দম বন্ধ করা ভূতের গল্প 'ওলা ওঠা'
ইদানীং চাকরির ওপর থেকে মনটা একেবারে উঠে গেছে। প্রতিদিন সকালবেলা নয়টায় গিয়ে অফিসে হাজির হই ঠিকই। কিন্তু সেটা নিজেকে ঠেলে নেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। চাকরিটা হয়ে গেছে কলেজের ম্যাথ বইয়ের ক্যালকুলাস চ্যাপ্টারের মতো। বিদঘুটে এই চ্যাপ্টার যেমন খুলতেই ইচ্ছে করত না। কিন্তু নিজেকে জোর করে টেনেটুনে নিয়ে গিয়ে বসা লাগত। কারণ, অঙ্কে পাস তো করা লাগবে। ওই একই ঘটনা এদিকেও। ভালো লাগুক আর না লাগুক, অফিসের পথ তো মাড়ানো লাগবেই।
সারা দিন ভূতের ব্যাগার খাটা লাগে। নিজের কাজ শেষ করেও শান্তি নেই। এদিক-ওদিক থেকে কীভাবে যেন বাড়তি কাজ চলে আসে। আবার কাজ যদি না আসতে চায়, তাহলে কাজের মালিক জোর করে পাঠিয়ে দেয়। এরপর যদি খানিকটা শান্তি মিলত! পোড়া কপালে সেটাও নেই। পান থেকে চুন খসলে ওপর মহল থেকে অপমান, কথা শোনানো তো নৈমিত্তিক ব্যাপার। যেমনটা আজ হলো।
গত সপ্তাহে সরকারের তহবিল থেকে পাঁচ ট্রাক ত্রাণ এসেছিল। সেখানে ধান, গম আর চিনির বস্তা থাকার কথা। আমার দায়িত্ব ছিল এগুলো কালেক্ট করে হিসাব নিয়ে ফাইল জমা দেওয়া আর বস্তাগুলো গোডাউনে তুলে রাখায় তদারক করা। সারা দিন খেটেখুটে সেসব করলাম। আজ শুনি আমার হিসাবে গরমিল আছে; এক ডজনের মতো বস্তা নাকি গায়েব। বস্তার মনে হয় পাখা গজিয়েছিল। তারপর যেখান থেকে এসেছিল, সেখানে ফেরত গেছে।
বড় সাহেবের রুমে ডাকা হলো। তিনি পান চিবুতে চিবুতে একগাদা ব্রতকথা শোনালেন। আমি কলাগাছের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে সেসব শুনলাম। এরপর বের হয়ে সরাসরি মেসে চলে গেলাম। নিকুচি করি এই চাকরির।
সরকারি অফিসের মেস। জায়গাটা পুরো নরকের পৃথিবী সংস্করণ। গিয়ে দেখি দুপুরের খাবার শেষ। গামলায় অল্প একটু কড়কড়া ভাত ছিটিয়ে রয়েছে। আর সবুজ রঙের ডাল। এই জীবনে প্রথম আমি সবুজ রঙের ডাল দেখলাম। একমাত্র এই মেসেই হয়তো এ ধরনের ডাল রান্না করা হয়। আর রান্নার প্রধান উপকরণ খুব সম্ভবত দূর্বাঘাস। সবুজ রঙের ডালের চেহারা দেখে মনে হলো, বাথরুমে না গিয়ে গোসলটা আজ এই পানি দিয়েই সেরে ফেলি।
রুমে গিয়ে হাতব্যাগটাতে দুটো লুঙ্গি আর শার্ট ভরে নিলাম। চাকরি উচ্ছন্নে যাক। আমি যশোরে যাব আজ। গিয়ে দিন তিনেক কাটিয়ে আসি। আমার মন একেবারে উঠে গেছে।
আমার জন্মের সময় মা মারা যায়। বয়স যখন এক বছরও হয়নি, তখন আমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। মা মারা যাওয়ার পর আমার দেখাশোনা করতেন আমার ছোট ফুফু। বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু তাঁর সন্তান ছিল না। আমি গিয়ে তাঁর সেই জায়গাটা পূরণ করলাম। ফুফাও নিজের সন্তানের মতো আমাকে দেখতেন। আস্তে আস্তে বড় হলাম। নিজের মায়ের মুখখানা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ফুফুকেই মা বলে চিনলাম। কিন্তু নিজের জন্মদাতা বাবা কখনো আমার খোঁজ করেননি। বড় হওয়ার পর খোঁজ নিতেও যাননি। আমিও নিজের বাবার কাছে কোনো দিন ফিরতে চাইনি। ফুফু আর ফুফাকেই নিজের মা-বাবা ভাবতাম। আমার বয়স যখন ১১ বছর, তখন ফুফা মারা গেলেন। চলনসই একটা সুন্দর সংসারে দেখতে দেখতে অভাব-অনটন নেমে এল।
হাজারো অভাবের মধ্যে ফুফু আমাকে বড় করেছেন, পড়িয়েছেন, নিজে না খাইয়ে আমাকে খাইয়েছেন। পড়াশোনা শেষ করে আমি সরকারি খাদ্য দপ্তরে চাকরি পাই। পোস্টিং রাজবাড়ী। ফুফু থেকে যান যশোরে। প্রতি মাসে তাঁকে মানি অর্ডার পাঠাই। চিঠি লিখি। ফুফু পড়ালেখা জানেন না। চিঠি লেখাটা অনর্থক। তবু লিখি। মনে করি, আমার লেখা চিঠির স্পর্শ পেয়ে ফুফু আমার স্পর্শ পাবেন। হয়তো গ্রামের কাউকে দিয়ে চিঠিটা পড়াতেও পারেন। যদিও পড়াশোনা জানে, গ্রামে এমন লোকের সংখ্যা হাতে গোনা।
সব হয়, কিন্তু মানুষটার সঙ্গে আমার দেখা হয় না, কথা হয় না। কত দিন যে ওই মুখখানা দেখি না।
রাজবাড়ী থেকে যশোরে সরাসরি যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রথমে পোড়াদহ পৌঁছাতে হবে। সেখান থেকে যশোরের ট্রেন ধরে যশোর জংশন স্টেশন। আর বাঘেরপাড়া উপজেলার ধলগ্রাম ইউনিয়ন পর্যন্ত যাওয়ার জন্য ঠেলাগাড়ি অথবা ভ্যানগাড়িই ভরসা। তবে তা দিনের বেলায়। বেলা ফুরানোর সঙ্গে সঙ্গেই এসবের দেখা আর পাওয়া যাবে না। তখন একমাত্র বাহন নিজের দুখানা পা।
মেস থেকে যখন বের হলাম, তখন বাজে সাড়ে ১২টা। তিনটা চল্লিশের দিকে একটা ট্রেন ছাড়ে পোড়াদহ জংশন থেকে। এরপর আর কোনো ট্রেন নেই। তাই ওটাকেই পাকড়াও করতে হবে। ভাগ্য ভালো। বের হয়ে মেইন রাস্তায় একটা ভ্যানগাড়ি পেয়ে গেলাম। এই ভ্যান আমাকে সূর্যনগর পর্যন্ত নিয়ে যাবে। তারপর অন্য ব্যবস্থা। ভ্যানে করে সূর্যনগর পর্যন্ত তারপর কয়েক মাইল হাঁটা আবার ভ্যান—এমন করে যখন পোড়াদহ পৌঁছালাম, তখন তিনটা পঞ্চাশ বাজে। ট্রেনটা ছেড়ে দেবে দেবে করছে। তাই তড়িঘড়ি করে টিকিট কেটে জানালার পাশে একটা সিট নিয়ে বসে পড়লাম।
চরম খিদে পেয়েছে। সকালে নাশতার পর আর কিছুই পেটে ঢোকেনি। তারপর এই পর্যন্ত আসার ধকল তো আছেই। এই ট্রেন যশোরে ঢুকবে রাত ১০টার দিকে। অত রাতে কোনো গাড়িঘোড়া পাওয়া আর যাবে না। অতএব আবার হণ্টনযাত্রা। তাই ট্রেন কোথাও থামলে কিছু একটা খেয়ে নিতে হবে।
ট্রেন যশোরে পৌঁছাল রাত দশটা বিশে। পাক্কা ২০ মিনিটের লেট। একমাত্র আমি যশোরে নামলাম। আমার বগিসহ প্রতিটা বগি খালি। একটা কুকুরের দেখাও পেলাম না যশোর স্টেশনে। সাড়ে ১০টা বেশ গভীর রাত। কিন্তু স্টেশনে তো মানুষ থাকবে, নাকি! স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম। টিকিট কাউন্টারে এক লোক চাদর গায়ে দিয়ে জবুথবু হয়ে বসে আছে। অন্যদিকে বেঞ্চে কাঁথা মুড়ি দিয়ে আরেকজন ঘুমাচ্ছে। পুরো স্টেশন খাঁ খাঁ করছে, মানুষ বলতে আমিসহ তিনজন।
যা ভেবেছিলাম তা–ই। মানুষের দেখা নেই, গাড়ি কোথা থেকে আসবে! অগত্যা হাঁটা ধরলাম। স্টেশন থেকে ধলগ্রামের দূরত্ব মাইল পাঁচেক। স্টেশনের পর থেকে আশপাশে বসতি কম। শুধু জংলা জমি আর চাষের খেত। এরপর মূলত গ্রাম শুরু হয়। স্টেশন থেকে পাঁচ মাইল হাঁটার পর ডান দিকে আরেকটা রাস্তা পড়ে, সেটা ধরে এগিয়ে গেলেই আমাদের গ্রাম। এই রাস্তাটা পুরোটাই মাটির।
হাঁটা শুরু করলাম। চারদিকে যেমন অমাবস্যার অন্ধকার দেখছি, তাতে কোনো খানাখন্দের মধ্যে আছাড় না খেলেই হয়।
পাকা রাস্তা ফেলে মাটির রাস্তায় ঢুকেছি বহুক্ষণ হলো। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই অন্ধকারের মধ্য দিয়ে হাঁটছি তো হাঁটছি; পথ আর ফুরায় না। ঘড়িতে দেখলাম প্রায় দুটো বাজে। কাহিনি কী! পাঁচ মাইলের মতো রাস্তা যেতে এত সময় তো লাগার কথা না। হাঁটা বাদ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চারপাশে ব্যাঙ ডাকার শব্দ। হু হু করে ঠান্ডা বাতাস বইছে। টর্চের আলো চারদিকে ফেলে বোঝার চেষ্টা করলাম, কোথায় আছি। অন্ধকার ভেদ করে টর্চের আলো বেশি দূর যাচ্ছে না। বুঝলাম গ্রামে ঢুকে পড়েছি। শুধু ঢুকিইনি, হেঁটে একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। কারণ, গ্রামের শেষের দিকে চাষের জমি শুরু। তারপর বিল। কিন্তু গ্রাম পার করে চলে এলাম, বুঝতে পারলাম না কেন! কোথাও কোনো আলো নেই। একটা হারিকেনের আলোও কোথাও চোখে পড়ল না।
আবার পেছন ঘুরে হাঁটা শুরু করলাম। মাঠ পার করে আসতেই ব্যাঙের ডাক কমে গেল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। শুধু আমার হাঁটার শব্দ। হাতের টর্চটা খুব একটা কাজে লাগছে না। মনে হচ্ছে আশপাশের জমাটবাঁধা কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে টর্চের আলো। কিন্তু এই বর্ষাকালে কুয়াশা আসবে কোথা থেকে? আমি আবার হেঁটেই চলেছি। কিছুক্ষণ পর আবার ব্যাঙ ডাকার শব্দ। হাঁটা থামিয়ে দিলাম এখন। ব্যাঙের আওয়াজ আর বাতাস বয়ে যাওয়ার একরকম শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দের অস্তিত্ব নেই। বুঝতে পারলাম, আবার গ্রামের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি আমি। ব্যাপারটা ঠিক হজম হলো না।
গ্রামের মাঝখান দিয়ে একটাই বড় রাস্তা। একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। তাই ভেতরের রাস্তা ছাড়া এই বড় রাস্তা দিয়ে আবার গ্রামের শেষ প্রান্তে আসার সুযোগ নেই। আমি তো উল্টো ঘুরেই আবার হাঁটা শুরু করেছিলাম। অন্য কোনো রাস্তায় ঢুকিনি। তাহলে এখানে আবার কীভাবে এলাম?
খিদে লেগেছে খুব। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কিন্তু...বুঝতে পারলাম না কিছু। এদিকে টর্চের ব্যাটারিও মনে হয় শেষের দিকে। আলো কমতে শুরু করেছে। এমনিতেই গোলকধাঁধার মতো ঘুরপাক খাচ্ছি, টর্চ নিভে গেলে তো ভয়াবহ বিপদে পড়ব।
মাথাটা ঠান্ডা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ব্যাগে পানির বোতল ছিল, বের করে দেখি, অল্প একটু পানি আছে। দুই ঢোঁকের মতো হবে। তবু এইটুকু পানি খেয়ে এখন খানিকটা ধাতস্থ লাগছে। টর্চ জ্বালিয়ে ভালো করে বুঝে নিলাম এখন কোথায় আছি।
আচ্ছা, গ্রামের শেষ প্রান্তে। এরপর মামুদকাটি গ্রাম। এখন আমাকে আবার পেছন দিকে মিনিট পাঁচেক হাঁটতে হবে। রাস্তার পাশেই গ্রামের পাকা মসজিদ। মসজিদের পাশ দিয়ে একটা মাটির রাস্তা। এই রাস্তা ধরে এগোলেই আমাদের বাড়িটা।
ধীরে ধীরে পা ফেলছি। বোঝার চেষ্টা করছি অন্ধকারে ভুল দিকে আবার যাই কি না। হুট করে মনে হলো, আমার পেছন পেছন অনেকগুলো মানুষ একসঙ্গে হাঁটছে। পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। একসঙ্গে অনেক মানুষ হাঁটলে যেমন শব্দ শোনা যায়, ঠিক তেমন। আমার গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে গেল। টর্চের ব্যাটারি ততক্ষণে শেষের দিকে। অনেক কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে কোনোমতে পেছনে ঘুরলাম। পেছনে কেউ নেই। খালি অন্ধকার আর অন্ধকার। টর্চের নিবু নিবু আলোতে চারপাশটা দেখার চেষ্টা করলাম। সে আলোতে দেখলাম, রাস্তার পাশে মোটা ধরনের এক খেজুরগাছ। সেদিকে আলো ফেলতেই স্যাত করে কেউ একজন গাছের আড়ালে ঢুকে গেল।
‘কে? ওইখানে কে?’ ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। এই মোটা খেজুরগাছটা মসজিদের কাছেই। তার মানে মসজিদ আর খুব বেশি দূরে নেই।
বৃথা চেঁচালাম, কোনো জবাব এল না। টর্চের আলো নিভে যাবে এখন।
‘কথা বলে না কেন? কে ওইখানে? বাইর হ বলতেছি।’ বলতে বলতে এগিয়ে যেতে থাকলাম আমি। খেজুরগাছের ওপাশে খচমচ শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা হুটোপুটি করছে সেখানে। ঠিক তখনই পেছন থেকে আমার হাত ধরে কেউ হ্যাঁচকা টান দিল। হাত থেকে টর্চ পড়ে গেল। কোনোমতে সামলে নিয়ে পেছনে ঘুরতেই দেখি আমার ফুফু। হাতে হারিকেন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই সাদা চুল, মলিন শাড়ি গায়ে।
‘ফুফু! তুমি এখানে?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
ফুফু কোনো জবাব দিলেন না। হারিকেনের হলদে আলোয় সোজা তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
‘তুমি এত রাতে এইখানে কীভাবে এলে?’ আবার প্রশ্ন করলাম।
‘তোকে নিতে এলাম। আয়, আমার সঙ্গে আয়।’ ফুফু এসে আবার আমার হাত ধরলেন। হাতটা বরফের মতো শীতল। আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল।
আমি টর্চটা উঠিয়ে ফুফুর সঙ্গে শুধু একটা মোড় ঘুরলাম। তারপর দেখলাম, আমাদের সেই মাটির বাড়ি। মাত্র এক মিনিট হেঁটে কীভাবে এত দ্রুত চলে এলাম, বুঝতে পারলাম না।
উঠানে এসে তিনি থামলেন। ‘তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল, ফুফু। তাই চলে এলাম। কিন্তু তুমি কীভাবে জানলে যে আজ আমি আসব?’
ফুফু আমার কথার উত্তর দিলেন না। সামান্য একটু হাসলেন শুধু।
‘পানি খাওয়াও একটু।’
‘তুই এখানেই দাঁড়া। আমি নিয়ে আসতেছি,’ বলে ফুফু ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন।
আমি তখন টর্চটা হাতের ওপর বাড়ি মারছি। আর সুইচটা অন–অফ করে যাচ্ছি। সেদিন ব্যাটারি লাগালাম। আজই চার্জ শেষ হওয়ার তো কথা নয়। যদিও অনেকক্ষণ ধরেই জ্বলছে টর্চটা।
‘এই নে,’ ফুফুর কণ্ঠস্বর।
সামনের মাটির বারান্দায় গিয়ে বসলাম আমি। হাতে কাঁসার বড় গ্লাস। চুমুক দিতেই বুঝলাম, গুড়ের শরবত। খানিকটা লেবুও দেওয়া হয়েছে। একনিশ্বাসে গ্লাস খালি করে ফেললাম। গ্লাসটা পাশে রেখে আবার টর্চটা সজোরে মাটিতে বাড়ি মারলাম একবার। এবার বেহায়া টর্চ কথা শুনল, জ্বলে উঠল। আগের মতো উজ্জ্বল আলো নয়, তবে কাজ চালানোর মতো। সেই আলোতে ফুফুকে এবার পুরোপুরি দেখতে পেলাম।
হাতে হারিকেন নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কিন্তু তাঁর পা মাটিতে নেই, এক হাত ওপরে থেকে শূন্যে ভাসছেন তিনি।
আমি তড়াক করে উঠতে গিয়ে বারান্দার শণের চালের সঙ্গে গুঁতা খেয়ে বসে পড়লাম আবার। এরপর কোনোমতে নিজেকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলাম পেছনের দিকে। একসময় মাটির দেয়ালে ঠেকল আমার পিঠ।
‘আনোয়ার, তুই ভয় পাসনে। তুই ভয় পাসনে,’ ফুফু বলে উঠলেন।
আমার মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। গলা থেকে একটা শব্দও বের হলো না।
ফুফু এগিয়ে এলেন আমার দিকে।
‘আমার কথা শোন তুই। এই গ্রামের কেউ বেঁচে নেই। আমরা কেউ বেঁচে নেই। ওলা ওঠা পুরো গ্রাম শেষ করে দিয়ে গেছে। তুই ভয় পাসনে। আমি তোর ক্ষতি হতে দিতাম না।’
আমি বারান্দা থেকে নেমে এলাম। ফুফু আমার দিকে এগিয়ে এসে হাত ধরলেন। ঠান্ডা সেই হাতের স্পর্শ। হারিকেনের আলোয় খেয়াল করলাম, তাঁর চোখে বেয়ে অঝোরে পানি পড়ছে।
‘তুই চলে যা। এক্ষুনি চলে যা। তুই আর এদিকে আসিসনে। কোনো দিন আসিসনে।’
ফুফু আমার হাত ধরে হাঁটতে শুরু করলেন। ‘গ্রামের মানুষ খুব কষ্ট পেয়ে মরেছে। ওলা ওঠার কষ্ট, না খাওয়ার কষ্ট। কেউ দেখতে আসেনি একবার। এক গ্লাস পানি খাওয়ানোর মানুষ ছিল না পাশে। খবর পেয়েও আত্মীয়স্বজন পর্যন্ত খোঁজ নেয়নি। প্রচণ্ড রাগ আর ক্ষোভ নিয়ে মরেছে সবাই। জীবন্ত কেউ এখানে এলে আর বাঁচতে দেবে না কেউ। জ্যান্ত ছিঁড়ে খাবে।’
আমার আবার মনে হতে লাগল, আমার পেছনে শ খানেক মানুষ হাঁটছে। আমাকে ধরার চেষ্টা করছে। পেছনে অনেক চিৎকার–চেঁচামেচি। কেউ হাসছে, কারও কান্নার আওয়াজ। কারও প্রচণ্ড চিৎকার। যেন কেউ তার কলজেটা খুবলে খাচ্ছে।
ফুফু আমাকে গ্রামের মাথায় নিয়ে এলেন। যেখান থেকে পাকা রাস্তা শুরু, ঠিক সেখানে। হারিকেনটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘আনোয়ার, তুই চলে যা। একদম সোজা হেঁটে চলে যাবি। ভুলেও পেছনে তাকাবি না। আমি এখানে আছি। কেউ তোকে কিছু করতে পারবে না। যা বাবা।’
‘ফুফু, আমার ব্যাগটা বারান্দায় পড়ে আছে। তোমার জন্য ওই ব্যাগে একটা শাড়ি ছিল। তুমি শাড়িটা দেইখো; তোমার পছন্দ হয় কি না। আমি অনেক শখ করে কিনে রাখছিলাম।’
ফুফু হাসলেন। চেহারাটা কেমন শুকিয়ে গেছে। শুষ্ক চামড়া লেগে গেছে মুখের সঙ্গে। হাসিটা এখন আর মুখে মানাচ্ছে না। কুৎসিত দেখাচ্ছে তাঁকে।
‘আনোয়ার, বাপ আমার, তুই চলে যা। তুই কিন্তু ভুলেও কোনো দিন এই গ্রামের সীমানার ধারেকাছেও আসবি না।’ বলে ফুফু আমাকে আলতো করে ধাক্কা দিলেন। ‘ভয় নাই। আমি আছি। কেউ তোরে কিছু করতে পারবে না।’
আমি হাঁটতে শুরু করলাম। রীতিমতো চোখ–কান বন্ধ করে হেঁটে চলেছি। পেছনে আবার মানুষের হাঁটার শব্দ, যেন তাল মিলিয়ে হাঁটছে আমার সঙ্গে। মাঝেমধ্যে আবার গগনবিদারী চিৎকার। হাসি অথবা কান্নার আওয়াজ। কিন্তু কোনটা হাসি আর কোনটা কান্না, ঠিক আলাদা করতে পারলাম না। হয়তো সবই কান্নার আওয়াজ। আমার নাম ধরে ডাকল অনেকে। একবার নারীকণ্ঠে, আবার পুরুষকণ্ঠে কেউ। সেই কণ্ঠও আবার নানা রকমের; মোটা গলা থেকে নাকি সুর—বাদ নেই একটাও।
আমি প্রাণপণে হেঁটে চলেছি। শব্দটা বাড়ছে, যেন সোজা মস্তিষ্কে এসে আঘাত করছে। তারপর হুট করে সব শব্দ থেমে গেল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। আমি চোখ খুললাম। দেখি বড় রাস্তায় উঠে এসেছি। আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলাম। এখন গ্রামের সীমানার বাইরে চলে এসেছি। মিনিট দুয়েক সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম। এরপর, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছনে ফিরলাম।
পেছনে তখন কেউ নেই। শুধু জমাটবাঁধা অন্ধকার।