জাপানে ট্রেনের সময় দেখে ঘড়ির সময় ঠিক করেন যাত্রীরা

জাপানি সমাজে সময়ানুবর্তিতা এবং শৃঙ্খলার ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিতজাপান রেল পাস

জাপানের মানুষ সময়ানুবর্তিতার জন্য সারা বিশ্বে পরিচিত। জাপানীদের মতো তাদের রেল সময় মেনে চলে। এমনও বলা হয়, জাপানে ট্রেনের সময় দেখে মানুষ নিজেদের ঘড়ির সময় ঠিক করে নেয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেখানে ট্রেনের দেরি হওয়া একটি নিয়মিত ঘটনা, সেখানে জাপানে এক মিনিটের বেশি দেরি হওয়া প্রায় বিরল। কিন্তু কীভাবে জাপানের ট্রেনগুলো এত নিখুঁতভাবে সময় মেনে চলে?

জাপানের ঠিক সময় স্টেশনে পৌঁছানোর রেল ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল উনিশ শতকের শেষেরদিকে। যখন মেইজি পুনর্গঠনের মাধ্যমে জাপান আধুনিকীকরণ শুরু করে। মেইজি (Meiji) হলো জাপানের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যুগ, যা ১৮৬৮ সাল থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এটি মূলত সম্রাট মেইজি বা সম্রাট মুৎসুহিতো-এর ৪৫ বছরের শাসনকাল। মেইজি পুনর্গঠনের সময়কালে জাপান তাদের ঐতিহ্যবাহী ধূপঘড়ি (Incense clocks) এবং আকাশ দেখে দিন রাতের হিসাবের বদলে পশ্চিমা বিশ্বের যান্ত্রিক ঘড়ি এবং সময় পরিমাপের পদ্ধতি গ্রহণ করে।

ফলে জাপানি সমাজে সময়ানুবর্তিতা এবং শৃঙ্খলার ধারণা আগের থেকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। একই সময়ে, উনিশ শতকের শেষ থেকে জাপানে রেলপথ নির্মাণ শুরু হয়। গত ১৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই রেল ব্যবস্থা একটি অত্যন্ত সুসংগঠিত এবং দক্ষ নেটওয়ার্কে পরিণত হয়েছে সারা জাপানজুড়ে। দীর্ঘদিনের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাই জাপানের এই অতুলনীয় রেল ব্যবস্থার শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করেছে।

আরও পড়ুন
ট্রেন সময়মতো ছাড়ার পেছনে আছেন দক্ষ কর্মী এবং তাঁদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ
জাপান রেল পাস

জাপানের ট্রেনের এই সময়ানুবর্তিতার পেছনের মূল কারণ সূক্ষ্ম পরিকল্পনা, উন্নত প্রযুক্তি, কর্মীদের দক্ষতা এবং তাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ। জাপানি সংস্কৃতিতে সময়ানুবর্তিতা এবং অন্যের প্রতি সম্মান দেখানোকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। একজন ব্যক্তি যদি দেরি করেন তবে তিনি কেবল নিজের সময় নষ্ট করেন না, বরং অন্যদেরও অসম্মান করেন। জাপানের এই ধারণাটিই তাদের রেল ব্যবস্থার প্রতিটি ধাপে দেখা যায়। রেলের প্রতিটি কর্মী বিশ্বাস করেন সময় মতো ট্রেন চালানো তাঁর নৈতিক দায়িত্ব।

জাপানে ট্রেনের সময়সূচি খুব সূক্ষ্মভাবে তৈরি করা হয়। যেখানে প্রতি সেকেন্ড পর্যন্ত হিসাব করা হয়। নির্ধারিত সময়ের ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে ট্রেন ছাড়লে বা পৌঁছালে তাকে সময়মতো ধরা হয়। এমনকি, বেশিরভাগ ট্রেন তাদের নির্ধারিত সময়ের ৬ সেকেন্ডের মধ্যেই স্টেশনে পৌঁছে যায়। এছাড়াও, অপ্রত্যাশিত বিলম্ব মোকাবিলা করার জন্য সময়সূচিতে বাফার টাইম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যাতে রেলের সময়ের তেমন কোনো সমস্যা না হয়।

আরও পড়ুন

জাপানের ট্রেনগুলো তাদের সময়ানুবর্তিতা বজায় রাখার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে। স্বয়ংক্রিয় ট্রেন নিয়ন্ত্রণ (ATC) প্রযুক্তি ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রণ করে এবং দুটি ট্রেনের মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে। এছাড়াও, স্বায়ত্তশাসিত বিকেন্দ্রীভূত পরিবহন পরিচালনা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (ATOS) নামে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ প্রতিটি ট্রেনের অবস্থান ও অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে রিয়েল-টাইমে। এমনকি, জাপানের উচ্চগতির শিনকানসেন ট্রেনের জন্য বিশেষ COSMOS ব্যবস্থা রয়েছে। যা ট্রেনের সময়সূচি থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণ পর্যন্ত সব দিক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করে।

জাপানে যাত্রীদের দ্রুত এবং সহজে ট্রেনে ওঠানামার জন্য প্ল্যাটফর্মে বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। প্ল্যাটফর্মে নির্দিষ্ট স্থানে চিহ্ন দেওয়া থাকে, যা দেখে যাত্রীরা বুঝতে পারেন ট্রেনের দরজা ঠিক কোথায় খুলবে। এতে যাত্রীরা আগে থেকেই সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে পারেন, ফলে তাড়াহুড়ো বা বিশৃঙ্খলা হয় না। একই সঙ্গে, ট্রেন কর্মীরা দ্রুত ওঠানামায় সহায়তা করেন এবং নিশ্চিত করেন যে ট্রেন স্টেশনে যেন ন্যূনতম সময় ব্যয় করে। যাত্রী এবং কর্মীদের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার কারণেই ট্রেনগুলো ঠিক সময়মতো স্টেশন ছেড়ে যেতে পারে।

আরও পড়ুন

জাপানে ট্রেন কর্মীরা সুনির্দিষ্ট ও কঠিন পরিস্থিতি সামলানোর জন্য ব্যাপক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাদের প্রশিক্ষণের একটি উল্লেখযোগ্য কৌশল হলো ‘শিসা কানকো’ মানে ইশারা এবং ডাক। এই পদ্ধতিতে কর্মীরা প্রতিটি কাজ করার সময় ইশারা ব্যবহার করেন এবং একইসঙ্গে জোরে জোরে উচ্চারণ করেন। এটাও করা হয় যাত্রীদের দ্রুত ওঠানামার জন্য।

জাপানে যদি কোনো ট্রেন এক মিনিটের বেশি দেরি করে, তবে যাত্রীদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া হয়। রেল কর্তৃপক্ষ এই ধরনের বিলম্বকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখে এবং এর জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করে। যদি কোনো ট্রেন সাধারণত ৫ মিনিট বা এর বেশি দেরি করে, তাহলে রেল কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের জন্য একটি ‘বিলম্বিত সার্টিফিকেট’ প্রদান করে। এটি একটি ছোট কাগজের স্লিপ। এটা দেখিয়ে প্রমাণ করা যার ট্রেনটি দেরি করেছিল।

আরও পড়ুন

এই সার্টিফিকেটটি ছাত্রছাত্রীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি ট্রেনের দেরির কারণে কোনো শিক্ষার্থী স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেরিতে পৌঁছায়, তবে তারা এই সার্টিফিকেটটি কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়ে প্রমাণ করতে পারে যে তাদের বিলম্ব ব্যক্তিগত ভুলের জন্য হয়নি। একইভাবে কর্মজীবীরাও দেরির কারণ হিসেবে এটি তাদের কর্মস্থলে জমা দেন।

২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে জাপানের বিখ্যাত হাইস্পিড বুলেট ট্রেন ১৭ মিনিট দেরি হয় একটি ১৬ ইঞ্চি সাপের কারণে। এর আগে ২০১৭ সালে সুকুবা এক্সপ্রেস নামক একটি রেলের একজন চালক ২০ সেকেন্ড আগে ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন।

সূত্র: জাপান রেল পাস, সায়েন্স এবিসি, জাপান-এক্সপেরিয়েন্স

আরও পড়ুন