এভারেস্টজয়, গণিত আর রক গানের কিআড্ডা
স্বপ্ন তো আমরা সবাই দেখি। কেউ চোখ বন্ধ করলেই নিজেকে খুঁজে পায় এভারেস্টের চূড়ায়। কেউ আবার হারিয়ে যায় গণিতের কোনো জটিল সমস্যায়। ভাবে, এই সমাধানটাই হয়তো একদিন আমাকে নিয়ে যাবে বিশ্বমঞ্চে। আবার কেউ হয়তো মঞ্চের আলোয় নিজেকে রকস্টার হিসেবে দেখতে চায়। এমন ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্ন এবার চোখের সামনে দেখেছে কিশোর আলোর পাঠক। ১০২তম কিআড্ডায় ছিল গণিত, অ্যাডভেঞ্চার আর গানের আয়োজন।
২৩ আগস্ট, শনিবার বিকেল ৩টায় প্রথম আলোর অফিসে জড়ো হয় শিশু-কিশোরেরা। এখানে প্রথম শ্রেণির শিশুরা যেমন আছে, তেমনি আছে কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছেলে-মেয়েরাও। কিআড্ডার সঞ্চালক জাহিন যাঈমাহ্ কবির শুরুতেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন—কেন কিআড্ডায় এসেছ? একে একে সবাই উত্তর দিলো। বেশিরভাগের উত্তর হলো কিশোর আলো পড়ে কিআড্ডা সম্পর্কে জেনেছি, তাই এসেছি। কেউ বললো অনলাইন থেকে কিআড্ডার খবর পেয়ে এসেছি। এরপর কথা বলেন কিআড্ডার আরেক সঞ্চালক ও কিআর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক আহমাদ মুদ্দাসসের। তিনি বড় পর্দায় দেখালেন কিশোর আলোর ওয়েবসাইট। জানালেন প্রতিদিন ওয়েবসাইটে নতুন নতুন লেখা প্রকাশ হয়। প্রকাশিত লেখার মধ্যে পাঠকের পাঠানো লেখা থাকে, থাকে নতুন নতুন ফিচার। উদাহরণ হিসেবে তিনি দেখালেন নিজের লেখা একটি ফিচার। লেখাটি ছিল খাবারের মেয়াদ নিয়ে। খাবারের মেয়াদ শেষ হলেই কি আর খাওয়া যায় না? বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলেন।
‘গ্র্যান্ড প্রিন্সেস’ ভ্রমণ
এরপর সভায় যোগ দেন কিশোর আলোর সম্পাদক আনিসুল হক। তিনি শোনালেন দারুণ তাঁর এক অভিজ্ঞতার গল্প। ১৭ তলা বিশিষ্ট একটি জাহাজে ভ্রমণ! জাহাজটির নাম গ্র্যান্ড প্রিন্সেস। কানাডার ভ্যাঙ্কুভার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা পর্যন্ত টানা সাত দিনের যাত্রা, তারপর আবার ফেরা। সঙ্গে ছিলেন তাঁর বুয়েটের বন্ধুরা ও তাঁদের পরিবার। সব মিলিয়ে মোটামুটি ২০০ জনের দলের সঙ্গে এই যাত্রা। পথে দেখেছেন হাজার বছরের পুরোনো হিমবাহ। আর জাহাজ? সেটা যেন এক ভাসমান শহর—৫টি রেস্টুরেন্ট, টেনিস কোর্ট, বাস্কেটবল কোর্ট, সুইমিং পুল কিংবা বিশাল অডিটোরিয়াম সবই আছে। তিনি আরও বললেন, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে গেলে প্রবাসী বাঙালিদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পান, তার জন্য তিনি কৃতজ্ঞ।
অ্যানিমের সঙ্গে জাপান
এরপর নিজের প্রবাস অভিজ্ঞতা নিয়ে বললেন কিশোর আলোর প্রদায়ক সরদার আকিব লতিফ। প্রায় দুই বছর পর জাপান থেকে দেশে ফিরেছেন তিনি। জাপানে পড়াশোনা করতে গিয়ে কেমন অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেই গল্প শোনালেন। তিনি বললেন অ্যানিমেতে দেখা জাপানের সঙ্গে বাস্তবের জাপানের কিছু মিল আছে, আবার অনেক অমিলও। জাপান সত্যি সুন্দর, কিন্তু মানুষের কথাবার্তা অ্যানিমের মতো শোনায় না।
গণিত ভয় পাও কেন?
অনেকক্ষণ গল্পগুজবের পর এল গণিত নিয়ে জানার পালা। এই পর্বে যুক্ত হন ‘বাংলার ম্যাথ’ নামের এক প্ল্যাটফর্মের দুই সহপ্রতিষ্ঠাতা আহমেদ শাহরিয়ার শুভ ও মাহতাব হোসাইন। ‘বাংলার ম্যাথ’ গণিত শেখার এক ভিন্নধর্মী উদ্যোগ। তাঁরা শুধু গণিত চর্চা করান না, তাঁরা শেখান সমস্যা সমাধান বা প্রবলেম সলভিং স্কিল। বাচ্চারা কীভাবে গণিত নিয়ে ভাববে, সেটাই শেখানো তাঁদের লক্ষ্য। তাঁরা জানালেন, এই প্ল্যাটফর্ম শুরু করার আগে বাংলাদেশের ৩২টি জেলা ঘুরেছে তাঁদের দল। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের বাচ্চারা কেন গণিতকে ভয় পায় সেটা জানা। তাঁদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, বাংলাদেশের প্রায় দেড় কোটি শিশু-কিশোর গণিত ভয় পায়। এর কারণ দুটি—দেশে গণিতের সঠিক মূল্যায়ন হয় না, আর শিশুদের হাতে কলমে গণিত বোঝানো হয় না। এই দুই সমস্যা নিয়েই কাজ করছে বাংলার ম্যাথ। এই প্ল্যাটফর্মে গণিতকে এমনভাবে মূল্যায়ন করা হয় যেন প্রতিটি শিশু বুঝতে পারে কোথায় তার দুর্বলতা এবং তা যেন ঠিক করার সুযোগ পায়। পাশাপাশি তাঁরা জানালেন একটি নতুন পরিকল্পনার কথা, দ্রুতই বাজারে আসছে তাদের তৈরি ‘গণিত কিট’। এই কিটের মাধ্যমে বাচ্চারা হাতে কলমে গণিতের আসল মজা ধরতে পারবে বলে আশা করেন তাঁরা। গণিতের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে বাংলার ম্যাথ আয়োজন করে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। বর্তমানে টিম চ্যাম্পিয়নশিপের রেজিস্ট্রেশন চলছে বাংলার ম্যাথের ওয়েবসাইটে। শুধু দেশেই নয়, বাংলার ম্যাথ থেকে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও গিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এমনকি একবার সারা বিশ্বে সপ্তম স্থানও অর্জন করেছে।
সি টু সামিট
গণিতের আলোচনা শেষে এবার পালা অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শোনার। নিজের দুর্ধর্ষ অভিযানের গল্প শোনাতে কিআড্ডায় উপস্থিত হয়েছিলেন ‘সি টু সামিট’ খ্যাত এভারেস্টজয়ী ইকরামুল হাসান শাকিল। তিনি কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্রসৈকত থেকে পায়ে হেঁটে পৌঁছেছেন এভারেস্টের চূড়ায়। এই রেকর্ড তিনিই করেছেন প্রথমবারের মতো। শাকিল জানালেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করতেন। ২০১৩ সালে তিনি একবার কলকাতা থেকে হেঁটে ঢাকায় এসেছিলেন, যাত্রায় লেগেছিল ১১ দিন। এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন ছিল তার বহুদিনের, কিন্তু এভারেস্টে তো অনেকেই উঠেছে। তাই তিনি চেয়েছিলেন কিছু আলাদা, এমন কিছু যা কেউ করেনি। সেই ভাবনা থেকেই আসল ‘সি টু সামিট’—সমুদ্র থেকে চূড়া পর্যন্ত হাঁটার আইডিয়া।
তিনি নিজের জীবনের গল্প শোনালেন সভায়। তিনি কৃষিকাজ করেছেন, থিয়েটারে অভিনয় করেছেন, লিখেছেন আটটি বই। এর পাশাপাশি শাকিল পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছেন ভারতের এক অ্যাকাডেমিতে। কারণ এমন এক কঠিন যাত্রার আগে প্রস্তুতি জরুরি ছিল। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে ইনানী সৈকতের জলে পা ডুবিয়ে শুরু হয় তার যাত্রা। টানা ৬৪ দিন হেঁটে তিনি পৌঁছান এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে। পথে যখন তাকে যমুনা সেতু দিয়ে হাঁটতে দেওয়া হয়নি, তখন তিনি সাঁতরে পার হন যমুনা নদী। এই যাত্রায় বহুবার মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। এভারেস্টের বৈরী আবহাওয়া, অক্সিজেনের ঘাটতি, সহযাত্রীদের মৃত্যু—সবকিছুই তার মনে ভয় জাগিয়েছিল। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। ৮৪ দিন হাঁটার পর জয় করেছেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া। তার জীবনের গল্প শুনে সভায় উপস্থিত সবাই যেন কল্পনা করতে শুরু করল, এভারেস্টের চূড়া থেকে পৃথিবী দেখতে কেমন লাগে! ইকরামুল হাসান শাকিলের সাহসী অভিযানের গল্প সভায় উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করেছে।
১৫ মিনিটে তৈরি রকব্যান্ড, ’রকসল্ট’
এভারেস্ট জয়ের গল্পের পর শোনা গেল একদম অন্যরকম একটি গল্প। মাত্র ১৫ মিনিটে গড়া একটি গানের ব্যান্ডের কাহিনি। তরুণ রক মিউজিশিয়ানদের নিয়ে তৈরি রিয়েলিটি শো ‘দ্য কেইজ’-এর বিজয়ী ব্যান্ড ‘রকসল্ট’ হাজির হয়েছিল এবারের কিআড্ডায়। তাঁরা জানালেন, কীভাবে একে অপরকে না চিনেও প্রতিযোগিতার ভেতরেই পাঁচজন মিলে গড়ে তুলেছিলেন ব্যান্ডটি। অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করলেন ড্রামার আওয়ান, বেজিস্ট রাজীব, ভোকাল নাহিয়ান, গিটারিস্ট অরূপ এবং গিটারিস্ট রাযিন। তাদের ভিন্ন বয়স, ভিন্ন এলাকা তবু ছয় মাসের মধ্যে তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে চমৎকার বোঝাপড়া। এখন তারা অ্যালবাম তৈরির প্রস্তুতিতে এবং কনসার্টে ব্যস্ত। কিআড্ডায় তারা শোনালেন নিজেদের গান ‘নিষ্পত্তি’ ও ‘অগ্নিবীণা’। শুধু তাই নয়, গান শোনালেন কিআর পাঠকরাও। দ্বিতীয় শ্রেণির মোহাম্মদ ইহানূর রহমান এবং দশম শ্রেণির প্রতীতি মৃধা সুন্দর সুন্দর দুটি গান পরিবেশনা করে।
শেষে শুরু হয় কিশোর আলো নিয়ে জমজমাট কুইজ। এই কুইজে সঠিক উত্তর দিয়ে তিনজন পুরস্কার জিতে নেয়। গণিত, ভ্রমণ, অ্যাডভেঞ্চার, গান—সব মিলিয়ে ১০২তম কিআড্ডা ছিল একেবারে ভরপুর আনন্দ আর চমকের আসর।