গোঁফ নিয়ে গপসপ

সাধারণত ছেলেদের কিশোর বেলায় নাকের নিচে ও মুখের ওপরে যে পশম দেখা যায়, সেটাই হচ্ছে গোঁফ। আমরা অবশ্য গোঁফকে অনেকেই মোচ বলে ডাকি। এই মোচ শব্দটি এসেছে ইংরেজি মুস্তাচ শব্দ থেকে। তবে আদতে মোচ ইংরেজি শব্দ নয়, মুস্তাচ্চি নামের ইটালিয়ান শব্দ থেকে ফরাসি হয়ে ইংলিশ মুস্তাচ বাংলায় মোচ হয়ে গেছে। অনেক জাতির মধ্যে মোচ বা গোঁফের কদর রয়েছে।

গোঁফের অনেকগুলো মজার ইংলিশ নাম রয়েছে। যেমন নোজ নেইবার, ক্রাম্ব ক্যাচার, ফানি ডাস্টার, পুশ ব্রুম, নোজ বাগ, লিপ সোয়েটার, বেস্ট ফ্রেন্ড, ব্রো-মো, ব্রো-স্টাচে, ক্যাটারপিলার, কুকি ডাস্টার, ফেস ফিটিং, ফেস ফার্নিচার, গ্রাস গ্রিন (বানান আলাদা), হ্যান্ডেল বার, মানো মিটার, মলেস্টাচে, লিপ লাগেজ, মাউথ মিরকেন, মিস্টার টিকলার, ওল্ড বুলেট প্রুফ, স্মোক ফিল্টার, সুপ স্টেইনার, টি স্টেইনার ইত্যাদি আরও অনেক নাম।

তবে মজার বা দুষ্টামি করে যে নামে ডাকা হোক না কেন, গোঁফ আসলে একধরনের চুল।

গোঁফ কেন পুরুষের প্রতীক

টেস্টোস্টেরন হরমোনের কারণে শুধু ছেলেদের মুখে দাড়ি গোঁফ গজায়। বয়ঃসন্ধিকালে এই হরমোনের আর্বিভাবে ছেলেদের গলার স্বরও বদলে যায়। এ কারণে অনেক দেশে গোঁফ একটি কিশোরের পুরুষ হয়ে ওঠার প্রতীক বলে ধরা হয়।

গোঁফের যত্নে ছেলেরা ব্যবহার করে যেমন মুস্তাচ ওয়াক্স বা গোঁফে তা দেওয়ার মোম । মুস্তাচ কম্ব বা গোঁফের জন্য চিরুনি এবং মুস্তাচ সিজার বা গোঁফ কাটার কাঁচি।

একসময় ইংল্যান্ডে স্যুপ খাওয়ার সময় গোঁফ যাতে ভিজে না যায়, সে জন্য বিশেষ চামচ আবিষ্কার করা হয়েছিল!

বিশ্বে অনেক ধরনের গোঁফ রয়েছে। এখানে কয়েক ধরনের গোঁফের পরিচয় দেওয়া যাক

ফু মাঞ্চু: নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এটা চীনা বা মঙ্গোলীয় ধরনের গোঁফ। এই গোঁফ হালকা হয়। আর ঠোঁটের শেষে নিচের দিকে লম্বা করে ঝুলে থাকে।

আরও পড়ুন

পাঞ্চো ভিলা গোঁফ: মালিকের নাম থেকেই এর নাম এসেছে। এর আগের নাম ছিল ড্রফি। কিন্তু মেক্সিকোর রাজনীতিবিদ ও বিদ্রোহী নেতা যোদ্ধা পাঞ্চো ভিলা এই গোঁফ রাখার পর থেকে এর নাম হয়ে গেছে পাঞ্চো ভিলা গোঁফ। যা আবার মেক্সিকান গোঁফ নামেও পরিচিত। এটি ফু মাঞ্চুর চেয়ে বেশ ঘন গোঁফ।

ঘন ঝোপের মতো আর ঠোটের শেষের দিকে সামান্য ওপরে উঠে যায় যে গোঁফ, তারাই নাম হ্যান্ডেলবার
ছবি : ম্যাড ভাইকিং

হ্যান্ডেলবার: ঘন ঝোপের মতো আর ঠোটের শেষের দিকে সামান্য ওপরে উঠে যায় যে গোঁফ, তারাই নাম হ্যান্ডেলবার। এই গোঁফের আরেক নাম স্প্যাঘেটি গোঁফ। কারণ, এটি ইতালির পুরুষদের মধ্যে জনপ্রিয়।

হর্স-শু গোঁফ: ঘোড়ার নালের মতো এই গোঁফ দেখতে অনেকটা ফু মাঞ্চুর মতো, তবে সামান্য ঘন। আমেরিকার কাউবয়রা এই ধরনের গোঁফ বেশি রাখতো।

টাইলার গোঁফ: সরু হালকা গোঁফের রেখাকে এই নামে ডাকা হয়। অনেক সময় একে লিলিব্রো নামে ডাকা হতো।

টুথব্রাশ গোঁফ: এই ধরনের গোঁফ ঘন কিন্তু ঠিক ঠোঁটের মাঝখানে লেগে থাকে। সাধারণত ২.৫ সেন্টিমিটার লম্বা করে এদের কাটা হয় আর এর ওপরে থাকে নাক। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির এই গোঁফ ছিল। যেমন কৌতুক অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলার, লেখক অলিভার হার্ডি প্রমুখ।

আরও পড়ুন

ওয়ালরাশ গোঁফ: ঘন এবং লম্বা এই গোঁফ মুখের দুই পাশে ছড়িয়ে যায়। গোঁফকে ওয়ালরাশ বলে ডাকা হয়। জার্মানির বিখ্যাত দার্শনিক ফ্রেডরিক নিৎসের মুখে ছিল এই গোঁফ।

ইম্পেরিয়াল গোঁফ: ঘন এবং দুই পাশে সামান্য ওপরে ওঠে থাকে যে গোঁফ।

জিজি গোঁফ: ঘন এবং ঠোঁটের দুই পাশে ঝুলে থাকা গোঁফ যেগুলো, সেগুলোকে জিজি গোঁফ বলে ডাকা হয়। বিখ্যাত মঙ্গোল নেতা চেঙ্গিস খানের গোঁফের ধরন জিজি গোঁফের মতো ছিল।

আমেরিকার একজন সঙ্গীতজ্ঞ ফ্রাঙ্ক জাপ্পার মুখে ছিল ইম্পেরিয়াল গোঁফ। তার গোঁফ এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে মৃত্যুর পর গোঁফসহ মুখের কপিরাইট করে নিয়েছিল তার পরিবার।

মুস্তাচ মার্চ

গোঁফের জন্য এক সেনার লড়াই থেকে এই নাম এসেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে বৈমানিক রবিন ওল্ডস গোঁফের কারণে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। রবিনের বস রবিনের এই গোঁফকে একেবারেই দেখতে পারতেন না। তিনি রবিনকে হুকুম করেন তিনি যেন তাঁর গোঁফ ছেঁটে আসেন। কিন্তু রবিন সেই আদেশ অমান্য করেন। গোঁফ ছাঁটার বিরুদ্ধে রবিনের লড়াই ইতিহাসে মুস্তাচ মার্চ নামে পরিচিত।

গোঁফকে একেবারে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সালভাদর দালি। তাঁর আঁকা ছবির মতোই বিখ্যাত ছিলো তাঁর এই গোঁফ।

১৯৭০ থেকে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ফুটবল ক্লাব গোঁফওয়ালা ক্লাব নামে পরিচিত ছিল। গ্রাহাম সুনেস, মার্ক লরেন্স, ব্রুস গ্রেবলার, টেরি ম্যাকডরমেট ও ইয়ান রাশ ছিলেন এই দলের বিখ্যাত খেলোয়াড় আর এদের সবার মুখে বেশ মানান সই গোঁফ বিরাজ করত।

এ ছাড়া ১৯৮৫ সালে অস্ট্রেলিয়া দলে অভিষেক হওয়া ফাস্ট বোলার মার্ভ হিউজ গোঁফের কারণেই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন।

আরও পড়ুন

গুম্ফ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ

এর শুরু ১৯৯০ সালে, জার্মানির বলাক ফরেস্ট নামের এক গ্রামে। এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল হফনার বেয়ার্ড ক্লাব। তবে ১৯৯৭ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের অনুষ্ঠিত হয় নরওয়ের ট্রন্ডহাইমে। আর এর আয়োজক ছিল নরওয়ের মুস্তাচ ক্লাব বা নরওয়ের গোঁফ সংগঠন।

১৯৯৯ সাল থেকে প্রতি দুই বছর পরপর এই প্রতিযোগিতা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই গোঁফ ওয়ার্ল্ডকাপে আলাদা আলাদা বিভাগ রয়েছে। বিভাগগুলোর মধ্যে আছে—

স্বাভাবিক গোঁফ: যে কোন ধরনের স্টাইলের গোঁফে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে, তবে এই গোঁফের কোনো পরিচর্যা করা যাবে না। ঠোঁটের বাইরে ১.৫ সেন্টিমিটারের বেশি জন্মাতে দিতে হবে।

হাঙ্গেরিয়ান গোঁফ: এই গোঁফ হতে হবে ঘন ও বড়। ওপরের ঠোঁটের শুরু থেকে এই গোঁফ থাকতে হবে এবং ১.৫ সেন্টিমিটারে মধ্যে রাখতে হবে। তবে এই গোঁফের যত্ন নিতে কোনো বাধা নাই।

দালি গোঁফ: গোঁফের এই চ্যাম্পিয়নশিপের নামটি এসেছে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সালভাদার দালির গোঁফ থেকে। এই গোঁফ ঠোটের মাঝ থেকে বের হয়ে গিয়ে গালের দুপাশ দিয়ে ওপরে ওঠে যাবে।

ইংলিশ গোঁফ: ঠোঁটের মাঝখান থেকে শুরু হয়ে খুব হালকা এই গোঁফ ঠোঁটের দুই পাশে উঠে যাবে। একে হালকা বাঁকানো যেতে পারে। তবে এই ধরনের গোঁফ শেভ করে নেওয়ার পরেও থেকে যায়। তাই এদের শেভ করে নেওয়া যেতে পারে।

রাজকীয় গোঁফ বা ইমপেরিয়াল: ঘন এবং দুপাশে সামান্য ঝুলে উপরে উঠবে এই গোঁফ।

ফ্রি স্টাইল: নাম শুনেই বুঝতে পারছো কোন ধরনের গোঁফের এখানে ঠাঁই হয়েছে। মূলত যাদের গোঁফ ওপরের অন্য কোন গোঁফের সঙ্গে মেলে না, তাদের এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের এবং পুরস্কার জেতার সুযোগ রয়েছে।

১২ নভেম্বর ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব গুম্ফ চ্যাম্পিয়নশিপে আমেরিকার পল স্লোসার ইংলিশ গোঁফ বিভাগে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন। তাঁর গোঁফের দৈর্ঘ্য ছিল ৬৩.৫ সেন্টিমিটার, মানে দুই ফুট এক ইঞ্চি।

তবে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা গোঁফের অধিকারী ভারতের রাম সিং চৌহান। তাঁর গোঁফের দৈর্ঘ্য ৪.২৯ সেন্টিমিটার, মানে পাক্কা ১৪ ফুট। এত বড় গোঁফ কীভাবে বানালেন, এর উত্তরে চৌহান বলেন, তিনি এ জীবনে একবারও তাঁর গোঁফে ছুরি-কাঁচি চালাননি।

আরও পড়ুন