১৭ বছর বয়সে আকাশে ওড়ার স্বপ্নপূরণ আহনাফের

পরিবারের সঙ্গে আহনাফ

‘যে মুহূর্তে আমি আকাশে উড়োজাহাজ ওড়ানোর বেসরকারি পাইলট সনদ পেলাম, তখন আমি এক দিকে খুবই নার্ভাস ছিলাম, অন্যদিকে মন খুশিতে ভেসে যাচ্ছিল। সবচেয়ে বেশি মনে হচ্ছিল, আমি শুধু আমার নিজের স্বপ্ন পূরণ করিনি, আমি প্রবাসে প্রচণ্ড ত্যাগ সইয়ে মা–বাবার স্বপ্নটাও পূরণ করেছি। তাঁদের পরিশ্রম ও কষ্ট বৃথা যায়নি। আমার জন্য এটা যতটা অর্জন, তার চেয়ে বেশি হলো আমার মা–বাবার দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণ।’

১৭ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি পাইলট সার্টিফিকেট অর্জনের প্রতিক্রিয়ায় প্রথম আলোর কাছে এভাবেই নিজের আনন্দ প্রকাশ করে সিলেটের সন্তান আহনাফ আবিদ (মাহির)। গত ৩০ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে আহনাফ বেসরকারি পাইলট সনদ অর্জন করে। এর মাধ্যমে সে অবাণিজ্যিক একক ইঞ্জিন বিমান চালানোর অনুমতি পেয়েছে।

কিশোর আহনাফের এই অর্জন শুধু তার জন্য ব্যক্তিগত স্বপ্নপূরণই নয়, প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছেও আনন্দের উপলক্ষ হিসেবে এসেছে। প্রায় এক যুগ আগে আহনাফের মা–বাবা যুক্তরাষ্ট্রে আসেন।

আরও পড়ুন

স্বপ্নের শুরুর দিনগুলো

উড়োজাহাজ ওড়ানোর বেসরকারি পাইলট সনদ পেয়েছে সিলেটের সন্তান আহনাফ

ছোটবেলা থেকেই আহনাফের পাইলট হওয়ার স্বপ্ন ছিল। লস অ্যাঞ্জেলেসে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় মাত্র ১০ বছর বয়সে তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে উড়োজাহাজ নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছিল আহনাফ। সেই মুহূর্তেই তার মনে জন্ম নেয় এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা, একদিন সে আকাশে উড়ে যাবে, নিজের হাতে বিমানের স্টিয়ারিং ধরবে।

আহনাফ ১৫ বছর বয়সে আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্লাইট ট্রেনিং শুরু করে। ১৪ বছর বয়সে স্থানীয় এভিয়েশন ক্যাডেটে ভর্তি হয়। সেখানে বিমানবিজ্ঞান, নেভিগেশন, নিরাপত্তা, ককপিটের নিয়ন্ত্রণসহ সব বিষয় শেখা শুরু হয়। আহনাফের ১৬তম জন্মদিনে প্রথমবার একা আকাশে ওড়ে। এর আগে সব ফ্লাইট প্রশিক্ষণ ছিল প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। সেই প্রথম একক উড়ান ছিল মোট ফ্লাইট অভিজ্ঞতার (২৪ ঘণ্টার) একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

আরও পড়ুন

শিক্ষাজীবন ও প্রাথমিক প্রস্তুতি

আহনাফের শিক্ষাজীবন শুরু হয় লস অ্যাঞ্জেলেসে আরভিন স্টিম ম্যাগনেটে। সেখানে বিজ্ঞান, রোবোটিকস ও প্রযুক্তি বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করে আহনাফ। নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয় ডাউনটাউন বিজনেস ম্যাগনেটে।

শিক্ষাজীবনের চাপ অনেক হলেও মাহির জানত, তার স্বপ্নপূরণে শুধু বই পড়লেই হবে না, বিলম্ব না করে ফ্লাইট প্রশিক্ষণ নেওয়া অত্যাবশ্যক। ১৩ বছর বয়সে প্রথমবার একজন প্রশিক্ষকের সঙ্গে উড়োজাহাজে চড়ে আকাশে ওড়ার অভিজ্ঞতা তার মনে ছাপ ফেলে। প্রথমবারের এই অভিজ্ঞতা আহনাফের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়।

স্কুল ও রোবোটিকস ক্লাব সামলে বিমান ওড়ানো

হাইস্কুলে যাওয়ার পর আহনাফের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। দুটি এপি (অ্যাডভান্সড প্লেসমেন্ট) ক্লাস, অনার্স কোর্স (আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি প্রোগ্রাম) ও রোবোটিকস ক্লাব—সব মিলিয়ে ফ্লাইটের জন্য সময় সীমিত। সপ্তাহে একবার কিংবা মাসে একবারই ওড়ার সুযোগ হতো।

গ্রীষ্মের ছুটি আহনাফের জন্য প্রশিক্ষণের প্রধান সময়। ওই সময় নিয়মিত উড়োজাহাজে চড়ে সে একক ক্রস-কান্ট্রি ফ্লাইটের প্রস্তুতি নিত। শীতকালীন ছুটিতে সফলভাবে সম্পন্ন করে প্রথম ক্রস-কান্ট্রি ফ্লাইট—প্রায় ১০২ মাইল দূরের সান্তা ইনেজ পর্যন্ত।

উড্ডয়ন কেবল ককপিটে সময় কাটানো নয়, আহনাফকে গ্রাউন্ড স্কুলে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা অধ্যয়ন করতে হতো। এতে বিমানবিজ্ঞান, নেভিগেশন, আবহাওয়া ও নিরাপত্তাবিষয়ক পড়াশোনা অন্তর্ভুক্ত ছিল।

গত মার্চে এজির লিখিত পরীক্ষা দেয়। প্রথমবার স্কোর আসে ৮০ শতাংশ। সন্তুষ্ট না হয়ে আরও কঠোর অধ্যয়ন করে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেয় এবং ৯০ শতাংশ স্কোর অর্জন করে। বসন্ত বা স্প্রিং সেশনে এপি পরীক্ষা এবং ফ্লাইট ট্রেনিং একসঙ্গে চালিয়ে যায় আহনাফ। আগস্টে পরীক্ষামূলক উড্ডয়নে সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে বেসরকারি পাইলট সনদ অর্জন করে।

আরও পড়ুন
ককপিটে মায়ের সঙ্গে আহনাফ

আহনাফ প্রথম আলোকে বলে, তার লক্ষ্য কলেজে ভর্তি হয়ে এভিয়েশন নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া। এতে সে বাণিজ্যিক এবং পরবর্তী এটিপি লাইসেন্স অর্জনের পথে এগোতে পারবে। পড়াশোনা ও ফ্লাইট প্রশিক্ষণ একসঙ্গে চালানো চ্যালেঞ্জিং হবে, তবে এটা তার জন্য শিক্ষাগত ও পেশাগত বিকাশের সেরা উপায় বলেই মনে করে আহনাফ।

আহনাফ লস অ্যাঞ্জেলেসের বাঙালি কমিউনিটিতে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ চালিয়ে যেতে চায়, যাতে অন্য পরিবারের সন্তানদেরও সুযোগের পথ দেখানো যায়।

ভবিষ্যৎ তরুণ পাইলটদের জন্য তাঁর পরামর্শ হলো, যত দ্রুত সম্ভব শুরু করতে হবে এবং লেগে থাকতে হবে। কখনো কখনো অতিরিক্ত মাইল হাঁটতে হতে পারে, কিন্তু সেই অতিরিক্ত পথ স্বপ্নের কাছে পৌঁছে দেবে।

আরও পড়ুন

মা–বাবার অনুভূতি

ছেলে আহনাফের অর্জনে উচ্ছ্বসিত বাবা মইনুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রবাসে রাতদিন পরিশ্রম করেছি ছেলের সুশিক্ষা ও সাফল্যের জন্য। এখন ছেলের সফলতায় আমার সমস্ত পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বার্থক হয়েছে। আমি অনেক খুশি।’

আর আহনাফের মা আয়েশা রুমা বললেন, ‘বিমানে প্রথমবার একা উড়ে যতক্ষণ পর্যন্ত ছেলে নিরাপদে নামেনি, ততক্ষণ আল্লাহর কাছে প্রাণভরে দোয়া করেছি, ভয় পেয়েছি। এখন সে নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছে, আমাদের স্বপ্নও পূরণ হয়েছে।’

আরও পড়ুন