এক মাসে ৬০টির বেশি সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া জয় করবেন যিনি

পর্বতারোহী কিলিয়ান জর্নেটছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

কিশোর আলোর আগস্ট মাসের আড্ডায় এসেছিলেন এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহী ইকরামুল হাসান শাকিল। গত ১৯ মে তিনি বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট জয় করেন। আড্ডায় কিশোর আলোর এক পাঠক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কেন এভারেস্ট জয় করতে গেলেন?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এমন কিছু করতে চেয়েছিলাম, যা আগে কেউ করেনি।’ তিনি কক্সবাজার সমুদ্রতীর থেকে হাঁটা শুরু করে এভারেস্টের চূড়া পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন।

এমন অসাধ্য সাধনের গল্প মাঝেমধ্যে শোনা যায়। যাঁরা সাধারণের ধারণার বাইরে গিয়ে এমন এক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন, যা সবার কাছে বিস্ময়ের কারণ হয়ে ওঠে—এমন একজন পর্বতারোহী হলেন কিলিয়ান জর্নেট। যিনি তাঁর পুরো জীবন কাটিয়েছেন পাহাড়ের আনাচকানাচে। পাহাড় তাঁর জন্য একধরনের গভীর আসক্তি। এই পাহাড়ের কঠিন পথে ভ্রমণ করার বিভিন্ন কৌশলে তাঁর মতো দক্ষ মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

শাকিল ইনানী সমুদ্রসৈকত থেকে পায়ে হেঁটে পৌঁছেছেন এভারেস্টের চূড়ায়
ছবি: আব্দুল ইলা

কিলিয়ান জর্নেটের সাফল্য আর দক্ষতার বুঝি শেষ নেই। ৩৭ বছর বয়সী এই পর্বতারোহী স্কাইরানিংয়ে একাধিক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। স্কাইরানিং হলো পাহাড়ের উচ্চতায় ট্রেইল ধরে দৌড়ানো। এ ছাড়া জিতেছেন স্কি মাউন্টেনিয়ারিংয়ের একাধিক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। তিনিও একজন এভারেস্টজয়ী। এক সপ্তাহের মধ্যে কোনো অতিরিক্ত সহায়তা বা অক্সিজেন ছাড়াই মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছেন দুবার। ১০৬ মাইলের ‘আলট্রা ট্রেইল ডু মন্ট ব্লাঁ’ ম্যারাথনে চারবার বিজয়ী হয়েছেন

আরও পড়ুন

কে এই কিলিয়ান জর্নেট

কিলিয়ান জর্নেটের উচ্চতা ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি আর ওজন ৫৮ কেজি। ‘ফিট’ শব্দটা যেন জর্নেটের জন্যই তৈরি হয়েছে। তিনি এবার তাঁর জীবনের সবচেয়ে দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জগুলোর একটি নিতে চলেছেন। তাঁর লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রের কন্টিনেন্টাল অংশের সবচেয়ে উঁচু চূড়াগুলো জয় করা। এর মধ্যে কলোরাডো, ক্যালিফোর্নিয়া ও ওয়াশিংটনের ৬০টির বেশি পর্বত রয়েছে। এ পর্বতগুলোর প্রতিটি চূড়ার উচ্চতা ১৪ হাজার ফুটের বেশি বলে সেগুলোকে ‘14ers’ নামে ডাকা হয়। তিনি এ চূড়াগুলো বাইক চালিয়ে বা হেঁটে অতিক্রম করবেন।

স্পেনের এই অভিযাত্রী বর্তমানে স্ত্রী এমিলি ফরসবার্গ এবং তিন মেয়েকে নিয়ে নরওয়েতে থাকেন। তাঁর মতে, ‘খেলাধুলা মানে শরীরকে সচল রাখা। এর একটি উদ্দেশ্যও থাকে। আমি দেখতে চাই মানুষ হিসেবে আমরা কীভাবে নিজেদের সক্ষমতাকে আরও বাড়াতে পারি।’ জর্নেট যখন তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং স্পেনের জাতীয় স্কি মাউন্টেনিয়ারিং দলের সাবেক সতীর্থ মিরেয়া মিরো ভারেলাকে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানান, তখন মিরেয়া অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, ‘তুমি নিশ্চিত এটা করবে? মানচিত্র দেখে মনে হচ্ছে এটা অনেক কঠিন।’

আরও পড়ুন

'স্টেটস অব এলিভেশন’ চ্যালেঞ্জ

জর্নেট এ প্রকল্পের নাম দিয়েছেন ‘স্টেটস অব এলিভেশন’। এই অভিযানের একটি খসড়া পরিকল্পনায় দেখা গেছে, তাঁকে দৌড়ানো, হাইকিং এবং বাইকে চড়ে প্রায় তিন হাজার মাইল পথ অতিক্রম করতে হবে। এর মধ্যে ৬০০ মাইলের বেশি দৌড়াতে ও হাঁটতে হবে এবং বাকি ২ হাজার ৪০০ মাইল বাইসাইকেল চালাতে হবে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে কলোরাডোতে এই দুঃসাহসিক অভিযান শুরু করবেন তিনি। সবকিছু পরিকল্পনামতো চললে এটি শেষ করতে প্রায় এক মাস সময় লাগবে। এই যাত্রায় তাঁকে এক দিনে প্রায় এক ডজন চূড়ায় পৌঁছানোর পর আবার ফিরে এসে ৫০ মাইল সাইকেল চালাতে হবে। এই সবকিছু করতে তিনি বিশ্রামের সময় পাবেন খুব কম।

জর্নেটের এই অভিযানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ওয়াশিংটন পর্যন্ত ৫০০ মাইল বাইসাইকেলে পাড়ি দেওয়া, যা তাঁর প্রকল্পের প্রায় শেষ দিকে পড়বে। এই পথে শারীরিক ধকল তো আছেই। এর আগে এত বেশি সাইক্লিং তিনি করেননি। এ ছাড়া রাস্তায় ট্রাকের ধাক্কা লাগার ব্যাপারেও তিনি চিন্তিত। তাঁর বন্ধু মিরেয়া মিরো ভারেলা এই অভিযানে রসদ ব্যবস্থাপনায় তাঁকে সাহায্য করছেন এবং কম যানজটপূর্ণ রাস্তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।

নিজের শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে জর্নেট মোটেই চিন্তিত নন। এ বছর জুনে তিনি ১৪ বছর বিরতির পর আবার ক্যালিফোর্নিয়ার সিয়েরা নেভাদা অঞ্চলের ‘ওয়েস্টার্ন স্টেটস ১০০ মাইল এনডুরেন্স রানে’ অংশ নিয়েছেন। এবার তাঁর সময় লেগেছে ১৪ ঘণ্টা ১৯ মিনিট ২২ সেকেন্ড এবং তিনি তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন। এ সময়টি তাঁর ২০১১ সালের জয়ের সময়ের চেয়েও এক ঘণ্টার বেশি কম।

আরও পড়ুন

ভয় ও অনুপ্রেরণা

ভয় নিয়ে জর্নেটের মনে কোনো দ্বিধা নেই। পাহাড় তাঁর কাছে দূরের কিছু নয়। সুযোগ পেলে তিনি দিনের ২৪ ঘণ্টাই পাহাড়ে কাটান। মা–বাবার কাছ থেকে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখেছিলেন সেই ছোটবেলায়। তাঁর মা–বাবা একটা অদ্ভুত কাজ করতেন—তাঁকে আর তাঁর বোনকে বনের মধ্যে ছেড়ে দিতেন, যেন তাঁরা নিজেরাই পথ খুঁজে বাড়ি ফিরে আসতে পারে। নিজের স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, ‘এভাবে খুব স্বাভাবিক ও অবচেতনভাবে আমরা মায়ের কাছ থেকে পাহাড়ের অংশ হওয়া শিখেছি।’

এখন প্রতিযোগিতায় সাফল্যের চেয়ে ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ নেওয়াকে বেশি গুরুত্ব দেন জর্নেট। তিনি মনে করেন, মানুষ হিসেবে আমাদের সহজাত ক্ষমতা অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। তিনি দেখতে চান, সপ্তাহে ৮০ ঘণ্টা পাহাড়ের খাড়া ঢালে কাটালে কী হয়? প্রতিদিন শত শত মাইল বাইসাইকেল চালালে আমাদের কেমন লাগে।

জর্নেট একদম ভয় পান না—এমন নয়। তাঁর মনেও নানা রকম ভয় কাজ করে। যেসব বিষয় তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সেসব তিনি সবচেয়ে বেশি ভয় পান। যেমন রাস্তায় লরি বা বড় গাড়ি, বজ্রপাত, বন্য প্রাণী বা হঠাৎ করে আসা কোনো বিপদ। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করতে চান তিনি। সামনে এগিয়ে যেতে চান। স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, সবচেয়ে ভালো সময়টা সব সময়ই এখন। সবচেয়ে ভালো স্মৃতি তৈরি হবে আগামীকাল। কারণ, সামনে সব সময়ই দৌড়ানোর জন্য আছে আরও একটি পথ। জয় করার জন্য অপেক্ষা করছে আরও একটি পর্বত।’

এভাবে সচল থেকেই জর্নেট কাটাতে চান একজন পর্বতারোহীর জীবন।

সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস

আরও পড়ুন