গানের বুলবুলিরা হারিয়ে গেছে, কোথায় খুঁজে পাই?
কী লিখব , কীভাবে লিখব কিছুই বুঝতে পারছি না ! কথারা যেন আজ কোথায় হারিয়ে গেছে! ফেসবুকে চোখ রাখতে পারি না, টেলিভিশন দেখতে পারি না, পত্রিকার পাতা খুলতে পারি না। সর্বত্রই শুধু হাহাকার আর আর্তনাদ। রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে ২১ জুলাই ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার বীভৎসতা যেন স্তব্ধ করে দিয়েছে পুরো দেশকে। ট্র্যাজেডির পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে, ফুটেজে সর্বত্র যেন নিজেদের সন্তানদের দেখতে পাচ্ছি। পুরো স্কুল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুড়ে যাওয়া বইয়ের পাতায়, ভেঙে যাওয়া ফ্লাস্কে, খসে পড়া স্কুলের পোশাকে কিংবা জুতার ফিতায়, উড়ে যাওয়া পেন্সিলে, বেঁকে যাওয়া কলমে, আধখাওয়া টিফিন বক্সের খাবারে সর্বত্র যেন নিজের সন্তানদের স্পর্শ খুঁজে পেয়েছি। জানি এই অনুভূতি আমার একার নয়। বিশেষ করে যারা আমাদের মতো স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীর মা-বাবা তাদের অনেকেই জন্যই সময়টি দুঃস্বপ্নের মতো অভিশপ্ত। নানারকম আশঙ্কা যেন কুরে কুরে খাচ্ছে আমাদের। পুরো বাংলাদেশ আজ শোকাহত, স্তব্ধ, ব্যথিত। যেন গোরস্তান কিংবা শ্মশানের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে চারিদিকে।
আমাদের শিশুরা, আমাদের গানের বুলবুলিরা হারিয়ে গেছে। কিন্তু তাদের তো এখন হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিল না। ওদের কোনো শ্রান্তি কিংবা ক্লান্তি ছিল না। ওরা ছিল ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম আর ঝরনার মতো চঞ্চল। তবু কেন ওদের এভাবে হারিয়ে ফেললাম আমরা? এই শিশুদের মৃত্যুর দায় আমরা কাদের দিব? যখন ঘাতক একজন কিংবা একাধিক হন, তাদের গ্রেফতারের জন্য, কিংবা বিচারের আওতায় আনার জন্য দাবি তোলা যায়। কিন্তু একটি দেশের পুরো শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক চর্চা যখন ঘাতকে পরিণত হয়, তখন সে ঘাতককে ধরবে কে? আর সেই ঘাতককে রুখবেই বা কে?
দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ শিশু। অথচ সেই শিশুরাই এই দেশে সবচাইতে উপেক্ষিত। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বলে আখ্যা দিয়ে শিশুদের বর্তমান চাহিদা আর অধিকারগুলো সবসময়ই এড়িয়ে গেছি আমরা। এদেশে গণপরিবহনে কিংবা রাস্তাঘাটে অভিভাবকের হাত গলে শিশুরা একবার হারিয়ে গেলে সেই শিশু আর কখনো ফিরে আসবে সেই নিশ্চয়তা নেই। এখানে শিশুদের জন্য নেই পুষ্টিকর খাবার, খেলার মাঠ, বিনোদনের আয়োজন । আছে শুধু রাশি রাশি বইয়ের বোঝা; কিন্তু নেই শিক্ষার গুণগত মান। প্রতি বছর এখানে হাজার হাজার শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, পরিণত হওয়ার আগেই জোর করে শিশুর বিয়ে দেয়া হয়। সড়কপথে স্কুলগামী শিশুদের দুর্ঘটনার শিকার হওয়া এখানে নিত্যদিনের বিষয়। সড়কপথে নেই প্রয়োজনীয় সড়ক বিভাজন, ফুট ওভারব্রীজ, পথচারী পারাপারের চিহ্ন। যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো এদেশে গড়ে উঠেছে স্কুল কিংবা কোচিং সেন্টার। এইসবের অনুমোদন কারা, কীভাবে দেয় সেইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বিপদ অনেক।
শিশুরা ঘণ্টার পর ঘণ্টার ট্র্যাফিক জ্যাম ঠেলে, বখাটেদের চোখ এড়িয়ে, নিরাপত্তার দাবির সঙ্গে সন্ধি করে রোজ স্কুলে যোগ দেয়। কিন্তু সেখানেও মেলে না নিরাপত্তা। আমরা বড়রা শিশুদের নিরাপত্তাকে থোরাই কেয়ার করি। আমরা মহানগরের আকাশটাকেও নিজেদের স্বার্থে বন্ধক রেখেছি। কবে কখন আকাশ ফুঁড়ে বিমান মর্ত্যে নেমে আসবে সেই চিন্তায় নিজেদের লাভের খাতা বন্ধ রাখা যায় কি?
এদেশে হাজার কোটি টাকার মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়িত হয়, বিভিন্ন দিবস উদযাপনে শত শত কোটি টাকা খরচ করা হয়, হাজারো ড্রোন ফুটিয়ে রাতের অন্ধকার আকাশকে দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল বানানো যায়; কিন্তু যে শিশুদের পেছনে বিনিয়োগ করলে ভবিষ্যতে হাজারো মেগাপ্রকল্পের চেয়ে বেশী শক্তিশালী প্রকল্প বাস্তবায়নের ভিত্তি রচিত হতে পারে সেই শিশুদের জন্য বিনিয়োগ করা হয় না। ৪০ মিলিয়ন শিশুর এই দেশে নেই শিশুদের জন্য আলাদা কোনো অধিদপ্তর। নারীর সঙ্গে অতিরিক্ত ‘শিশু’ শব্দ যোগে গঠিত ‘মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ সব সরকারের সময়ই সবচাইতে অবহেলিত ও দুর্বল মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃতি পায়। অনেক সংস্কারে দাবির ভিড়ে শিশু বিষয়ক সংস্কার কমিশনের দাবিটি সামনেই আসে না।
বছর পেরিয়ে যুগ চলে যায়, রাজা আসে রাজা যায় কিন্তু শিশুদের ন্যূনতম অধিকারটুকু অধরাই রয়ে যায়। জানি না কোথায়, কার কাছে সমাধান চাইব আমরা? কাউকে আর ভরসা করতে পারি না আমরা। আশাবিহীন জীবন বড় কষ্টের। সন্তানগুলো ছাড়া আর আমাদের আর কোনো আনন্দের উৎস নেই এ দেশে। এই রাষ্ট্রের কাছে আর কিছু চাইনা; অন্তত আমাদের সন্তানদের বাঁচতে দিন। ওদের জীবন নিয়ে অন্তত রাজনীতি করবেন না। মৃত্যুর পর হাসপাতালের আইসিইউ রাজনীতির শো ডাউন না দিয়ে বেঁচে থাকতে স্কুলের আঙ্গিনায় ওদের প্রাণবন্ত উজ্জ্বল উপস্থিতি নিশ্চিত করুন। দয়া করে একবার শুনুন ওরা কী চায়? ওদের চাওয়া আমাদের বড়দের চাওয়ার মতো স্বার্থের রাজনীতিতে মাখানো নয়। ওদের চাওয়া খুব কম। শিশুরা শুধু বাঁচতে চায়, নিজের নিরাপত্তাটুকু চায়; যেন নির্বিঘ্নে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে পারে। ওরা পড়ালেখা চালু রাখতে চায়, স্কুল শেষে নিরাপদে মা-বাবার কোলে ফিরে যেতে চায়। সামান্য এই চাওয়াটুকু পূরণ করতে না পারলে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় থেকে কী লাভ? আমার মনে হয় শিশুদের অভিসম্পাতে একদিন তলিয়ে যাব আমরা সবাই। যেই দেশে আমরা শিশুদের সামান্য নিরাপত্তাটুকু দিতে পারি না, অভিশপ্ত সেই দেশ।