গবেষণাগারের প্রায় সবকিছু কাচের হয় কেন
প্রথম ল্যাবে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সাধারণত স্কুলজীবনেই হয়। এখনো মনে পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে বিজ্ঞান ক্লাসে প্রথমবার ল্যাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সায়েন্স ল্যাবে। সেই বিশাল করিডরের দুই পাশে ছিল সারি সারি ল্যাব রুম। সেগুলোর ভেতরে রাখা ছিল বড় বড় কাঠের পুরোনো আলমারি, আর মাঝখানে লম্বা টেবিল। সেই টেবিলে কিছুটা এলোমেলোভাবে সাজানো ছিল ছোট-বড় কাচের অসংখ্য পাত্র। যাকে বলে বিকার (Beaker)। কোনোটা দেখতে চওড়া, আবার কোনোটা লম্বাটে টেস্টটিউব।
কত যে বিকার আর টেস্টটিউব হাত থেকে পড়ে ভেঙেছে, তার হয়তো কোনো হিসাব নেই। তখন প্রায়ই মনে হতো, কেন এগুলো কাচের না হয়ে প্লাস্টিকের হলো না। যেখানে প্লাস্টিক আরও সস্তা ও সহজে ভাঙে না, সেখানে কেন এই সহজে ভেঙে যাওয়া কাচকেই ল্যাবে ব্যবহার করা হয়।
রসায়ন ল্যাব বা গবেষণাগার এমন একটি বিশেষ জায়গা যেখানে বিজ্ঞানীরা বা শিক্ষার্থীরা রসায়ন নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। সে জন্য সেখানে কাচের বিকার, টেস্টটিউব, ফ্লাস্ক, মাপার যন্ত্র ও বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ অ্যাসিড, ক্ষার, লবণ ইত্যাদি থাকে। এখানে নতুন রাসায়নিক তৈরি করা হয়, পুরোনো রাসায়নিকগুলোকে বিশ্লেষণ করে এদের উপাদান জানা হয় অথবা বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটিয়ে ফলাফল পর্যবেক্ষণ করা হয়। সে জন্য দরকার পাত্র। গবেষণাগারে ব্যবহারের পাত্র সব কাচের হয়। কারণ, কাচের বিশেষ কিছু গুণ আছে।
মূলত কাচ রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয়। অর্থাৎ এটি রাসায়নিকের সঙ্গে সহজে মিশে যায় না বা বিক্রিয়া করে না। এ ছাড়া কাচ উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। কাচ যেহেতু স্বচ্ছ। তাই এর ভেতরের রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন বিজ্ঞানীরা। আর কাচ পরিষ্কার করাও সহজ। সব দিক বিবেচনায় ল্যাবের এসব জটিল কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্যই কাচের পাত্রের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি, যা প্লাস্টিকের পাত্রে করা সম্ভব নয়।
এমনকি ল্যাবের বেশির ভাগ অ্যাসিড কাচকে দ্রবীভূত করতে পারে না। প্রায় ৩ হাজার ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এটি আবিষ্কৃত হয়। অনেকের ধারণা, কাচ তরল। তবে এ ধারণা সত্য নয়। কাচের অস্বাভাবিক রসায়নই এই বিভ্রান্তি তৈরি করে। কাচ ভঙ্গুর, তবে এর পারমাণবিক গঠন স্থিতিশীল ও শক্তিশালী। এটি প্রধানত সিলিকন ডাই-অক্সাইড দিয়ে তৈরি, যা শক্তিশালী, স্থিতিশীল রাসায়নিক বন্ধন তৈরি করে। তাই অ্যাসিড প্লাস্টিক ও ধাতু গলাতে সক্ষম হলেও কাচ অ্যাসিডপ্রতিরোধী। কারণ, অ্যাসিড কাচের রাসায়নিক বন্ধন ভাঙার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। সে জন্য কাচ সবচেয়ে বেশি উপযোগী এ কাজের জন্য।
সালফিউরিক অ্যাসিড ও অ্যাকুয়া রেজিয়া মানে নাইট্রিক অ্যাসিড ও হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের ঘন মিশ্রণ অত্যন্ত শক্তিশালী। অ্যাকুয়া রেজিয়া সোনার মতো ধাতুকেও গলিয়ে ফেলতে পারে। তাই একে বলা হয় রাজ-অম্ল। এ রকম যেসব শক্তিশালী অ্যাসিড বেশির ভাগ ধাতুকে দ্রবীভূত করতে পারে, সেগুলোও কাচের ওপর কাজ করে না। তবে কিছু প্রচণ্ড শক্তিশালী অ্যাসিড আছে। এগুলো খুব বেশি ক্ষয়কারী। যেমন ফ্লোরিনের অ্যাসিড কাচ দ্রবীভূত করতে পারে। কারণ, ফ্লোরিনের তড়িৎ ঋণাত্মকতা বা ইলেকট্রোনেগেটিভিটি অনেক বেশি। এর মানে, এটি তীব্রভাবে ইলেকট্রনকে আকর্ষণ করে। ফলে এটি কাচ থেকে ইলেকট্রন নিয়ে নেয় এবং রাসায়নিক বন্ধন ভেঙে কাচকে দ্রবীভূত করে ফেলতে পারে।
সূত্র: সায়েন্স মিউজিয়াম