে রঙের কাজ করেছিলেন।

এয়ারস্ট্রিমের নকশাটি মূলত আমেরিকান ফোকশিল্পী উডি গুথ্রির ‘দিস ল্যান্ড ইজ ইয়োর ল্যান্ড’ গানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা। রেডউডসের মতো স্থানের ছবিও আঁকা আছে এতে। গানটিতেও এই ছবিগুলোর কথা উল্লেখ আছে।

ফ্র্যাঙ্কি যেভাবে ভ্রমণসঙ্গী

কেট ও চ্যাডের ধারণা ছিল, ফ্র্যাঙ্কি এত দূর পথ ভ্রমণ করতে পারবে না। এ কারণে প্রথমে তাঁরা ফ্র্যাঙ্কিকে ছয় মাসের জন্য এক বন্ধুর কাছে রেখে এয়ারস্ট্রিম নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। ছয় মাস এই এয়ারস্ট্রিমই তাঁদের ভ্রমণ ও তাঁদের ঘর হয়ে ওঠে। ফিরে এসে পরের বছর তাঁরা নিজেদের বাড়ি বিক্রি করে দেন। এবার চলন্ত গাড়ি তাঁদের ঘর। সিদ্ধান্ত নেন পূর্ব থেকে আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে গাড়ি চালিয়ে যাবেন। এবারই প্রথমবারের মতো ভ্রমণসঙ্গী হয় প্রিয় ছাগল ফ্র্যাঙ্কি।

এই ভ্রমণ প্রসঙ্গে কেট বলেন, ফ্র্যাঙ্কি অভিজ্ঞতাটি দারুণ উপভোগ করছে। তার সময়টাও দারুণ কেটেছে। ফ্র্যাঙ্কিকে নিয়ে তাঁরা প্রতিদিন হাইকিংয়ে বের হতেন।

এর পর থেকে কেট ও চ্যাডের সব ভ্রমণের সঙ্গী হয়েছে এই ছাগল। তবে তাঁদের আরও একজন ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন। তিনি কুক স্প্যানিয়েল ম্যাগি। তিনি মূলত রান্নার কাজ করতেন। ২০১৯ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

ফ্র্যাঙ্কির কথা ভেবেই কেট ও চ্যাড বিশেষ করে মরুভূমিতে ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। কারণ, মরুভূমিতে অনেক সরকারি জমি থাকে। এসব জমি পোষা প্রাণীর জন্য খুব উপযুক্ত। কেট বলেন, ফ্র্যাঙ্কি বিশেষ করে ওরেগন উপকূল পছন্দ করে। কারণ, এখানে লাফানোর জন্য পাথর আছে। এ ছাড়া সে স্লট ক্যানিয়নের বড় ভক্ত।

তবে পোষা প্রাণী বিশেষ করে পোষা ছাগল নিয়ে ভ্রমণের কিছু অসুবিধা আছে। ফ্র্যাঙ্কির থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য কেট ও চ্যাডকে পোষা প্রাণিবান্ধব জায়গা, রেস্তোরাঁ এবং হাইকিং ট্রেইল খুঁজে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। কারণ, ছাগল নিয়ে সব জায়গায় যাওয়ার অনুমতিও পাওয়া যায় না।

কেট বলেন, তাঁরা নিয়ম মেনে এবং ছাগল নিষিদ্ধ এলাকা এড়িয়ে চলেন। বিশেষ করে যেসব বন্য অঞ্চলে বড় শিংযুক্ত ভেড়া এবং পাহাড়ি ছাগল থাকে, সেসব এলাকা এড়িয়ে চলেন। কারণ, তাদের থেকে ফ্র্যাঙ্কির শরীরে রোগ সংক্রমিত হতে পারে।

ক্যাম্পিংয়ে ফ্র্যাঙ্কি

কেট আরও বলেন, ‘ছাগল সাধারণত সারা দিন খায়। এ কারণে আমরা কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর থেমে ফ্র্যাঙ্কিকে ছেড়ে দিই। এ সময় ফ্র্যাঙ্কি ব্ল্যাকবেরি ঝোপ, খড় বা ঘাস খেয়ে নেয়। তারপর আবার গাড়ি চালানো শুরু করি। তাকে নিয়ে ভ্রমণ করা সত্যিই সহজ। যেহেতু সে ছোট ছিল, তাই ভালোভাবে পটি প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম।’

ফ্র্যাঙ্কি বেশ জনপ্রিয়। সে যেখানেই ভ্রমণ করে, সেখানে কেউ না কেউ তাকে দেখেই চিনে ফেলে। ২০০৬ সালে সামাজিক যোগাযোগের প্ল্যাটফর্মে তাদের অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। তখন থেকেই মূলত মানুষ ফ্র্যাঙ্কিকে চিনতে শুরু করে। কিন্তু ২০২২ সালে ডিসকভারি টিভি সিরিজ ‘দ্য বন্ড’-এ কেটের উপস্থিতির পর ফ্র্যাঙ্কির জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়।

‘আমরা সারা দেশ ঘুরেছি। ভ্রমণের সময় পথের ধারে কেউ হঠাৎ বলে ওঠেন “এটা কি ফ্র্যাঙ্কি? এটা খুবই মজার বিষয়। ছাগলের কাছ থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে”’—এভাবেই বলেছেন কেট।

অধিকাংশ সময় ফ্র্যাঙ্কি তার মালিকদের সঙ্গেই কাটায়। এরপরও তার কিছু ‘ছাগল বন্ধু’ও আছে। কেট প্রায় সময় অন্য ছাগলদের সঙ্গে খেলার জন্য ফ্র্যাঙ্কিকে নিয়ে যান।

কেট ও চ্যাড দম্পতির সঙ্গী ফ্র্যাঙ্কি

একবার দীর্ঘ ভ্রমণের সময় তাঁরা ওরেগন থেকে ক্যালিফোর্নিয়া, নেভাডা, অ্যারিজোনা পর্যন্ত ক্রস কান্ট্রি ভ্রমণ করেছিলেন। নিউ মেক্সিকো হয়ে ওকলাহোমা পর্যন্ত ৬৬টি রুট পেরিয়েছিলেন। সেখান থেকে তাঁরা টেনেসিতে যান। এরপর নর্থ ক্যারোলাইনা, কেনটাকি, ওহাইও, ইন্ডিয়ানা, ইলিনয়, আইওয়া, সাউথ ডাকোটা ও ওয়াইওমিং হয়ে দক্ষিণ ওরেগনে ফিরে আসেন। এই দীর্ঘ ভ্রমণেও ফ্র্যাঙ্কি তাদের সঙ্গে এয়ারস্ট্রিমে ছিলেন।

কেট ও চ্যাড দম্পতি আরেকটি নতুন সঙ্গী হিসেবে কুকুর পেয়েছে। তার নাম কর্নডগ। ফ্র্যাঙ্কি ও কর্নডগ দুজনেই দুজনের সঙ্গ উপভোগ করছে।

সূত্র: দ্য ইনডিপেনডেন্ট ও সিএনএন

ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

আরও পড়ুন