দক্ষিণ কোরিয়ার বইয়ের শহর : পাজু বুক সিটি
ঢাকায় প্রকাশনাজগতের কেন্দ্র বাংলাবাজার। সদরঘাটের কাছেই বাংলাবাজারের অবস্থান। কাছাকাছি আছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ছুটির দিন শুক্রবার বাদে এখানে প্রতিদিন চলে বই তৈরির মহাযজ্ঞ। বহু মানুষ এখানে বইপত্র তৈরির কাজে যুক্ত। আছে অনেকগুলো প্রকাশনীর দপ্তর। বইয়ের কাগজের দোকান থেকে শুরু করে এখানে ঘোরাফেরা করেন লেখক, প্রকাশক, টাইপিস্ট, ডিজাইনার, বইয়ের মেকআপম্যান থেকে শুরু করে ছাপাখানার কর্মীরা। এখান থেকে বই ছেপে সারা দেশে চলে যায়। জায়গাটার এমনই গুরুত্ব, প্রকাশকেরা এ জায়গা ছাড়া প্রকাশনা ব্যবসার কথা ভাবতে পারেন না।
আমাদের দেশটা ছোট। বই পড়ার হারও খুব বেশি নয়। তাই বইয়ের জন্য আলাদা জায়গা গড়ে উঠলেও, আলাদা শহর গড়ে ওঠেনি। তবে এই ছোট্ট জায়গায় অনেক কিছু হচ্ছে। বইপত্র ছাপা, বিক্রি ইত্যাদি। তবে আমাদের এখানকার মতো সারা বিশ্বে কিন্তু এমন ছোট জায়গায় সবকিছু হয় না। এমন এক জায়গার কথা আজ বলছি। জায়গা বললে ভুল হবে। বলতে হবে শহর। দক্ষিণ কোরিয়ায় সিউলের উত্তর-পশ্চিমে এর অবস্থান। শহরটি বই প্রকাশনার জন্য বিখ্যাত। আমাদের বাংলাবাজারের মতোই।
বইবিষয়ক প্রায় ৯০০ প্রতিষ্ঠান নিয়ে গড়ে উঠেছে এক শহর। নাম পাজু বুক সিটি। বই তৈরির দক্ষযজ্ঞ এই শহরে ছড়িয়ে আছে। ছোট্ট এই শহরে নতুন বই তৈরি হয় পুরো দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য। এই শহরের অলিগলিতে পাওয়া যায় নতুন বইয়ের গন্ধ।
দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল শহর থেকে ২২ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এই পাজু শহর। একে বলা যায় একটি স্যাটেলাইট শহর। আকারে ছোট বলে এই নাম। এর জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। আমাদের বাংলাবাজারেই বুঝি সব সময় পাঁচ লাখের মতো লোক থাকে। সে যা–ই হোক, বাংলাবাজারে যেমন সারাক্ষণ গাড়ি চলে, রিকশা চলে, সে তুলনায় পাজু বুক সিটির রাস্তাঘাট অনেক শান্ত। ঢাকার মতো এখানে ধুলাবালু ওড়ে না। সারাক্ষণ চলে না নির্মাণকাজ। এখানকার বাতাস পরিষ্কার। জীবন বুঝি এখানে খানিকটা ধীরে চলে।
অনেকে পাজু শহরকে চেনে একটি সামরিক ঘাঁটির জন্য। কিন্তু এটিই পুরো দক্ষিণ কোরিয়ার বইয়ের ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র। শহরটির আনুষ্ঠানিক নামে এর পরিচয় পাওয়া যায়। এর পুরো নাম পাজু পাবলিশিং কালচার, ইনফরমেশন অ্যান্ড ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক। সংক্ষেপে পাজু বুক সিটি। আগেই বলেছি, এই শহরে গড়ে উঠেছে বইবিষয়ক প্রায় ৯০০ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। আছে ছাপাখানা, পরিবহন ও বিতরণ সংস্থা। আছে বই ডিজাইন স্টুডিও। বই তৈরি হতে যা যা দরকার, এ শহরে সবই আছে।
এই শহরের শুরু বা গোড়াপত্তন হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের উদ্যোগে। সেখানকার সরকার ১৯৯৮ সালে প্রকাশনাকেন্দ্রটি চালু করে। এর আগে এক দশক ধরে চলছিল পরিকল্পনা। আধুনিকায়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে বেশ বড় করে বইয়ের শহরটি গড়ে তোলা হয়। এর আগে দেশটির প্রকাশনাশিল্প সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল।
একটি ইন্ডাস্ট্রি যখন গড়ে ওঠে, তখন ইন্ডাস্ট্রির প্রয়োজনীয় উপকরণ আশপাশেই থাকতে হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় এভাবে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো। তখন প্রকাশক বা উদ্যোক্তারা মনে করেছিলেন, এভাবে চললে পিছিয়ে পড়বেন তাঁরা। দক্ষতা বাড়ানোর জন্য নেওয়া হলো উদ্যোগ। মানে প্রকাশনার সবকিছু এক ছাতার নিচে নিয়ে এলেন। শহরকে ছাতা বলছি। ভেবে দেখো, পাজু ছাতাটা কত বড়! এই ছাতার নিচে পাঁচ লাখ লোকের জায়গা হয়ে যাচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতিতে বই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশে পাজু শহরের কল্যাণে বই প্রকাশনায় গতি এসেছে। প্রকাশকেরা এখন আরও দক্ষ। বই বিতরণে এসেছে গতি। ব্যবসার দিক থেকেও তাঁরা এগিয়ে চলেছেন। কোরিয়ান পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় ১১ কোটি ৫০ লাখের বেশি বই বিক্রি হয়েছে।
পাজু শহরটা এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেন বইয়ের প্রতি মানুষের ভালোবাসা তৈরি হয়। রাস্তাঘাটের কোণে আছে সুন্দর-মনোমুগ্ধকর ক্যাফে। এসব ক্যাফেতে কফি খেতে খেতে বই পড়া যায়। সবকিছুই এমন, যেন বইয়ের প্রতি ভালোবাসা টিকে থাকে। ভালোবাসা বাড়ে।
পাজু বুক সিটির কেন্দ্রবিন্দুতে আছে এশিয়া পাবলিকেশন কালচার অ্যান্ড ইনফরমেশন সেন্টার। এটি একটি পাঁচতলা ভবন। এই ভবনে আছে শিক্ষাকেন্দ্র, মিলনায়তন, প্রদর্শনী কক্ষ। স্থানীয় প্রকাশকদের একসঙ্গে হওয়ার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এটি কাজ করে। এই কেন্দ্রে প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার দর্শনার্থী আসেন।
ভবনের প্রথম তলায় আছে ‘ফরেস্ট অব উইজডম’ বা জ্ঞানবৃক্ষের বন। এই শহরের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। এখানে হাজার হাজার বই প্রদর্শন করা হয়। বহু বই সংরক্ষণে রাখা আছে। এই লাইব্রেরির ছাদ পর্যন্ত বইয়ের তাক দিয়ে সাজানো। একেকটি তাকের উচ্চতা ২৫ ফুটের বেশি। দেয়ালজুড়ে থরে থরে বই সাজানো।
এখান থেকে পাঠকেরা ইচ্ছেমতো বই ধার নিতে পারেন না। তবে তাক ঘেঁটে দেখতে পারেন। খোলা জায়গায় বসে বই পড়তে পারেন।
দর্শনার্থীদের মধ্যে এখানে দেখা যায় পরিবারের সঙ্গে আসা শিশুদের। আসেন তরুণেরা। দলবদ্ধ হয়ে বেড়াতে আসেন বয়স্করা। এখানে আছে একটি হোটেল। কেউ চাইলে রাতেও থাকতে পারেন। মূল ভবনের পাশে আছে বুক সিটি লেটার প্রেস মিউজিয়াম। এখানে সংরক্ষিত আছে ঐতিহ্যবাহী ছাপাখানার সরঞ্জাম। বিশেষ করে এখানে আছে সাড়ে তিন কোটি ধাতব অক্ষরের ব্লক।
এখানে অনেক স্কুলের ছেলেমেয়েরা ঘুরতে আসে। স্কুল থেকেই ওদের ঘুরতে নিয়ে আসে। স্কুলের একই রকম পোশাক পরা শিশুদের দেখা যায় বই পড়ছে। কেউ একটি সিঁড়ির ধাপে বসে বই পড়ছে। কেউ একা একা পড়ছে, কেউ দলবলে। উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীরা এখানে ছাপা ও প্রকাশনার প্রক্রিয়া হাতে-কলমে শিখতে পারে।
প্রতি শরতে এই কেন্দ্রে একটি বই উৎসবের আয়োজন করা হয়। যেখানে অংশ নেন স্থানীয় লেখক, শিল্পী আর বইপ্রেমীরা। এই বছরের আয়োজন ছিল দ্বাদশ বার্ষিক সমাবেশ। এখানে ছিল শিল্প প্রদর্শনী, লাইভ মিউজিক, টাইপিং প্রতিযোগিতা। টাইপরাইটারে বসে প্রতিযোগীরা কত দ্রুত ও নির্ভুলভাবে টাইপ করতে পারে, তার প্রতিযোগিতা চলছিল। এ সবই বইয়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ। চাইলে তুমি ঘুরে আসতে পারো বইয়ের এই শহর থেকে।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস