জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ কি মহাবিশ্বের প্রাচীনতম সুপারনোভা ধরতে পেরেছে

মহাবিশ্বের প্রাচীনতম সুপারনোভানাসা

মহাবিশ্বের শুরু দিকের কথা। বিগ ব্যাংয়ের পর মাত্র ৭৩ কোটি বছর পেরিয়েছে। আমাদের জীবনের সময়ের তুলনায় ৭৩ কোটি বছরকে অনেক বিশাল সময় মনে হতে পারে। তবে মহাবিশ্বের বয়স হিসাবে এটা কেবল মহাবিশ্বের শৈশবের সময়কার ঘটনা। সে সময়ে এক বিশাল তারার বিস্ফোরণ ঘটেছিল। ফলে তৈরি হয়েছিল আলো আর শক্তির এক ভয়ংকর ঝলক, যা সম্ভবত এখন পর্যন্ত মানুষের জানা মহাবিশ্বের প্রাচীনতম সুপারনোভা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ ব্যবহার করে এমনই এক বিস্ময়কর ঘটনার সন্ধান পাওয়া গেছে।

২০২৫ সালের মার্চে টেলিস্কোপে ধরা পড়ে এক শক্তিশালী গামা-রে বিস্ফোরণ। পরে বিশ্লেষণে দেখা যায়, এটি তৈরি হয়েছিল একটি বিশাল তারার মৃত্যুর মাধ্যমে। মহাবিশ্বের দূরতম জায়গায়, যেখানে তখনো গ্যালাক্সি গঠনের প্রাথমিক পর্যায় চলছিল।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে ধরা পড়া ছবিতে অসংখ্য নক্ষত্র আর গ্যালাক্সির ভিড়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা দেখা গেছে। যাচাই করে দেখে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ছবির লালচে বিন্দুই সেই সম্ভাব্য সুপারনোভা। একটি তারার শেষ মুহূর্তের চিহ্ন।

আরও পড়ুন

এই বিস্ফোরণ ঘটেছিল এমন এক সময়, যখন মহাবিশ্বের বয়স ছিল মাত্র ৭৩ কোটি বছর। এত দূরের এবং এত প্রাচীন কোনো সুপারনোভা আগে কখনো সরাসরি দেখা যায়নি। তাই এই আবিষ্কার শুধু নতুন রেকর্ড না, মহাবিশ্বের শুরুর দিককার তারাগুলো বোঝার এক বিরল সুযোগ।

এই শক্তিশালী বিস্ফোরণটির নাম দেওয়া হয়েছে জিআরবি ২৫০৩১৪এ। এটি প্রথম শনাক্ত করে স্পেস ভেরিয়েবল অবজেক্টস মনিটর নামের একটি ছোট এক্স-রে টেলিস্কোপ, যা চীন ও ফ্রান্স যৌথভাবে তৈরি করেছে। প্রথম সংকেত পাওয়ার মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, এই গামা-রে বিস্ফোরণটি এসেছে বিগ ব্যাংয়ের ঠিক পরের যুগ থেকে।

গামা-রে বিস্ফোরণ মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘটনাগুলোর একটি। এগুলো সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে মিনিটখানেক স্থায়ী হয়। কোনোটি নিউট্রন তারার সংঘর্ষে তৈরি হয়, আবার দীর্ঘস্থায়ী বিস্ফোরণগুলো ঘটে বিশাল তারার মৃত্যুর সময়। যখন তারা ধসে পড়ে নিউট্রন তারা বা ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয়।

আরও পড়ুন

জিআরবি ২৫০৩১৪এ-এর ক্ষেত্রে বিস্ফোরণটি প্রায় ১০ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল। তাই বিজ্ঞানীদের ধারণা, এটি একটি বিশাল তারার বিস্ফোরণ। মানে একটি সুপারনোভার ফল।

এ ধরনের বিস্ফোরণের পর সাধারণত কয়েক দিন ধরে একধরনের ম্লান আলো রয়ে যায়, যাকে বলা হয় ‘আফটারগ্লো’। এক্স-রে, ইনফ্রারেড আর দৃশ্যমান আলোয় ধরা পড়ে এই ঝিলিক। জেমস ওয়েব যখন ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করে, তখন সেই আফটারগ্লো অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছিল। ফলে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, দেখা যাওয়া আলো শুধু আফটারগ্লো বা গ্যালাক্সি থেকে আসছে না, এর পেছনে নিশ্চয়ই অন্য কিছু আছে।

নেদারল্যান্ডসের র‍্যাডবাউড ইউনিভার্সিটি ও যুক্তরাজ্যের ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এ জে লেভান বলেন, ‘আমরা সত্যিই বিস্মিত হয়েছি। আমাদের পূর্বাভাস এত নিখুঁতভাবে কাজ করেছে, আর আমরা দেখাতে পেরেছি যে জেমস ওয়েব এত দূরের একটি বিস্ফোরিত তারা আলাদাভাবে দেখতে পারে, এটা অভাবনীয়।’

আরও পড়ুন

গবেষকেরা হিসাব করে দেখেছেন, যদি আলোটা শুধু গ্যালাক্সি থেকেই আসত, তাহলে সেই গ্যালাক্সিটিকে অত্যন্ত ছোট হতে হতো। পাশাপাশি এটিকে আরও পুরোনো হতে হতো। এমন তারা হতে হতো, যেগুলো তৈরি হয়েছিল বিগ ব্যাংয়ের মাত্র ২০ কোটি বছর পর। এমন গ্যালাক্সিতে সাধারণত গামা-রে বিস্ফোরণ দেখা যায় না। তাই শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান, এই আলো এসেছে একটি সুপারনোভা থেকে।

চমকের বিষয় হলো, এই সুপারনোভাটির বৈশিষ্ট্য আজকের সময়ের সুপারনোভাগুলোর সঙ্গে বিস্ময়করভাবে মিলে গেছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করতেন, প্রাচীন মহাবিশ্বের তারাগুলোর গঠন আধুনিক তারাদের থেকে অনেকটাই আলাদা হবে। কিন্তু এই পর্যবেক্ষণ সেই ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে।

এই গবেষণার দুটি আলাদা প্রতিবেদন ৯ ডিসেম্বর অ্যাসট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাসট্রোফিজিকস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। বিজ্ঞানীরা আগামী বছর আবার পর্যবেক্ষণ চালাবেন, যখন সুপারনোভাটি আরও ম্লান হয়ে যাবে। তখন আফটারগ্লো, গ্যালাক্সি আর সুপারনোভার আলোর পার্থক্য আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে।

আরও পড়ুন