মেট্রোস্টেশনে হলুদ রঙের টাইলস থাকে কেন
মেট্রোস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম–১-এ দাঁড়িয়ে আছি। ট্রেন আসতে আরও দুই মিনিট বাকি। এমন সময় মেট্রোরেলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মী বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে হলুদ দাগের পেছনে সরে দাঁড়াতে বললেন। সবাই একটু পিছিয়ে গেলে, চোখ পড়ল প্ল্যাটফর্মের কোনায় সেই উজ্জ্বল হলুদ রঙের ব্লক বা টাইলসের দিকে। মেট্রোরেল থেকে নামার সময় দেখলাম, স্টেশনে ঢোকার পথ থেকে শুরু করে লিফটে ওঠার পথ সবখানে এই ব্লকগুলো রয়েছে। এমনকি মেট্রোস্টেশন থেকে বেরিয়ে ফুটপাতেও এগুলোর দেখা মিলল। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই ব্লকগুলো কেন দেওয়া হয়?
আসলে, এই বিশেষ ব্লক বা টাইলগুলোকে বলা হয় ট্যাকটাইল পেভিং (Tactile Paving)। এ ছাড়া এগুলো তেনজি ব্লক (Tenji Block) বা ব্রেইল টাইলস নামেও পরিচিত। এই ব্লকগুলো রাস্তা বা মেট্রোস্টেশনে দেওয়া হয় একধরনের বিশেষ পথনির্দেশক হিসেবে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের চলাচলের সুবিধার জন্য তৈরি করা হয়েছে এই টাইল বা ব্লকগুলো। এটা কোনো নকশার জন্য দেওয়া হয়নি।
ট্যাকটাইল পেভিংয়ের ধারণা প্রথম আসে ১৯৬৫ সালে। জাপানের সেইচি মিয়াকে নামের একজন ব্যক্তির মাথায় আসে ধারণাটি। জাপানি ব্রেইল অর্থাৎ তেনজি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই টাইলস তৈরি করেন। ১৯৬৭ সালে জাপানের ওকায়ামা শহরের একটি রাস্তায় প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয় এই টাইলস। ধীরে ধীরে এটি পুরো জাপানে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের অন্যান্য দেশও ব্যবহার করতে শুরু করে টাইলসগুলো। বর্তমানে বিশ্বের নানা শহরের সাবওয়ে স্টেশন, মেট্রোস্টেশন, ফুটপাতগুলোতে এ ধরনের টাইলস ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। সেখান থেকে এখন এই তেনজি ব্লক বাংলাদেশেও দেখা যায়।
ব্লকগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য হলো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষদের নিরাপদে পথ চলতে সাহায্য করা। রাস্তায় চলতে যেন তাঁদের অসুবিধা না হয়, সে জন্য এই টাইলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা তাঁদের পায়ের স্পর্শে বুঝতে পারেন সামনে কী আছে। যেমন, কোথায় থামতে হবে, কোন দিকে যেতে হবে, কোথায় বিপদ আছে। খাঁজকাটা এই টাইলগুলো থাকায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অন্যের সাহায্য ছাড়াই স্টেশনের মতো জনবহুল জায়গায় আরও সহজভাবে চলাফেরা করতে পারেন।
এই তেনজি ব্লকগুলো মূলত দুই ধরনের হয়। প্রতিটির আলাদা অর্থ আছে। একটা হলো ছোট ছোট বৃত্তাকার বিন্দু থাকে এমন বিন্দুযুক্ত ব্লক (Warning block)। এগুলো সাধারণত ‘সতর্কতা’ বা ‘বিপদের সংকেত’ হিসেবে কাজ করে। যখন একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি এই ব্লকের ওপর দিয়ে হাঁটেন, তিনি পায়ের স্পর্শে বুঝতে পারেন সামনে কোনো বিপদ বা পথের পরিবর্তন আছে। বিন্দুযুক্ত ব্লক থাকে প্ল্যাটফর্মের একদম কিনারায়, যেখানে ট্রেনের লাইন শুরু হয়, সিঁড়ির শুরুতে বা শেষে, লিফটের বা চলন্ত সিঁড়ির মুখে, কোনো পথের মোড়ে, যেখানে একাধিক পথ বিভক্ত হয়েছে।
আরেক ধরনের ব্লক হলো দাগযুক্ত ব্লক (Directional Block), যেখানে লম্বা লম্বা রেখা থাকে। এগুলো ‘পথনির্দেশক’ হিসেবে কাজ করে। এই দাগগুলো অনুসরণ করে একজন ব্যক্তি নিরাপদে তাঁর গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন। এই ব্লকগুলো সাধারণত টিকিট কাউন্টার, লিফট, সিঁড়ি বা নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মের দিকে যাওয়ার সোজা পথে ও স্টেশনের প্রধান প্রবেশপথ থেকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে থাকে। মূলত এই দাগযুক্ত ব্লক দিয়ে চলাচল করতে হয়, আর বিন্দুযুক্ত ব্লক দিয়ে থামার বা সতর্ক হওয়ার সংকেত দেওয়া হয়। তবে জায়গা ও প্রয়োজন অনুযায়ী এই দুই ধরনের ব্লকের আরও কিছু প্রকারভেদ আছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই ব্লকগুলো হলুদ রঙের হয় কেন? এর প্রধান কারণ হলো হলুদ রং হাই কনট্রাস্ট তৈরি করে। অর্থাৎ, এই উজ্জ্বল রংটি প্ল্যাটফর্মের সাধারণ রঙের চেয়ে সহজেই চোখে পড়ে। যাঁদের দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি নেই, তাঁদের জন্য পায়ের স্পর্শই যথেষ্ট। কিন্তু যাঁদের দৃষ্টিশক্তি আংশিক (Low Vision) বা ক্ষীণ দৃষ্টি, তাঁদের জন্য এই হলুদ রং পথ চিনতে ও নিরাপদে চলতে সাহায্য করে।
স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তির মানুষের জন্য এই হলুদ রঙের ব্লকগুলো একটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করে। এর ফলে তাঁরা ভুল করে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের জন্য তৈরি এই পথের ওপর দিয়ে হাঁটা এড়িয়ে চলেন। এতে তাঁদের নির্বিঘ্নে চলাচল নিশ্চিত হয়। তবে এখন অন্যান্য রংও ব্যবহার করা হচ্ছে। এর কারণ হলো, যাঁদের দৃষ্টিশক্তি খুব কম বা যাঁরা শুধু আলো-অন্ধকার বুঝতে পারেন, তাঁরা সাধারণত লাল, হলুদ এবং নীল রং তুলনামূলকভাবে ভালোভাবে দেখতে পান। তাই এখন থেকে এই হলুদ রঙের ব্লকের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় খেয়াল রাখতে হবে, যেন অন্যের অসুবিধা না হয়।
সূত্র: গেট অ্যারাউন্ড জাপান, মিডিয়াম, কারলি টেলেস, উইকিপিডিয়া