চাঁদ ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কেন
চাঁদ প্রতিবছর পৃথিবী থেকে একটু একটু দূরে সরে যাচ্ছে। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ। এটা কোনো ক্লিকবেট লেখার শিরোনাম নয়, আসলেই চাঁদ দূরে সরছে। চাঁদ প্রতিবছর আমাদের থেকে প্রায় দেড় ইঞ্চি বা ৩ দশমিক ৮ সেন্টিমিটার করে দূরে চলে যায়। কিন্তু কেন? চাঁদ নিজের নিয়মে দূরে সরছে। কেন দূরে যাচ্ছে, তা জানার আগে জানতে হবে, চাঁদটা যে দূরে চলে যাচ্ছে, তা বিজ্ঞানীরা বোঝেন কীভাবে? তা ছাড়া চাঁদ তো সরছে মাত্র দেড় ইঞ্চি, এই সূক্ষ্ম হিসাবটা বিজ্ঞানীরা কীভাবে করেন?
আসলে এই ব্যাপারটা বুঝতে বিজ্ঞানীরা লেজারের আলো ব্যবহার করেন। অনেক বছর আগে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার অ্যাপোলো মিশনের নভোচারীরা চাঁদের বুকে কয়েকটি আয়না রেখে এসেছিলেন। পৃথিবী থেকে বিজ্ঞানীরা সেই আয়নায় শক্তিশালী লেজারের আলো ফেলেন। সেই আলো চাঁদে রাখা আয়নায় বাধা পেয়ে ফিরে আসে পৃথিবীতে। সেই আলো ফিরে আসতে কত সেকেন্ড সময় লাগে, তা মেপে বিজ্ঞানীরা নিখুঁতভাবে চাঁদের দূরত্ব বের করেন।
আবার চাঁদের কক্ষপথ কিন্তু পুরোপুরি গোল নয়। এটি কিছুটা ডিম্বাকৃতির। তাই মাসের বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর সঙ্গে এর দূরত্ব কিছুটা কমে ও বাড়ে। চাঁদ যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে চলে আসে, তখন আকাশে অনেক বড় দেখায়। একেই আমরা বলি সুপারমুন।
চাঁদ কেন দূরে সরে যাচ্ছে
চাঁদের দূরে যাওয়ার পেছনে দায়ী জোয়ার-ভাটা। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও কথাটা সত্যি। চাঁদের মহাকর্ষ বল পৃথিবীর সব জায়গায় সমান নয়। পৃথিবীর যে অংশ চাঁদের দিকে থাকে, সেখানে চাঁদের টান সবচেয়ে বেশি। এর ঠিক উল্টো দিকের অংশে টান সবচেয়ে কম। এই টানের পার্থক্যের কারণেই মহাসাগরের পানি দুই দিকে ফুলে ওঠে। তখন ফোলা অংশে জোয়ার হয়।
একদিকের পানি চাঁদের শক্তিশালী টানে ফুলে ওঠে। আর উল্টো দিকের পানি কিছুটা পিছিয়ে পড়ে আরেকটি ফোলা অংশ তৈরি করে। পৃথিবী যখন নিজের অক্ষে ঘোরে, তখন পানির এই ফোলা অংশ দুটিও চাঁদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘুরতে থাকে। এ কারণেই প্রতিদিন জোয়ার-ভাটা হয়।
জোয়ার-ভাটা যেভাবে চাঁদকে দূরে ঠেলে দেয়
এখন আসল মজাটা শোনো। পৃথিবী অনেক দ্রুত ঘোরে। ঘোরার সময় এটি পানির ফোলা অংশ দুটিকে একটু সামনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ফলে চাঁদের কাছাকাছি থাকা ফোলা অংশটি চাঁদকে সামান্য সামনের দিকে ধাক্কা দেয়।
ব্যাপারটা একটি রেসিং কারের মতো। একটি গাড়ি যখন দ্রুতগতিতে বাঁক নেয়, তখন তাকে সামনে থেকে ধাক্কা দিলে কী হবে? তার গতি আরও বেড়ে যাবে। চাঁদের ক্ষেত্রেও ঠিক তা–ই হয়। পৃথিবীর জোয়ারের এই অতিরিক্ত ধাক্কার কারণে চাঁদ তার কক্ষপথে একটু দ্রুত চলতে শুরু করে।
কোনো বস্তু যখন তার কক্ষপথে আরও দ্রুত ঘুরতে শুরু করে, তখন তার কক্ষপথটিও আকারে বড় হয়ে যায়। ফলে চাঁদ পৃথিবী থেকে একটু একটু করে দূরে সরতে থাকে। এই ঘটনাটি খুব ধীরে ধীরে ঘটে। তাই আমরা খালি চোখে তা বুঝতে পারি না।
চাঁদ দূরে যাওয়ায় পৃথিবীর কি কোনো সমস্যা হচ্ছে
চাঁদ দূরে সরে যাওয়ার এই অতিরিক্ত শক্তি কোথা থেকে পাচ্ছে? পৃথিবী থেকে। চাঁদকে শক্তি দিতে গিয়ে পৃথিবীর নিজের ঘোরার গতি কমে যাচ্ছে। ফলে আমাদের দিনের সময়ও সামান্য পরিমাণে বাড়ছে।
তাহলে অতীতে কেমন ছিল? কোটি কোটি বছর আগে চাঁদ পৃথিবীর অনেক কাছে ছিল। তখন আকাশে চাঁদকে আজকের চেয়ে অনেক বড় দেখাত। আর পৃথিবীর দিনগুলোও ছিল অনেক ছোট। বিজ্ঞানীরা জীবাশ্ম ঝিনুকের খোলস পরীক্ষা করে এটি জানতে পেরেছেন। যেমন ডাইনোসরদের যুগে, অর্থাৎ প্রায় ৭ কোটি বছর আগে, পৃথিবীতে এক দিন হতো মাত্র সাড়ে ২৩ ঘণ্টায়!
চাঁদ কি একসময় পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে যাবে
এখন প্রশ্ন হলো, চাঁদ কি একদিন আমাদের ছেড়ে চলে যাবে? না, তেমন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিজ্ঞানীরা বলেন, কোটি কোটি বছর পর পৃথিবীর ঘোরার গতি অনেক কমে যাবে। তখন হয়তো পৃথিবীর এক দিন আর চাঁদের এক মাস সমান হয়ে যাবে। সেই অবস্থায় চাঁদ আর দূরে সরবে না। একে বলে ‘টাইডাল লক’।
কিন্তু তার আগেই দুটি বড় ঘটনা ঘটবে। আজ থেকে প্রায় ১০০ কোটি বছর পর সূর্য আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। তখন পৃথিবীর সব সাগর শুকিয়ে বাষ্প হয়ে যাবে। ফলে জোয়ার-ভাটা তৈরির জন্য কোনো পানিই থাকবে না।
আরও কয়েক শ কোটি বছর পর সূর্য একটি বিশাল ‘লাল দৈত্য’ বা রেড জায়ান্টে পরিণত হবে। তখন এটি হয়তো আমাদের পৃথিবী ও চাঁদকে গিলে খাবে। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই ঘটনাগুলো ঘটতে এখনো কোটি কোটি বছর বাকি। তার আগপর্যন্ত তুমি নিশ্চিন্তে রাতের আকাশের সুন্দর চাঁদ, সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা আর আমাদের এই ২৪ ঘণ্টার দিন উপভোগ করতে পারো।
সূত্র: দ্য কনভার্সেশন-এর ‘কিউরিয়াস কিডস’ অবলম্বনে