দক্ষিণ কোরিয়ার কিশোর-কিশোরীরা ঘর ছেড়ে কেন কফিশপে ভিড় জমাচ্ছে

কফিশপে গিয়ে দেখেছো, অনেক ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করছেছবি: বিবিসি

গত সপ্তাহে ছুটির দিনে একটা নামি কফিশপে গিয়েছি। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করব। গিয়ে দেখি বসার জায়গা নেই। প্রতিটি টেবিল ল্যাপটপ, বই আর নোটখাতা দিয়ে ভর্তি। বসার জন্য বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। এই অভিজ্ঞতা তোমাদেরও নিশ্চয়ই হয়েছে। কফিশপে গিয়ে দেখেছো, অনেক ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করছে। এটা শুধু আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে এমন না, পৃথিবীর বহু দেশে এখন এই চিত্র দেখা যাচ্ছে। আজ বলব দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের মতো বড় শহরগুলোর কথা। এসব শহরে এমন দৃশ্য এখন খুব স্বাভাবিক।

দক্ষিণ কোরিয়ায় যারা কফিশপে বসে পড়াশোনা বা কাজ করে, তাদের আলাদা নাম আছে। তাদের বলা হয় 'ক্যাগংজোক'। সিউল শহরের অভিজাত এলাকা দায়েচিতে এমন এক কফিশপের মালিক হিউন সুং-জু। তিনি এক অদ্ভুত সমস্যায় পড়েছেন। তিনি বিবিসিকে জানিয়েছেন, সম্প্রতি এক ক্রেতা তাঁর কফিশপে এমনভাবে জায়গা করে নিয়েছিলেন যেন তিনি নিজের অফিস সাজিয়েছেন! দুটি ল্যাপটপ, ছয়টি পোর্টের একটি মাল্টিপ্লাগ দিয়ে সারা দিন ধরে নিজের সব ডিভাইস চার্জ করছিলেন। শেষ পর্যন্ত হিউন সেই মাল্টিপ্ল্যাগ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।

আরও পড়ুন
দক্ষিণ কোরিয়ায় এই 'ক্যাগংজোক' সংস্কৃতি এখন ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে
ছবি: বিবিসি

তিনি বলেন, দায়েচির মতো জায়গার ভাড়া খুব বেশি। যদি কেউ সারা দিন একটি সিট দখল করে রাখে, তাহলে ব্যবসা চালানো খুব কঠিন।

দক্ষিণ কোরিয়ায় এই 'ক্যাগংজোক' সংস্কৃতি এখন ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের বা অন্য দেশের তুলনায় ওখানে এটা অনেক বেশি। বিশেষ করে যে সব এলাকায় প্রচুর শিক্ষার্থী ও হোম অফিসকর্মী আছেন, সেখানে এমন দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়। সম্প্রতি কফি চেইনশপ স্টারবাকসও এই ব্যাপারে কিছু নতুন নিয়ম চালু করেছে। তারা জানিয়েছে, কিছু মানুষ ল্যাপটপ ছাড়াও ডেস্কটপ মনিটর, প্রিন্টার নিয়ে আসে, যা অন্যদের অসুবিধা তৈরি করে। তবে তারা কাউকে চলে যেতে বলবে না। প্রয়োজনে শুধু ‘নির্দেশনা’ দেবে।

কেন এই ট্রেন্ড এত জনপ্রিয়

দক্ষিণ কোরিয়ার তরুণরা লাইব্রেরি, পড়ার ঘর বা নিজের বাড়িতে না পড়ে ক্যাফেতে কেন আসে? দক্ষিণ কোরিয়ায় এই ট্রেন্ড জনপ্রিয় হওয়ার কিছু কারণ আছে।

প্রথমত দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজ খুব প্রতিযোগিতামূলক। এখানে চাকরিপ্রার্থী বা শিক্ষার্থীদের ওপর প্রচণ্ড চাপ থাকে। যেমন কিশোর আলোতে আমরা তাদের এক বিশেষ পরীক্ষা নিয়ে লিখেছি। তাদের জন্য লাইব্রেরি বা পড়ার জায়গা সবসময় যথেষ্ট হয় না। অনেকে মনে করে, ক্যাফের হালকা কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ তাদের মনকে শান্ত রাখে এবং পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে সাহায্য করে।

আরও পড়ুন
'ক্যাগংজোক' সংস্কৃতি আসলে সমাজেরই প্রতিফলন
ছবি: বিবিসি

কিছু মানুষের বাসা খুব আরামদায়ক না। অনেকের বাসায় পারিবারিক কিছু ঝামেলা থাকে। যেমন ২৯ বছর বয়সী ইউ-জিন মো বিবিসিকে তার শৈশবের একটি কষ্টের কথা বলেছেন। ছোটবেলায় তিনি ফস্টার কেয়ারে বড় হয়েছেন। তাঁর বাড়ি তাঁর কাছে নিরাপদ ছিল না। তিনি বলেন, তিনি বাবার সঙ্গে একটি ছোট কন্টেইনারে থাকতেন। বাবা মাঝেমধ্যে বাইরে থেকে তালা দিয়ে তাকে একা রেখে চলে যেতেন। এমন অভিজ্ঞতার কারণে বড় হয়েও তাঁর একা থাকতে অসুবিধা হয়, কঠিন মনে হয়। ঘুম থেকে উঠেই তিনি ক্যাফেতে চলে যান। লাইব্রেরি বা অন্যান্য পড়ার জায়গায় গেলে তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসে।

আনসান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চই রা-ইয়ং দুই দশকের বেশি সময় ধরে জীবনব্যাপী শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি মনে করেন, 'ক্যাগংজোক' সংস্কৃতি আসলে সমাজেরই প্রতিফলন। আমাদের তৈরি করা সমাজেই এই সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। অনেক তরুণের থাকার জায়গা ছোট। হয়তো সেখানে পড়াশোনার জন্য কোনো জানলা বা আলাদা জায়গা নেই।

আরও পড়ুন

সমাধান কী

ক্যাফেতে পড়া নিয়ে সবার প্রতিক্রিয়া অবশ্য এক রকম নয়। যারা কফিশপে গল্প করতে বা সময় কাটাতে আসেন, তারা প্রায়ই অভিযোগ করেন, 'ক্যাগংজোক'-এর কারণে বসার জায়গা পাওয়া কঠিন। তাদের জন্য ক্যাফের শান্ত পরিবেশেও কথা বলতে অস্বস্তিবোধ হয়।

অন্যদিকে কিছু মানুষ মনে করে, স্টারবাকসের এই নতুন নিয়ম বাড়াবাড়ি। তবে বেশিরভাগ মানুষ এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। এটি কফিশপগুলোতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।

তবে অধ্যাপক চই মনে করেন, এই সমস্যার সমাধান শুধু নিয়ম চাপিয়ে দিলে হবে না। আমাদের এমন পরিবেশ এবং গাইডলাইন তৈরি করতে হবে যেন অন্যরা বিরক্ত না হয়, এই সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে পারে।

সূত্র: বিবিসি

আরও পড়ুন