প্রাচীন মিসরীয়রা কি শুধু পিরামিড বানিয়েছিল
মিসরের কথা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মরুর মধ্যে বিশাল আকারের পিরামিড ও মমির ছবি। বিষয়টি এখন অনেকটা এমন হয়ে গেছে যে হাজার হাজার বছর ধরে মিসরীয়রা শুধু বিশাল সব পিরামিড ও সমাধি তৈরি করেছে। কিন্তু সত্যিই কি তা–ই?
আসলে এই ধারণা একদম ভুল। পিরামিড তৈরির পাশাপাশি প্রাচীন মিসরীয়দের ছিল এমন কিছু অবিশ্বাস্য আবিষ্কার, যা নিয়ে এখন তেমন আলোচনা হয় না। চিকিৎসা থেকে শুরু করে প্রসাধনী ও কৃষিকাজ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের নানা জিনিসে তাদের অবদান ছিল।
পিরামিডের মতো বিশাল স্থাপনা ছাড়া প্রাচীন মিসরীয়রা আরও অনেক কিছু তৈরি করেছিল। তারা পাহাড়ের ওপর আগুন জ্বালিয়ে জাহাজগুলোকে সাগরের বিপজ্জনক পাথরের ব্যাপারে সতর্ক করত। আর এভাবেই জন্ম হয়েছিল বাতিঘরের ধারণা। প্রাচীন মিসরীয়দের তৈরি সবচেয়ে বিখ্যাত বাতিঘরগুলোর মধ্যে একটি হলো আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত ফারোস বা আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর। এটি মিসরে খ্রিষ্টপূর্ব ২৮০ অব্দে নির্মিত হয়েছিল, যা সেই সময়ের অন্যতম সেরা স্থাপত্যকর্ম ছিল।
এমনকি প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতার এই বাতিঘরকে প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হতো। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মৃত্যুর পর মিসরে যে টলেমীয় রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাদের উদ্যোগেই এটি নির্মিত হয়। ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ২৮০ থেকে ২৪৭ সালের মধ্যে টলেমি দ্বিতীয় ফিলাডেলফাসের রাজত্বকালে এর নির্মাণকাজ শুরু ও শেষ হয়েছিল।
এই বাতিঘরের উচ্চতা ছিল সত্যিই অকল্পনীয়। এর আনুমানিক মোট উচ্চতা ছিল কমপক্ষে ১০০ মিটার বা ৩৩০ ফুট। এই বিশাল উচ্চতার কারণেই বহু শতাব্দী ধরে এটি ছিল মানুষের হাতে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু কাঠামোগুলোর মধ্যে একটি। এর প্রধান কাজ ছিল আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরের দিকে আসা সমুদ্রযাত্রীদের জন্য এক স্থায়ী আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করা; যাতে রাতেও তারা বন্দর সহজে খুঁজে নিতে পারে।
বাতিঘরের মাথায় ২৪ ঘণ্টা আগুন জ্বালানো থাকত। যার আলো বহুদূর থেকে দেখা যেত। দিনের বেলায় আলো প্রতিফলিত করার জন্য এতে একটি বিশাল আয়না ব্যবহার করা হতো, যা সূর্যের আলো দিয়ে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের জাহাজে সংকেত পাঠাতে পারত। এর ভেতরে থাকা একটি জটিল যান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে জ্বালানি ওপরে তোলা হতো। রাতের বেলায় আগুনের তীব্র শিখা দূর সমুদ্রের নাবিকদের পথ দেখাত এবং জাহাজের নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করত।
বহু শতাব্দীর গর্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর এই বিশাল বাতিঘরটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়। ৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিনটি ভয়াবহ ভূমিকম্পে বাতিঘরটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একসময় এটি পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়।
তবে ধ্বংসের মুখেও এটি ছিল এক বিস্ময়। হ্যালিকারনাসাসের সমাধিসৌধ ও আজও টিকে থাকা গিজার গ্রেট পিরামিডের পরেই এটি ছিল তৃতীয় দীর্ঘতম টিকে থাকা প্রাচীন আশ্চর্য। এটি আংশিকভাবে ১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। অবশেষে এর ধ্বংসাবশেষের শেষ পাথরটুকুও তুলে নেওয়া হয় এবং সেই একই স্থানে কাইতবে দুর্গ (Citadel of Qaitbay) নির্মাণের জন্য ব্যবহার করা হয়। এভাবেই ইতিহাসের পাতা থেকে বিলীন হয়ে যায় আলেকজান্দ্রিয়ার সেই বাতিঘর।
ঐতিহাসিক পতন ঘটলেও বাতিঘরটি কিন্তু পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। ১৯৯৪ সালে ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দল আলেকজান্দ্রিয়ার পূর্ব বন্দরের পানির নিচে ডুব দিয়ে সাগরের তলদেশে বাতিঘরের বেশ কিছু ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করে। হাজার বছরের বেশি সময় ধরে পানির নিচে থাকা এই পাথরগুলোই প্রাচীন প্রকৌশলের সাক্ষী বহন করছে।
পরবর্তী সময় ২০১৬ সালে মিসরের পুরাকীর্তি মন্ত্রণালয় একটি দারুণ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তারা ফারোসসহ প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়ার ডুবে থাকা সব ধ্বংসাবশেষকে একত্র করে পানির নিচে জাদুঘর নির্মাণ করার উদ্যোগ নেয়। চলতি বছর বাতিঘরের ডিজিটাল পুনর্গঠন প্রচেষ্টায় সহায়তা করার জন্য এর প্রবেশপথের কিছু অংশ, পাথর ও ভিত্তিপ্রস্তর কম্পিউটার গ্রাফিকস বা মডেলিংয়ের মাধ্যমে নতুন করে তৈরি করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে এই প্রাচীন স্থাপত্যের আসল রূপটি ফুটিয়ে তোলা।
প্রাচীন মিসরীয়রা কেবল বিশাল সমাধিই তৈরি করেনি; বরং তারা এমন সব প্রযুক্তিরও জন্ম দিয়েছিল, যা আজও আমাদের অবাক করে। আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর ছিল তাদের সেই অসাধারণ উদ্ভাবনী দক্ষতারই একটি উদাহরণ, যা পিরামিডের মতোই তাদের জ্ঞানের গভীরতা ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সাক্ষ্য বহন করে।
সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ইজিপ্ট ট্যুরস পোর্টাল