আইসক্রিম কারখানায় একদিন

এখন বৈশাখের প্রচণ্ড গরম। ঘর থেকে দুই পা ফেললেই শরীর ঘেমে যায়। স্কুলে যেতে বা আসতে ঘেমেটেমে একাকার হতে পারো তুমিও। এমন দিনে কল্পনা করি, এই ধরো স্কুল থেকে বেরিয়ে একটা ঠান্ডা আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা হতেই পারে। খেলে তোমার ভালো লাগবে। ধরো, স্কুলের সামনেই একটা আইসক্রিমের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তুমি গাড়ি থেকে একটা কোন আইসক্রিম নিলে। তারপর ওপরের কাগজের কভারটা সরিয়ে পাশের কাগজ ছিঁড়ে খুলে ফেললে আইসক্রিম। আইসক্রিম খাওয়ার নিয়ম মেনে তোমাকে যেহেতু খেতে হবে, তাই তোমাকে আইসক্রিমটা খেতে হবে ধীরেসুস্থে। একটু রয়েসয়ে আইসক্রিমটা খেলে বেশি উপভোগ করতে পারবে।

আমার মনে যে প্রশ্ন এসেছে, সব দিন হয়তো তোমার মাথায় প্রশ্নটা আসবে না। কিন্তু একদিন অবশ্যই তোমার মনে এই প্রশ্ন তৈরি হতে পারে। প্রশ্নটা হলো, এত মজার যে আইসক্রিম, সেটা বানানো হয় কোথায়? কেমন করে বানায় এই আইসক্রিম? প্রশ্নটা জীবনের কোনো একটা পর্যায়ে সবাই ভাবে। কেউ আবার এক ধাপ এগিয়ে আইসক্রিমের কারখানাই দেখতে চায়। কিশোর আলোর মাথায়ও প্রশ্নটা এসেছে। এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমরা গিয়েছিলাম সাভারের খাগানে, পোলার আইসক্রিমের কারখানায়। এই লেখায় তোমাকে বলব, কারখানায় কেমন করে আইসক্রিম বানানো হয়। শুধু কি আইসক্রিম বানিয়ে সোজা দোকানে পাঠিয়ে দিলেই তোমার হাতে চলে যায়, নাকি এর মধ্যে আরও কাজ আছে? এগুলো জানতেই আমরা গেলাম আইসক্রিম কারখানায়।

তোমার হয়তো জানা আছে, আইসক্রিম বানানোর মূল উপকরণ হলো ফুলক্রিম দুধ, ফ্যাট আর চিনি। এই তিন উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে খেলে তো অতটা মজা লাগে না, আইসক্রিমের মতো আরকি। মজাটা আইসক্রিমে যোগ করা হয় কারখানায়।

এবার আসি আইসক্রিম বানানোর আসল প্রক্রিয়ায়। এর পেছনে আছে বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল। আইসক্রিম–গবেষক বা ল্যাবের কর্মীরা গুণগত মান পরীক্ষা করেন। আবার নতুন উদ্ভাবনও করেন। আইসক্রিমের উপকরণসমূহ মানসম্মত প্রক্রিয়ায় এমনভাবে তৈরি করেন, যেন আইসক্রিম খেতে গেলে তোমার মুখটা ভরে যায়, স্বাদে তৃপ্তি আসে।

আইসক্রিমের কারখানায় ল্যাবে গবেষকেরা কাজ করেন। তাঁদের কল্যাণেই আসলে আইসক্রিম খেতে এত ভালো লাগে। আইসক্রিম আসলে রেসিপির কৌশল। গবেষণা করতে করতে এটি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে এটাকে একেবারে শিল্প বলা চলে। কথাটা সব দিক দিয়েই সত্যি। এটা এখন একটা বৃহৎ শিল্প। বৃহৎ শিল্প হওয়ার সব যোগ্যতা এর আছে। বড় বড় মেশিন, শত শত শ্রমিক, সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি, রোবট, আধুনিক প্রযুক্তি—কী নেই এখানে!

পোলারে গিয়ে যেমন দেখলাম, এখানে একটা দারুণ ল্যাবরেটরি আছে। টিভি সিরিজে বা সিনেমায় যেমন ল্যাব দেখা যায়, ল্যাবটা দেখতে অনেকটা সে রকম। ল্যাবটা ঘুরে দেখাতে গিয়ে এর দায়িত্বে থাকা সমীর পাল জানালেন, আইসক্রিমের গুণাগুণ ঠিক রাখতে তিন ধাপে আইসক্রিমের ল্যাব টেস্ট করা হয়।

আইসক্রিমের কাঁচামালের যাত্রাটা কিন্তু কারখানার স্টোরেজ থেকে শুরু হয় না। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে আনা হয় এর দুধ। অন্যান্য উপকরণ দেশের বাইরে থেকেই আসে। আবার ধরো পুরো প্রযুক্তি, তথা মেশিনারিজ আসে ইউরোপ থেকে। অনেকগুলো পক্ষের অনেক রকম সমন্বয়ে আইসক্রিমটা ঠিকঠাক হয়ে তোমার হাতে পৌঁছায়।

ছবি : আব্দুল ইলা

আগেই বলেছি, একটা নিখুঁত আইসক্রিম তৈরি করতে হলে শুধু ফুলক্রিম দুধ, ফ্যাট আর চিনি মিশিয়ে বসিয়ে দিলেই হয় না। এর জন্য রয়েছে মানসম্মত প্রক্রিয়া। আইসক্রিমের সব উপাদান মিক্সিং ট্যাংকে অটোমেটিকভাবে ঢালা হয়। এরপর এগুলো ভালোভাবে মিশিয়ে ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গরম করা হয়। এতে এর মধ্যে যদি কোনো ক্ষতিকর জীবাণু থাকে তা মারা যায়। এই পদ্ধতিকে পাস্তুরাইজেশন বলে। এরপর মিক্সারটিকে হোমজেনাইজার দিয়ে পাস করানো হয়, যেখানে, উপাদানগুলো ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে সমস্বত্ত্ব মিশ্রণ তৈরি করে। যেন, আইসক্রিম ঘন ও মোলায়েম হয়। তারপর মিশ্রণটি ঠান্ডা করে ৪-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে এজিং ট্যাংকে রাখা হয়। এই এজিং ট্যাংক থেকে বিভিন্ন ফ্রিজারের মাধ্যমে ওভাররান যোগ করে আইসক্রিম উৎপাদন করা হয়। এর সঙ্গে বাহ্যিকভাবে বিভিন্ন মজাদার চকলেট, বাদাম, ফ্রুট কিউবস্ এবং ফ্রুট কনসেন্ট্রেট যোগ করে তৈরি করা হয় সুস্বাদু আইসক্রিম।

পোলারের কারখানায় দেখলাম, চলছে বিরাট কর্মযজ্ঞ। মেশিনের পাশে মেশিন। আছে লাইনের পাশে লাইন। রোবটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করছেন মানুষ। ধরো, আইসক্রিম ভরার কাজটি করছে একটি রোবোটিক হাত। মুহূর্তের মধ্যে এই হাত ঠিক আইসক্রিমের ছাঁচের মাঝখানে নিখুঁতভাবে আইসক্রিম ঢেলে দিচ্ছে। তারপর মেশিনের মাধ্যমে তা প্যাকিং হচ্ছে। কিন্তু প্যাক হয়ে আসার পর কাজ করছেন একজন মানুষ। তাঁকে সাহায্য করছেন অন্যরা।

পোলারে গিয়ে যেমন দেখলাম, এখানে একটা দারুণ ল্যাবরেটরি আছে। টিভি সিরিজে বা সিনেমায় যেমন ল্যাব দেখা যায়, ল্যাবটা দেখতে অনেকটা সে রকম। ল্যাবটা ঘুরে দেখাতে গিয়ে এর দায়িত্বে থাকা সমীর পাল জানালেন, আইসক্রিমের গুণাগুণ ঠিক রাখতে তিন ধাপে আইসক্রিমের ল্যাব টেস্ট করা হয়। র৵ান্ডম স্যাম্পলিং করে শুরুতে উপকরণগুলোর মান যাচাই করা হয়। এরপর যখন আইসক্রিম বানানো চলে, তখন একবার টেস্ট করা হয়। এটা খাওয়া হয় না, শুধু রাসায়নিক উপাদানগুলো বিশ্লেষণ করে যাচাই করা হয় মান। যখন আইসক্রিম প্যাকেটজাত করা হয়ে যায়, তখন ল্যাবে আবার পরীক্ষা করা হয়। আমরা যখন আইসক্রিম টেস্ট করার কথা ভাবি, তখন মনে করি, আইসক্রিম বুঝি খেয়ে টেস্ট করা হয়। খাওয়া হয়, তবে একটা পর্যায়ে। আইসক্রিম অর্গানোলেপ্টিক টেস্ট করার জন্য আছে আলাদা টিম।

ছবি : আব্দুল ইলা

তারা আইসক্রিম খেয়ে দেখে এবং জানায়, কেমন অবস্থা আইসক্রিমের। এ তো গেল নিজেদের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য আইসক্রিম পরীক্ষা। এর বাইরে সরকারি প্রতিনিধিরা বাজার থেকে আইসক্রিম সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখেন, আইসক্রিমের অবস্থা কী। আইসক্রিমের গুণগত মান মাপার জন্য তাঁদের মাপকাঠি আছে। এই মাপকাঠিতে আইসক্রিমের অবস্থাটা কী, তা যাচাই করে দেখেন তাঁরা। এসব পরীক্ষা করার একটাই কারণ, তোমার হাতে যেন একটা দারুণ ও ভালো মানের আইসক্রিম তুলে দেওয়া যায়।

আইসক্রিম বানানোর কারখানায় একটা নিয়ম আছে। নিয়মটা ইউরোপিয়ানদের বানানো, প্রযুক্তির মতোই। নিয়মটা হলো, কোনো ব্যাচে যদি কোনো অসুবিধা পায়, পুরো ব্যাচটাই ফেলে দেওয়া হয়। আবার ধরো, একটা মেশিনে বেশ কয়েক রকম আইসক্রিম বানানো যায়। এখন ধরো, তুমি একটা স্বাদের আইসক্রিম চাহিদা অনুযায়ী বানালে, এরপর নতুন স্বাদের আরেকটা আইসক্রিম বানালে। তখন আইসক্রিমের অনন্য স্বাদ টিকিয়ে রাখতে তোমাকে পুরো মেশিন খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে। এই পরিষ্কার করা একটা বিরাট কর্মযজ্ঞ। মেশিনটাকে দুইভাবে পরিষ্কার করা হয়। একটা স্বয়ংক্রিয়; অনেকটা সেমিরোবোটিক। মেশিন নিজেই নিজেকে ধুয়ে নেয় বা গোসল করে ফেলে। আর কর্মীরা এরপর কোল্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে মেশিনটাকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করেন, যেটায় কোনো ফেনা হয় না।

সব ঠিক থাকলে আইসক্রিমগুলো চলে যায় কোল্ড স্টোরেজে। একদম মেরু অঞ্চলের মতো ঠান্ডা জায়গা। মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এবং প্রতিটি আইসক্রিমের প্যাকে সংরক্ষণ নিয়মাবলিতে বলা আছে, মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখুন। আমরাও ঢুকেছিলাম এই বিশালাকার ঘরে। এখানকার দেয়ালগুলো বরফে সাদা। থরে থরে সাজানো আছে বিশালাকার আইসক্রিমের চারকোনা খাঁচা, যার মধ্যে শত শত আইসক্রিম। শক্তিশালী রোবোটিক গাড়ি দিয়ে সেগুলো ওঠানো–নামানো হয়। এই ঘরের ভেতরে ঢোকার জন্য আছে ভারী কোট। পরতে হয় বিশেষ জুতা। এখানে মুহূর্তে সব শুকিয়ে যায়। পাঁচ মিনিটের বেশি এই ঘরে থাকা কঠিন। এত বিশাল ঘর কীভাবে ঠান্ডা করা হয়, এ ব্যাপারে আমার কৌতূহল ছিল। ধরো, একটা ফ্রিজ যেভাবে ঠান্ডা হয়, পুরো আইসক্রিমের কারখানার বিশেষ ঘরগুলো একইভাবে ঠান্ডা করা হয়।

ছবি : আব্দুল ইলা

ঘরটাকে ঠান্ডা করার জন্য ফ্রিজার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। সেটা আলাদা ঘর। ঘরটা বিচিত্র সব যন্ত্রপাতি দিয়ে ভরা। ধরো, যেসব বয়লার বা টিউব আছে, রাস্তায় যে বিশালাকার গ্যাস পরিবহনের গাড়ি দেখো, ওই ঘরের টিউবগুলো ঠিক সে রকম বড়। ঠান্ডা বিশালাকার ঘরের তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখার দায়িত্বটা তো এই সব টিউবকে পালন করতে হয়। কোল্ড স্টোরেজে চার ঘণ্টা থেকে শুরু করে সারা রাত হোল্ড করা বা রেখে দেওয়ার পরই আইসক্রিমের প্যাকেটগুলো তুলে দেওয়া হয় ফ্রিজিং ট্রাকে, যেগুলো চলে যায় দেশের নানা প্রান্তে। সেখান থেকে ডিলার পৌঁছে দেন দোকানে, সুপারমার্কেটে আর আইসক্রিম পারলারে।

আইসক্রিম কারখানায় এমন ব্যবস্থা করা আছে যে এখানে কখনো বিদ্যুৎ যায় না। বিদ্যুৎ চলে যাওয়া মানে আইসক্রিম গলে যাওয়া। এই সংবেদনশীল পণ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা ব্যবস্থা। দোকানে যদি বিদ্যুৎ চলে যায়, আইসক্রিম খুব ভালো অবস্থায় পাবে না তুমি। তাই দোকান থেকে আইসক্রিমের কোন যদি একটু কম ক্রিসপি পাও, তবে জেনে রেখো, এই দোকানে হয়তো বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। অথবা ও, ভালো কথা; কথাটা শুনছিলাম একদম কড়কড়ে নতুন নোটের মতো আইসক্রিমে কামড় দিতে দিতে। আইসক্রিমটা মাত্র কারখানার কোল্ড স্টোর থেকে অফিসে এসেছে। কারখানা থেকে বেরিয়ে আইসক্রিম যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের স্টোরেজে। সেখান থেকে ডিলার আইসক্রিম সংগ্রহ করে দোকানে বা বিক্রেতার হাতে তুলে দেন। কারখানা থেকে আইসক্রিমটা বানিয়েই শুধু বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয় না, এই আইসক্রিম যেন ঠান্ডা থাকে, গুণে–মানে ভালো থাকে, সে উদ্দেশ্যে সারা দেশে রিটেইলারদের আইসক্রিম ফ্রিজ দেয় পোলার।

ছবি : আব্দুল ইলা

আইসক্রিম কারখানাগুলো দিনরাত আইসক্রিম বানায়। বিশেষ করে গরমের সাত–আট মাস। দুই শিফটে কর্মীরা এসব কাজ করেন। তাঁরা শুধু আইসক্রিমই বানান না। নতুন আইসক্রিম এলে খেয়েও দেখেন।

এখন তোমাকে একটা বিচিত্র তথ্য দিয়ে লেখাটা শেষ করি। সবচেয়ে বেশি আইসক্রিম বিক্রি হয় কখন? সহজ উত্তর হলো, গরমকালে। কিন্তু আইসক্রিম সব সময়ের খাবার, এর গুণ ও পুষ্টিমান ভালো থাকায় সারা বছরই খাওয়া যায়। আর সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো আইসক্রিম খেলে মন ভালো হয়। তাই পোলার আইসক্রিম মন ভালোর কথা বলে।

আরও পড়ুন