পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ১০ বিমানবন্দর
বাস, ট্রেন বা লঞ্চ টার্মিনালের কথা ভাবলেই আমাদের চোখে কেমন একটা ভীতির ছবি ভেসে ওঠে, তাই না? ভিড়, হইচই আর অপরিচ্ছন্নতার কারণে এসব জায়গায় সাধারণত মানুষ সখ করে যেতে যায় না। কিন্তু পৃথিবীর এমন কিছু বিমানবন্দর আছে, যেখানে গেলে তোমার এই ধারণা পুরোপুরি বদলে যাবে। এগুলো এত ঝকঝকে যে আয়না ভেবে ভুল করতে পারো! সম্প্রতি স্কাইট্র্যাক্স ২০২৫ সালের পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বিমানবন্দরগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছে। আর সেই তালিকায় পূর্ব এশিয়ার বিমানবন্দরগুলোর সংখ্যাই বেশি দেখা যাচ্ছে। চলো, সেগুলো সম্পর্কে একটু জেনে নিই।
১. টোকিও হানেদা এয়ারপোর্ট (জাপান)
তালিকার একেবারে শীর্ষে থাকা টোকিও হানেদা এয়ারপোর্ট যেন এক পরিচ্ছন্নতার শিল্প। বছরে সাড়ে আট কোটিরও বেশি যাত্রী এই এয়ারপোর্ট দিয়ে যাতায়াত করে। কিন্তু তাই বলে পরিচ্ছন্নতার মান একচুলও কমেনি। জাপানিদের সব কাজে যে একটা নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা থাকে, তার সেরা উদাহরণ যেন এই বিমানবন্দর। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা এখানে কাজ করে একদল প্রশিক্ষিত বিশেষ পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তাদের হাতে থাকে সর্বাধুনিক সব যন্ত্রপাতি। যেমন, মাঝরাতে পুরো টার্মিনাল জুড়ে ঘুরে বেড়ায় আলট্রাভায়োলেট রশ্মি ছড়ানো রোবট। ওগুলো জীবাণুদের বিনাশ করে। আর এখানকার বাথরুমগুলোও একটা বিস্ময়! সম্পূর্ণ টয়লেট স্বয়ংক্রিয়। তুমি বাথরুমে গেলেই টয়লেটের সিটগুলো একটু মাথা নুইয়ে শুভেচ্ছা জানাবে। জাপানিরা কিন্তু মাথা নুইয়ে শুভেচ্ছা জানায়!
২. সিঙ্গাপুর চাঙ্গি এয়ারপোর্ট (সিঙ্গাপুর)
দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর চাঙ্গি এয়ারপোর্ট। এটি শুধু বিমানবন্দর নয়, যেন একটা সবুজ বাগান। কাঁচের দেয়ালের ভেতরে আস্ত একটা জলপ্রপাত আর বনজঙ্গল বানিয়ে ফেলা হয়েছে। আর এটা যে অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন, তা হয়তো আর আলাদাভাবে বলতে হবে না। এই বিমানবন্ধরে ৫০০ জনেরও বেশি কর্মী শিফটে ভাগ হয়ে কাজ করেন, যাতে কোনো স্থান অপরিষ্কার না থাকে। তাদের সাহায্য করে স্বয়ংক্রিয় ক্লিনিং মেশিন। ওগুলো নিজেরাই পুরো টার্মিনাল ঘুরে ঘুরে পরিষ্কার করে। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হলো তাদের ময়লা ফেলার ব্যবস্থা। ময়লা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে তা ভ্যাকুয়াম পাইপের মাধ্যমে সোজা চলে যায় নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে। ফলে হাত দিয়ে ময়লা বহনের ঝামেলা নেই, দূষণেরও আশঙ্কা কম।
৩. দোহা হাম্মাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (কাতার)
কাতারের এই বিমানবন্দরটি আছে তিন নম্বরে। মরুভূমির মাঝে থেকেও এর ঝকঝকে মার্বেলের মেঝে আর সুন্দর পরিবেশ তোমাকে মুগ্ধ করবেই। এখানে পরিষ্কারের কাজ করা হয় অঞ্চলভিত্তিক। বিশেষায়িত দল নির্দিষ্ট এলাকার দায়িত্ব পালন করে। এখানে পরিবেশবান্ধব উপায়ে সবকিছু ব্যবহৃত হয়। আর পানি পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থাও রয়েছে। এই বিমানবন্দরে একটা বিশালাকার টেডি বিয়ার আছে। ওটাকে নিয়মিত পরিস্কার রাখার জন্যও আছে নির্দিষ্ট ব্যবস্থা।
৪. সিউল ইনচিউন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (দক্ষিণ কোরিয়া)
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধান এই বিমানবন্দরটি আছে তালিকার চার নম্বরে। এখানে প্রযুক্তি আর মানুষের পরিশ্রম মিলেমিশে একাকার। জীবাণুনাশক রোবটগুলো নিজেরাই ঘুরে ঘুরে কাজ সারে, আর কর্মীরাও তাদের নির্দিষ্ট রঙের পোশাক পরে ঝকঝকে রাখে সবকিছু। ব্যস্ত সময়ে যাত্রীদের বিশ্রামের জায়গাগুলো প্রতি ৩০ মিনিট পর পর পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত করা হয়। বছরে ৭ কোটির বেশি মানুষ যাতায়াত করে এই বিমানবন্দর ধরে।
৫. হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (হংকং)
কৃত্রিম দ্বীপের ওপর বানানো এই বিমানবন্দরকে ঘূর্ণিঝড় আর প্রচণ্ড আর্দ্রতার সঙ্গে লড়াই করতে হয়। তবুও বিমানবন্দরটি রয়েছে সেরা পাঁচে। এখানে এমন আধুনিক সেন্সর ব্যবস্থা আছে যে, ময়লা দেখলেই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সংকেত পাঠায়। এমনকি বাথরুমে কতজন যাচ্ছে, সেই হিসাব রেখে পরিচ্ছন্নতার সময়সূচিও ঠিক করে রাখে।
৬. সেন্ট্রেয়ার নাগোয়া এয়ারপোর্ট (জাপান)
তালিকায় আবারও জাপানের নাম। টোকিওর মতো বিশাল না হলেও পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে এরাও একবিন্দু ছাড় দেয় না। এখানকার কাঠের স্থাপত্যগুলোকে পরিষ্কার রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সেগুলো দেখতেও দারুণ লাগে।
৭. টোকিও নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (জাপান)
টোকিওর দ্বিতীয় বিমানবন্দরটিও পিছিয়ে নেই। হানেদার চেয়ে পুরোনো হলেও নারিতা পরিচ্ছন্নতার মান ধরে রেখেছে দারুণভাবে। এখানকার বর্জ্য ফেলার স্টেশনগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করা হয়। এআইয়ের সাহায্যে ময়লা আলাদা করা হয় এই এয়ারপোর্টে।
৮. কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (জাপান)
জাপানের ওসাকা উপসাগরের একটি কৃত্রিম দ্বীপে তৈরি এই বিমানবন্দরকে সমুদ্রের লবণাক্ত বাতাস আর আর্দ্রতার সঙ্গে লড়াই করতে হয়। এখানকার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বিশেষ ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করে বিমানবন্দরের স্টিলের কাঠামোকে মরিচা থেকে বাঁচায় এবং চকচকে রাখে।
৯. তাওয়ুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (তাইওয়ান)
তালিকায় নয় নম্বরে থাকা তাইওয়ানের এই বিমানবন্দর পরিচ্ছন্নতাকে এত গুরুত্ব দেয় যে, তাদের কর্মীদের প্রতি তিন মাস পর পর পরীক্ষা দিয়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়। কোথাও কোনো ময়লা হলে খবর দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটি বিশেষ দল এসে হাজির হয়। ময়লা পরিস্কার করে আবার নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে অপেক্ষা করেন কর্মীরা।
১০. জুরিখ এয়ারপোর্ট (সুইজারল্যান্ড)
সেরা দশের তালিকায় একমাত্র ইউরোপীয় বিমানবন্দর এটি। সুইজারল্যান্ডের কথা উঠলেই পরিচ্ছন্নতার কথাটা মাথায় আসে। জুরিখ বিমানবন্দর সেই সুনাম ধরে রেখেছে। তারা পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার করে এবং তাদের বর্জ্যের ৬০ শতাংশেরও বেশি রিসাইকেল করা হয়।
বিমানবন্দরগুলো শুধু পরিচ্ছন্নতার জন্যই বিখ্যাত নয়, এমন পরিবেশে যাত্রীরাও নিশ্চয়ই শান্তি পায়। এসব জায়গা প্রমাণ করে, লাখো মানুষকে সেবা দিয়েও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা সম্ভব। তবে এতটা পরিস্কার হলেও পাঁচ সেকেন্ডের নিয়ম মেনে খাবার কুড়িয়ে খাওয়ার চেষ্টা কোরো না! পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বিমানবন্দরও কিন্তু সব দিক থেকে নিখুঁত নয়। কী, পাঁচ সেকেন্ডের নিয়মটা জানো না? থাক, সে গল্প অন্যদিন বলব।
সূত্র: অ্যাভিয়েশন এটুজেড