প্রত্যেকের হাতের লেখা কেন আলাদা
একটা মজার পরীক্ষা দিয়ে শুরু করি। তোমার বাসায় যতজন সদস্য আছেন, প্রত্যেককে এক জায়গায় ডেকে নাও। এবার সবাইকে একটা কাগজ আর কলম দাও। এখন কবিতা বা গানের দুটি লাইন লিখতে বলো। তবে প্রত্যেককে একই লাইন লিখতে হবে। সবার লেখা শেষ হলে কাগজগুলো একসঙ্গে রাখ।
কী দেখছ? সবার হাতের লেখা কি এক রকম? নাকি প্রত্যেকের হাতের লেখার মধ্যে পার্থক্য আছে? আমি নিশ্চিত, প্রত্যেকের লেখায় সূক্ষ্ম পার্থক্য হলেও আছে। হয়তো কারও লেখা সরু, কারও লেখা মোটা, কারও লেখা একটু বাঁকা। অক্ষরও কোনোটা বড়, আবার কোনো অক্ষর দেখতে ছোট। কিন্তু কেন এমন হয়? সবাই একই অক্ষর দেখলেও হাতের লেখা কেন আলাদা হয়?
শুরুতে সহজে একটা উত্তর দিই। তারপর বিস্তারিত আলোচনা করব। আসলে হাতের লেখা একটা অসম্ভব জটিল কাজ। কিন্তু প্রতিদিন আমরা লেখি বলে তা আর কঠিন মনে হয় না। কিন্তু ভাবো তো, একটা অক্ষর লেখার সময় কত কিছু একসঙ্গে ঘটে! প্রথমে তোমার মস্তিষ্ক সেই অক্ষরের ছবি কল্পনা করে। তারপর স্নায়ু সেই নির্দেশ পৌঁছে দেয় হাত আর বাহুর পেশিগুলোতে। একই সময় তোমার চোখ দুটি কিন্তু দেখছে যে লেখাটা কেমন হচ্ছে। কোনো ভুল হলে তৎক্ষণাৎ মস্তিষ্ককে খবর দিচ্ছে সংশোধনের জন্য। এখানেই শেষ নয়, আশপাশের পরিবেশও হাতের লেখার ওপর প্রভাব ফেলে। সঙ্গে ঘরের তাপমাত্রা, মানসিক চাপ, তাড়াহুড়ো, মেজাজ—মোটামুটি সবকিছু মিলিয়ে এটা একটা জটিল প্রক্রিয়া।
এবার সেই জটিল প্রক্রিয়াটা আরও একটু বিশদে বোঝার চেষ্টা করি। তবে তার আগে জানিয়ে রাখি, হাতের লেখা মানে শুধু খাতার ওপর পেনসিল বা কলম দিয়ে অক্ষর সাজানো নয়। এটা অনেকটা তোমার ব্যক্তিত্বের ছাপ বা ফিঙ্গারপ্রিন্টের মতো। আঙুলের ছাপের মতো হাতের লেখাও একান্তই তোমার। এর পেছনে রয়েছে কিছু মজার বৈজ্ঞানিক কারণ এবং কিছু অভ্যাসগত ব্যাপার। সেগুলোই এখানে আলোচনা করছি।
মস্তিষ্কের খেলা
জানলে অবাক হবে, হাতের লেখার পেছনে আমাদের মস্তিষ্কের একটা বড় ভূমিকা আছে। তুমি যখন কিছু লেখ, তখন তোমার মস্তিষ্ক অনেক নির্দেশ একসঙ্গে দেয়। যেমন কলমটা কীভাবে ধরবে, কতটা চাপ দেবে, অক্ষরগুলো কীভাবে আঁকবে, শব্দগুলোর মধ্যে কতটা ফাঁকা রাখবে—এসব মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে। যেহেতু প্রত্যেকটা মানুষের মস্তিষ্ক আলাদাভাবে কাজ করে, তাই হাতের লেখাও আলাদা হয়। এটা অনেকটা গান গাওয়ার মতো। একই গান, একই সুর, তবুও প্রত্যেকটা মানুষের গলায় তা আলাদা শোনায়। মূল গানটা এক হলেও গায়কের পরিবেশনার কারণে তা বদলে যায়। হাতের লেখাটাও অনেকটা সে রকম।
কলম ধরার কায়দা
খেয়াল করলে দেখবে একেকজন একেকভাবে কলম ধরে। কেউ খুব শক্ত করে ধরে, আবার কেউ আলতোভাবে। কলম ধরার এই কায়দা হাতের লেখার ওপর অনেক প্রভাব ফেলে। যারা শক্ত করে কলম ধরে, তাদের লেখা মোটা ও গাঢ় হতে পারে। আবার যারা আলতো করে ধরে, তাদের লেখা হয়তো হালকা ও সরু হয়। এই ধরনের ভিন্নতার কারণেও একজনের হাতের লেখার সঙ্গে অন্যজনের লেখা মেলে না।
ছোটবেলার অভ্যাস
শৈশবে আমরা যখন প্রথম অক্ষর লিখতে শিখেছিলাম, তখন হয়তো শিক্ষক বা মা–বাবা আমাদের হাত ধরে লেখা শিখিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর আমরা যখন নিজেরা লিখতে শুরু করি, তখন নিজের মতো করে আবার অক্ষরগুলোকে চিনতে ও লিখতে শিখি। কে কীভাবে কলম ধরে, কোন অক্ষরটা কীভাবে বাঁকায়, তা তার অভ্যাসের ওপর নির্ভর করে। এই ছোট ছোট অভ্যাসগুলোই ধীরে ধীরে হাতের লেখাকে একটা নির্দিষ্ট রূপ দেয়। যেমন কেউ হয়তো ‘অ’ লিখতে গিয়ে একটু বেশি গোল করে। আবার কেউ একটু লম্বা করে। কেউ হয়তো মাত্রার টানটা একটা বড় দেয়। এভাবে অনেক কিছু মিলিয়ে লেখা বদলে যায়।
পেশি ও স্নায়ুর সমন্বয়
আমাদের হাতে ছোট ছোট অনেক পেশি আর স্নায়ু আছে। এই পেশি আর স্নায়ুগুলো একসঙ্গে কাজ করে হাতের লেখাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তুমি লেখার সময় মস্তিষ্ক থেকে নির্দেশ আসে। মস্তিষ্কের সেই নির্দেশ অনুসারে পেশিগুলো নড়াচড়া করে। যেহেতু প্রত্যেক মানুষের পেশির গঠন এবং মস্তিষ্কের কাজ করার ধরন একটু হলেও আলাদা, তাই হাতের লেখাতেও এই পার্থক্যটা ফুটে ওঠে।
মনের প্রভাব
তোমার মন কেমন আছে, তার ওপরও হাতের লেখা নির্ভর করে। যখন তুমি খুব খুশি বা রিল্যাক্সড থাকো, তখন তোমার লেখা হয়তো সুন্দর ও মসৃণ হয়। কিন্তু রেগে থাকলে বা খুব তাড়াহুড়ো করলে লেখা এলোমেলো বা অগোছালো হয়ে যায়। এর থেকেই বোঝা যায়, হাতের লেখা শুধু কলম ধরার ওপর নির্ভর করে না, মানসিক অবস্থাও এর সঙ্গে জড়িত।
পরিবেশের প্রভাব
পরিবেশও কিন্তু হাতের লেখার ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলে। ধরো, তুমি যখন ছোট ছিলে, তখন তোমার শিক্ষক বা বন্ধুরা যে ধরনের লেখার স্টাইল অনুসরণ করত, সেটার একটা প্রভাব তোমার ওপর পড়তে পারে। আবার কেউ কেউ শখ করে ক্যালিগ্রাফি শেখে। তাদের হাতের লেখা অন্যদের থেকে আলাদা হয়। কারণ, তারা বিশেষ নিয়ম মেনে লেখে। কিন্তু এই শেখা হয়তো তাদের স্বাভাবিক লেখার ধরনের সঙ্গে মিলে একটা নতুন ধরন তৈরি করে।
সময়ের সঙ্গে বদলে যায়
খেয়াল করলে দেখবে, হাতের লেখা সব সময় এক রকম থাকে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে বদলাতে পারে। শৈশবে তোমার হাতের লেখা যেমন ছিল, এখন হয়তো তেমন নেই। এমনকি বড় হওয়ার পরও হাতের লেখা বদলাতে পারে। নতুন অভ্যাস, কাজের ধরন বা শারীরিক পরিবর্তনের কারণে হয় এই বদল হয়। অবশ্য সময়ের সঙ্গে হাতের লেখা বদলানোর আরও কিছু কারণ আছে। কেন এবং কীভাবে সময়ের সঙ্গে হাতের লেখা বদলে যায়, তা নিয়ে পরের লেখায় আলোচনা করব।
যা–ই হোক, প্রত্যেকের হাতের লেখা আলাদা হয়ে হয়তো ভালোই হয়েছে। সবার হাতের লেখা এক রকম হলে হয়তো বোরিং লাগত। কম্পিউটারে টাইপ করার জন্য দেখো কত ফন্ট আছে! পৃথিবীতে তো মাত্র একটা ফন্টই থাকতে পারত। কিন্তু না, নিজস্বতা বজায় রাখার জন্য একেক প্রতিষ্ঠান একেকটি ফন্ট ব্যবহার করে। হাতের লেখাও তেমনি তোমার নিজস্বতা।
সূত্র: ওন্ডারপোলিস ডটঅর্গ ও সায়েন্স ডাইরেক্ট ডটকম