পাখিদের অরণ্যে তিনি ‘নেস্টম্যান’
ছোটবেলায় পাখির বাসা খুঁজে বেড়ানোর শখ ছিল তাঁর। ঘরের কোনা থেকে শুরু করে গাছের ডাল—সবখানে বন্ধুরা মিলে পাখির বাসা খুঁজতেন। ওই বাসার প্রতি নজর রাখতেন সব সময়। কোনো বাসায় পাখির ছানার দেখা মিললেই সেটিকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতেন। পাখির ছানার খাবার খাওয়ার দৃশ্য তাঁকে মুগ্ধ করত।
দিল্লিতে অফিসে আসা-যাওয়ার পথেও তিনি পাখি দেখে সেই হারানো শৈশবের আনন্দ পেতেন। একদিন দেখেন, কিছু চড়ুই পাখি সড়কে থাকা পাইপের গর্তে আশ্রয় নিয়েছে। আরেক দিন দেখেন, পাখিদের আশ্রয় নেওয়া পাইপের ওই গর্তগুলো সিমেন্ট দিয়ে বন্ধ করে দিচ্ছেন কিছু মানুষ। তাহলে এই ইট-কংক্রিটের শহরে কোথায় যাবে পাখি! কোথায় বাঁধবে ঘর? এ ভাবনা থেকেই তিনি পাখির বাসা তৈরি করা শুরু করেছিলেন, এখনো করে যাচ্ছেন ৬০ বছর বয়সী পরিবেশবিদ রাকেশ খাতরি। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনি ৭ লাখ ৩০ হাজার পাখির বাসা তৈরি করে ঘরহারা পাখিদের আশ্রয় দিয়েছেন। এ কারণে তিনি পেয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক সম্মাননা। তিনি এখন ‘নেস্টম্যান অব ইন্ডিয়া’ নামে পরিচিত।
২০০৮ সালে দিল্লির ময়ূরবিহার এলাকায় রাকেশ তাঁর বাসার সামনে প্রথমবারের মতো পাট ও দড়ি দিয়ে একটি পাখির বাসা তৈরি করে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। এ দেখে প্রতিবেশীরা বেশ হাসাহাসি করেছিলেন। বলেছিলেন, পাখি তো নিজেরাই বাসা তৈরি করে থাকে। তুমি কীভাবে ভাবছ যে পাখি তোমার তৈরি করা কৃত্রিম বাড়িতে থাকবে?
এসব কথায় রাকেশ পাত্তা দিতেন না; কিন্তু এক দিন-দুই দিন যায়, পাখি আর আসে না। এ দেখে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন রাকেশ। এর কয়েক দিন পরই বেশ কিছু পাখি ওই বাসার কাছে কিচিরমিচির শুরু করে দিল। হঠাৎ একদিন দেখলেন, এক জোড়া চড়ুই আশ্রয় নিয়েছে ওই বাসায়। এতে তাঁর সব সন্দেহ দূর হয়ে গেল। পাখিদের জন্য বাসা তৈরি করার নেশা চেপে বসল তাঁর মনে। তারপর দেখতে লাগলেন, চড়ুই, বাবুই, বুলবুলি ও দোয়েল পাখি তাঁর তৈরি করা বাসায় এসে থাকা শুরু করছে। ডিম পাড়ছে। কিছুদিন পর পাখা না গজানো ছানাগুলোও ওই বাসার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে আকাশের দিকে। এসব দৃশ্য দেখে মন ভরে যায় তাঁর।
ভারতে পাখির সংখ্যা ক্রমে কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিক থেকে দেশটির ছয়টি মেট্রো শহর—বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, দিল্লি, হায়দরাবাদ, কলকাতা ও মুম্বাইয়ে চড়ুই পাখির সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। আর এই পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুরো বাস্তুতন্ত্রের ওপর। পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার অনেক কারণের পাশাপাশি ইট-কংক্রিটের শহরে পাখির বাসার সংকটকে দায়ী করেছেন রাকেশ। তাই তিনি বাসা তৈরি করে পাখিদের শহরে ফিরে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। চেয়েছেন, গ্রামের মতো শহরও মুখর থাকুক পাখির কিচিরমিচির শব্দে।
রাকেশ বলতে চান, এই শহর যেমন মানুষের, একইভাবে এই শহর পাখিদেরও হোক। তাঁর এই মহৎ ভাবনা দেখে একজন মালি তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘পাখির বাসা তৈরি বন্ধ কোরো না। তুমি চড়ুই পাখিদের একটি বাসা তৈরি করে দিচ্ছ, যে বাসা আমরা পাখিদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছি।’ মালির এই পরামর্শ রাকেশকে পাখির বাসা তৈরিতে আরও উৎসাহ জুগিয়েছিল।
শুরুতে পাট, দড়ি, নারিকেলের খোসা ও খবরের কাগজ দিয়ে পাখির জন্য বাসা তৈরি করতেন রাকেশ। ধীরে ধীরে বাসা তৈরির উপকরণ বদলাতে থাকেন। বিষয়টিকে আরও কীভাবে পরিবেশবান্ধব করা যায়, তা ভাবতে থাকেন। সেই ভাবনা থেকেই তিনি কচুরিপানা দিয়ে পাখির বাসা তৈরির উদ্যোগ নেন। এতে সুবিধা অনেক। কচুরিপানা জলাশয়ের অক্সিজেন টেনে নিয়ে বাস্তুতন্ত্র নষ্ট করে দেয়। এই ক্ষতিকর কচুরিপানা তুলে যদি বাণিজ্যিকভাবে পাখির বাসা তৈরি করা যায়, তাহলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে এবং জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্রও ঠিকঠাক থাকবে।
এ লক্ষ্যে ইকো রুটস ফাউন্ডেশন নামে রাকেশ একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। এই সংগঠন থেকেই হাতে নিয়েছেন ‘জল স্পর্শ’ কর্মসূচি। এই প্রকল্পের আওতায় অসংখ্য জলাশয়কে কচুরিপানামুক্ত করা হয়েছে। এই কর্মসূচিতে বিহার, উত্তর প্রদেশ ও হরিয়ানার দুই হাজারের বেশি নারী যুক্ত হন কচুরিপানা তোলা এবং তা ব্যবহার করে বাসা তৈরির কাজে।
এ বিষয়ে রাকেশ খাতরি বলেন, ‘জল স্পর্শ’ কর্মসূচির আওতায় নারীরা জলাশয় থেকে কচুরিপানা সংগ্রহ করে তা শুকিয়ে নেন। এরপর সেগুলো দিয়ে পাখির বাসা তৈরি করেন। এটি একটি পরিবেশগত পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ পরিবেশ সংরক্ষণ ও নারীর ক্ষমতায়নকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এটি টেকসই আয় বৃদ্ধি, স্বনির্ভরতা ও উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করার একটি প্রচেষ্টা।
এত বড় স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই রাকেশ বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে উৎসাহী অন্যান্য সংস্থার কর্মীদের হাতে-কলমে পাখির বাসা তৈরি শেখানোর কর্মশালা করতে লাগলেন। এ পর্যন্ত তিনি সাত হাজারের বেশি কর্মশালা করেছেন। আর তাঁর তত্ত্বাবধানে ৭ লাখ ৩০ হাজারের বেশি পাখির বাসা তৈরি করা হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, পাখির বাসা তৈরির পর আরেকটি অধিবেশনে পাখির বাসা ঝোলানোর উপযুক্ত জায়গা চিনতেও শেখান রাকেশ।
শহর থেকে পালিয়ে যাওয়া পাখিদের আবার ফিরিয়ে আনার অনন্য উদ্যোগের জন্য দেশ-বিদেশ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছেন রাকেশ খাতরি। তিনি ২০২০ সালে পেয়েছেন, দ্য ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড, আর্থ ডে নেটওয়ার্ক স্টার অ্যাওয়ার্ড এবং ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) সদস্যপদ; ২০১৩ সালে পেয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল গ্রিন অ্যাপল অ্যাওয়ার্ড; পাখি সংরক্ষণে বিশেষ অবদানের জন্য চলতি বছর সনি বিবিসি আর্থ থেকে পেয়েছেন আর্থ চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া ২০১৮ লিমকা বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নিজের নাম লিখিয়ে নিয়েছেন এই পাখিপ্রেমী পরিবেশবিদ। তবে এসব পুরস্কার ও সম্মাননার চেয়ে তাঁর বড় পরিচয়, এখন তিনি ‘নেস্টম্যান অব ইন্ডিয়া’।
ঘরছাড়া পাখিদের জন্য বাসা বা ঘর তৈরিকে কাজ হিসেবে দেখেন না রাকেশ। তিনি বলেন, ‘এই পৃথিবীতে কাউকে বাড়ি দেওয়ার চেয়ে বড় আশীর্বাদ আর কিছু নেই। আর আমি ঠিক এটিই করছি।’ তবে অন্যের তৈরি নয়; বরং এই শহরেও নিজের বাসা নিজে বোনার আনন্দ ফিরে পাক পাখিরা—এমন পরিবেশের প্রত্যাশা করেন এই নেস্টম্যান।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, দ্য বেটার ইন্ডিয়া, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও হিন্দুস্তান টাইমস