আমের রাজনীতি, আমের অর্থনীতি

গাছ থেকে আম পাড়ছেন চাষি

বিশেষ জেলার বিশেষ আম

বাংলাদেশের কিছু জেলার আম বিখ্যাত। তার মানে এই নয় যে সে সব জেলায় শুধু ওই বিশেষ ধরনের আমই পাওয়া যায়। অন্যান্য আমও পাওয়া যায় জেলাগুলোতে।

বাংলাদেশের আমের রাজধানী নামে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এখানকার হিমসাগর, ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাতি আম বিখ্যাত। রাজশাহীর গোপালভোগ আম জনপ্রিয়। এখানকার রানীপছন্দ আমও বেশ নাম কুড়িয়েছে। গোপালভোগ ও মিছরিভোগ ছাড়াও দিনাজপুরের ছাতাপড়া আমের আলাদা খ্যাতি আছে। সাতক্ষীরার গোবিন্দভোগের স্বাদ আলাদা। নওগাঁর নাম করা আম রাজলক্ষ্মী। মেহেরপুরের জনপ্রিয় আম বোম্বাই। রংপুর জেলায় পাওয়া যায় বিশেষ আম হাঁড়িভাঙা। তবে বিশেষ একটা জেলার কথা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁওয়ের সূর্যপুরী আম অন্য জেলায় পাওয়া যায় না।

বিখ্যাত সব আমের ভক্তরা

দু–একজন ছাড়া সারা বিশ্বের প্রায় সবাই আমের ভক্ত। ইতিহাসে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি আমের ভক্ত ছিলেন, আর তাঁরাই আমকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছেন। এই তালিকায় সবার প্রথমে রয়েছেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। ভারত বিজয় করে তিনি আম খেয়ে এতটাই মুগ্ধ হন যে ফেরার পথে ইউরোপে আম নিয়ে যান। শোনা যায়, আমকে ইউরোপে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং ভারতে এসে আমের প্রেমে পড়ে যান। তিনি আমকে চীনে নিয়ে যান। ঐতিহাসিকেরা বলেন, দিল্লির সুলতানদের অনেকেই নিজেরা সিংহাসনে বসে আমকে রাজকীয় ফলের আসন দিয়েছিলেন। এর মধ্যে সবার আগে নাম করতে হয় আলাউদ্দিন খিলজির। তিনি আমকে রাজমহলে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।

সমরখন্দ থেকে জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর দিল্লি দখল করে সেখানে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকে বলেন, আমের লোভে নাকি বাবর হিন্দুস্তান দখল করেন। শেরশাহ সুরি নামে এক আফগান বীরের কাছে তাঁর পুত্র হুমায়ুন যুদ্ধে হেরে যান। এই যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল চোষা নামের এলাকায়। আমপ্রেমী শেরশাহ এই যুদ্ধের স্মৃতিতে এক আমের নাম রেখেছিলেন চোষা আম। অপর দিকে পরাজিত বাদশাহ হুমায়ুন কিন্তু আমবিদ্বেষী ছিলেন না। তাঁর পছন্দের আমের নাম তাঁর নামেই পরিচিত। সে আমের নাম হুমায়ুনপছন্দ।

হুমায়ুনের পুত্র বাদশাহ আকবর আমের এতটাই ভক্ত ছিলেন যে তাঁর নির্দেশে বিহারের দ্বারভাঙায় একটা আমের বাগান তৈরি করা হয়েছিল। এই বাগানে এক লাখ আমগাছের চারা রোপণ করা হয়েছিল বলে এই বাগানের নাম লাখিবাগ।

আমের রাজনীতি

আমকে কূটনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রথম ব্যবহার করেন একজন মোগল রাজকন্যা। বাদশাহ শাহজাহানের কন্যা জাহানারার সঙ্গে তাঁর ভাই বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সম্পর্ক মোটেও ভালো ছিল না। এই সম্পর্ককে সহজ করার জন্য জাহানারা তাঁর ভাইকে আম উপহার দেন। সেই সঙ্গে দেন আম খাওয়ার দাওয়াত। আওরঙ্গজেবও সম্পর্ক সুন্দর করার জন্য ইরানের শাহকে আম পাঠিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে আম উপহার দিতেন।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে আম উপহার দিয়ে থাকেন।

ফল ছাড়াও আম

আমের চাটনি, আমের সস

আমের মোরব্বা, আমের রস।

আমকে কেবল ফল হিসেবে নয়, নানান ভাবে খাওয়া যায়। আমকে শুকিয়ে আমসত্ত্ব বানানো হয়, হিন্দিতে এর নাম আমপাঁপড়। কাঁচা আম মাখিয়ে খান অনেকেই, যাকে কেউ কেউ বলে থাকেন আমমাখা কিংবা আমভর্তা। আমের মিষ্টি, টক, ঝাল আচার পছন্দ করেন না, এমন খুব কম মানুষই আছেন। আমের মোরব্বা এ দেশের অত্যন্ত প্রিয় এক খাবার।

ভারতের লাক্ষ্ণৌতে পাওয়া যায় আমের জিলাপি। গুজরাটে বানানো হয় কেরু নু শাক নামের রান্না। ভারতের গোয়ায় আম দিয়ে বানানো হয় ম্যাঙ্গো সাসাভ। কেরালায় গেলে খেতে পাওয়া যাবে চিমিন ম্যাঙ্গো। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে পাওয়া আম দিয়ে বানানো আভাকাই। এই অন্ধ্র প্রদেশেই পাওয়া যায় আম দিয়ে বানানো কেরি পোলাও। তামিলনাড়ুতে রান্না হয় আমের ভাডু মাঙ্গাই।

আর বাংলাদেশে খেতে পাওয়া যাবে আমডাল।

উপমহাদেশের বাইরে ইরাকে রান্নায় আমের ব্যবহার হয়। সেখানে অনেক মুসলিম ও ইহুদি রান্নায় আম একটি উপাদান। যেমন ফালাফেল, শর্মা ও মাছ রান্নায় অনেক সময় আম ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

আমগাছ নিয়ে কিছু তথ্য

আমগাছে যত মুকুল ধরে, তার মাত্র ১ শতাংশ আমে পরিণত হয়।

আমগাছ আকারে অনেক বড় হতে পারে। এটা সাধারণত ৯০ থেকে ১৩০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।

আমগাছ অনেক দীর্ঘজীবী হয়। সাধারণত কিছু কিছু আম গাছ ৩০০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে, এমনকি ফলও দিতে পারে।

বৃক্ষরোপণের চার থেকে সাত বছরের মধ্যে

একটি আমগাছে মুকুল ধরে। একটি আমগাছে বছরে একবারই মুকুল ধরে, যার মানে, একটি আমগাছে বছরে একবার আম ধরে, তবে সদাবাহার নামে একধরনের আমগাছে বছরে দুবার আম ধরে।

২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

আরও পড়ুন