কিছু মানুষ বিশ্ব রেকর্ড গড়তে এত আগ্রহী কেন

আবহমান বাংলার সংস্কৃতিকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার লক্ষ্যে ও বিশ্ব রেকর্ড হিসেবে গিনেস বুকে ঠাঁই করে নিতে বিশ্বের দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের হাওরের অলওয়েদার সড়কে। মিঠামইন, কিশোরগঞ্জ, ১৩ এপ্রিল ২০২৪

কিশোর আলোয় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, গাছকে আলিঙ্গন করে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নিজের নাম লিখিয়েছেন ঘানার এক সমাজকর্মী ও বন বিভাগের শিক্ষার্থী। এক ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি গাছকে জড়িয়ে ধরার রেকর্ড তাঁর। ২৯ বছর বয়সী এই রেকর্ডধারীর নাম আবুবকর তাহিরু। মোট ১ হাজার ১২৩টি গাছকে ১ ঘণ্টার মধ্যে আলিঙ্গন করে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নিজের নাম লিখিয়েছেন তিনি। এ জন্য তাঁকে প্রতি মিনিটে গড়ে ১৯টি গাছ জড়িয়ে ধরতে হয়েছে।

স্বাভাবিকভাবে ভাবলে এই কাজকে একদমই অর্থহীন মনে হতে পারে। গাছ রক্ষার কোনো দাবি তিনি করেননি। গাছ রক্ষার যতগুলো উপায় আছে, তার মধ্যে কোনোভাবেই গাছকে জড়িয়ে ধরার শর্ত নেই। তবু তিনি ধরেছেন। এবং দুনিয়ার বহু সংবাদমাধ্যমে শিরোনামে জায়গা পেয়েছেন। কিশোর আলোর পাঠকেরাও এই তথ্য জেনেছে। রেকর্ড গড়া ছাড়া এই কাজের স্পষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই। রেকর্ড বুকে নাম তোলা ছাড়া কোনো অর্জনও হয়নি তাঁর। তবে বহু মানুষ তাঁর কথা জেনেছেন, তাঁর প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন। নিজের ২৯ বছরের জীবনে এর আগে কখনো এমন কিছু ঘটেনি।

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে এমন অদ্ভুত অনেক রেকর্ড রয়েছে, স্বাভাবিক বিচারে যার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ রকম ঘটনা ভারতে প্রচুর দেখা গেছে। ২০১৫ সালে নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদ অনুযায়ী নিখিল শুক্লা ছিলেন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ভারতের স্থানীয় বিচারক। রেকর্ডের প্রচেষ্টা হলে তিনি উপস্থিত থাকতেন। অদ্ভুত সব রেকর্ড প্রচেষ্টার সাক্ষী তিনি। জনসম্প্রীতি প্রচারের জন্য মানুষ করমর্দনের রেকর্ড করতে চেয়েছিল। সবচেয়ে বেশিবার একযোগে করমর্দন করে বিশ্ব রেকর্ড করা হবে।

আরও পড়ুন

জানুয়ারির এক সকালে শুক্লা রেকর্ড করার জায়গায় গিয়ে দেখতে পান, লাখ লাখ লোক উপস্থিত হয়েছে। মহাসড়কে টোল নেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে একটি মাইক্রোচিপসহ আইডি কার্ড বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এত মানুষ সামলানো কোনো সহজ কাজ নয়। চুপচাপ এত মানুষ একত্রে বসে থাকতে পারে না। শুক্লা ৪৮ হাজার ৮৭০ জনকে গণনা করেন এবং একটি জায়গায় অবস্থান করান। এর জন্য সময় লাগে সাত ঘণ্টা! এরপর একটি সংকেত দেওয়া হলে সবাই ৫ মিনিটের জন্য মুখে গম্ভীর ভাব নিয়ে করমর্দন করে। পরিচিত বন্ধুর সঙ্গে কত দিন পরে দেখা, এই ভান করে সবাই হাসছিল আর করমর্দন করেছিল।

ভাবলে বিষয়টিকে পাগলামি মনে হবে। ৫ মিনিট ধরে করমর্দন করে রেকর্ডের জন্য সাত ঘণ্টা অপেক্ষা করা এবং অপরিচিত লোককে পরিচিতের ভান করে হাত ঝাঁকানোর মধ্যে অসম্ভব পাগলামিই আছে, যুক্তি নেই।

এই দুই ঘটনা থেকে দেখা যায়, মানুষ একা একা বা যৌথভাবে এমন অদ্ভুত কাজ করে রেকর্ড গড়ার জন্য, যার নির্দিষ্ট কোনো মানে নেই।

পৃথিবীতে অনেক রকম রেকর্ড বুক আছে। এর মধ্যে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস সবচেয়ে আকর্ষণীয়। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের প্রায় ১০ শতাংশ এখন ভারত থেকে আসে। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনকে পেছনে ফেলে ভারতীয়রা প্রায় ৩ হাজার রেকর্ডের জন্য আবেদন করেছিল। দেখা গেছে, ভিড় জমানো সহজ এমন দেশে রেকর্ডের ঘটনা বেশি ঘটে। সব সময় রেকর্ড অর্থহীন ও অকাজের এমন নয়। যেমন একসঙ্গে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক রক্ত সঞ্চালন করে রেকর্ড গড়ার ঘটনা আছে। ভারতে ৬১ হাজার ৯০২ জন দাতা একত্রে রক্ত দিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের চার্লস সার্ভিজিও হেস্পেরিয়াতে ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে ২৪ ঘণ্টায় ৪৬ হাজার ১টি পুশ-আপ দিয়েছিলেন।
সিএনএন

আবার মোটরসাইকেলে সবচেয়ে বড় মানব পিরামিড বানানোর রেকর্ডও ভারতের। ২০১ জন পুরুষ ১০টি মোটরসাইকেল ব্যবহার করে এই পিরামিড গড়েন। এমন রেকর্ডের পেছনে একটি কারণ হলো, আর কেউ যেন এই রেকর্ড কখনো না করে বা রেকর্ড না ভাঙে। বছর বছর এ জন্যই রেকর্ডগুলো অদ্ভুত থেকে আরও অদ্ভুত হচ্ছে। কারণ, কেউ চায় না তাঁর রেকর্ড অন্য কেউ ভেঙে ফেলুক।

বিশ্বজুড়ে বিচিত্র রেকর্ড গড়ার অনেক উদাহরণ আছে। যেমন একজন কানের পশম লম্বা করতে করতে ৭ দশমিক ১২ ইঞ্চি লম্বা করেছেন। এভারেস্টে গিটার বাজিয়েছেন একজন। আরেকজন ১০৩ অক্ষরের বাক্য ৪৭ সেকেন্ডে নাক দিয়ে টাইপ করেছেন। একজন ৩৯টি পার্ক করা গাড়ির একটি সারির নিচ দিয়ে লিম্বো স্কেটিং করেছেন। লিম্বো স্কেটিং হলো স্কেটিংয়ের জুতা পরে পা দুই দিকে ছড়িয়ে মাথা নিচু করে একদম নিচু হয়ে স্কেটিং করা।

আরও পড়ুন

এমন রেকর্ড গড়তে গিয়ে প্রাণ হারানোর ঘটনাও ঘটেছে। শৈলেন্দ্র নাথ রায় জিপ লাইনে লম্বা চুল বেঁধে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করেন রেকর্ড গড়ার জন্য। মাঝামাঝি চুল আটকে গিয়ে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত ভিডিও থেকে দেখা যায়, পাশে ব্রিজে দাঁড়িয়ে এই রেকর্ড গড়তে দেখছিলেন শত শত দর্শক। রেকর্ড গড়তে গিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করা কঠিন।

এমন অনেক রেকর্ড আছে, যেগুলো ব্যাখ্যা করা কঠিন। নয়াদিল্লির ৭২ বছর বয়সী হর প্রকাশ ৩৬৬টি পতাকার ট্যাটু দিয়ে নিজের শরীর ঢেকেছেন। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি একজন রেকর্ড গড়েছিলেন সবচেয়ে লম্বা নখের জন্য। ১৯৫২ সালে বাঁ হাতের নখ কাটা বন্ধ করেছিলেন। ফলে বিশ্বের দীর্ঘতম নখের রেকর্ডটি হয় তাঁর। মোট নখের দৈর্ঘ্য হয় ২০ ফুট। নিজের হাত তিনি রাখতেন একটা বিশেষ ব্যাগে। প্রতিদিন পেট্রোলিয়াম জেলি এবং বোরিক অ্যাসিড দিয়ে নখ পরিষ্কার করতে হতো। নখগুলো খুবই ভঙ্গুর হওয়ায় হাতটি অকেজো হয়ে যায় তার। তোমার একটি হাত আছে, গিনেস রেকর্ড করার জন্য তুমি আর হাত ব্যবহার করো না, এর চেয়ে বিস্ময়ের আর কী হতে পারে!

রেকর্ডের সব কটি যে এমন অদ্ভুত, তা নয়। কিছু রেকর্ড বিস্ময়কর এবং আকর্ষণীয় বটে। যেমন বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা মানুষ বা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়সী মানুষ। এ জন্য এই ব্যক্তিকে আলাদা কিছু করতে হয়নি। জিব দিয়ে ওজন তোলা বা মাথা দিয়ে নারকেল ভাঙার মতো অদ্ভুত কিছু করতে হয়নি। এটি রেকর্ডের সৌন্দর্য। মানুষ এমন তথ্য জানতে পছন্দ করে।

আরও পড়ুন

আবার মানুষ অন্যদের থেকে আলাদা হতে চায়। এই রেকর্ড আলাদা হওয়ার একটি উপায়। তবে বিষয়টি খরুচে। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস প্রতিবছর একটি প্রকাশনা বের করে। যেখানে নিজের নাম তোলার জন্য নির্দিষ্ট ফি পরিশোধ করে আবেদন করতে হয়। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস সব সময় ৪০ হাজার রেকর্ডের একটি তথ্যভান্ডার চালু রাখে। যার মধ্য থেকে মাত্র ৩ থেকে ৪ হাজার রেকর্ড মুদ্রিত বইয়ে জায়গা পায়। এই বইয়ে জায়গা পেতে প্রবল প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয়। কারণ, আবেদন পড়ে ৫০ হাজার। প্রতিটি নতুন সংস্করণের তিন-চতুর্থাংশ থাকে নতুন বা নতুন করে ভাঙা রেকর্ডের হিসাব। আবেদনপ্রক্রিয়া এখন অনলাইন হলেও আগে কষ্টকর ছিল। দুজন সাক্ষীর প্রয়োজন ছিল, একটি অফিশিয়াল লগবুক এবং ছবি থাকতে হতো। উন্মুক্ত জায়গায় রেকর্ডটি হতে হবে। যেন রাস্তার যে কেউ এটি দেখেছেন বলে লিখিত দিতে পারবেন। সবশেষে রেকর্ড নিশ্চিত করার জন্য মিডিয়া কভারেজ প্রয়োজন হতো। এত কিছু করেও মানুষ রেকর্ড গড়ত।

তবে রেকর্ড গড়ার মতো বিষয়, যেগুলো সাধারণভাবে অর্থহীন কোনো কাজ নয়, এমন বিষয় অসীম না। যেমন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি। সবচেয়ে লম্বা ব্যক্তি। এই বিষয়গুলো শেষ হওয়ার পর মানুষ বিচিত্র বিষয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে, কারণ তার পক্ষে চাইলেই সবচেয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকা বা সবচেয়ে লম্বা হওয়া সম্ভব না। তাই মানুষ ঝুঁকে পড়ে এমন অদ্ভুত কোনো রেকর্ড গড়তে, যেটা এতই অদ্ভুত, অন্য কেউ এটার ব্যাপারে কোনো গুরুত্বই দেয় না। তাই রেকর্ড ভাঙে না। যখন ভাঙে, তখন দেখা যায়, এমন অদ্ভুত আরেকজন এই অদ্ভুত কাজের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়তে চান।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশিদের মধ্যেও এমন অদ্ভুত রেকর্ড গড়ায় বেশ আগ্রহ দেখা যায়। বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক দেশগুলোয় এই আগ্রহ বেশি। ব্যক্তির সাফল্য এখানে বিস্ময়কর। রেকর্ড বুকে নাম তোলা এখানে সাফল্য হিসেবে ধরা হয় এবং এর জন্য উৎসুক দর্শকের অভাব হয় না বলেই এখানে মানুষের আগ্রহ বেশি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপরের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেও এখানে মানুষের ভিড় জমে যাবে। লোকে জিজ্ঞেস করবে, ভাই কী দেখেন? এই অন্যদের থেকে পাওয়া আগ্রহই মানুষকে রেকর্ড গড়তে আগ্রহী করে। সে যেমন রেকর্ডই হোক।

তবে কিছু রেকর্ড নিজের শক্তিমত্তা বা সেরা হওয়াকেও প্রমাণ করে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের চার্লস সার্ভিজিও হেস্পেরিয়াতে ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে ২৪ ঘণ্টায় ৪৬ হাজার ১টি পুশ-আপ দিয়েছিলেন। ২১ ঘণ্টা ২১ মিনিট পুশ-আপ দিয়ে থেমে যান। প্রতি মিনিটে গড়ে ৩৬টি পুশ-আপ দিয়েছেন তিনি। এখন পর্যন্ত এই রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারেনি। চেষ্টা করে দেখবে নাকি?

আরও পড়ুন