যে জাদুঘর সংগ্রামের গল্প বলে

সামরিক জাদুঘরছবি: আব্দুল ইলা

স্কুলে একটি বাক্য আমাদের প্রায়ই পড়তে হতো। ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা বেশি কঠিন।’ কিন্তু কত কঠিন? এই প্রশ্নের উত্তর তাঁরাই সবচেয়ে ভালো জানেন, যাঁরা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকেই জীবনের একমাত্র দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছেন। এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশটিকে স্বাধীন করতে এ দেশের মানুষকে পাড়ি দিতে হয়েছে এক রক্তাক্ত এবং দীর্ঘ সংগ্রামের পথ। আর এই স্বাধীনতা রক্ষার জন্যও অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস আর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কার্যক্রম সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতেই তৈরি হয়েছে বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর। জাদুঘরটি ঢাকার বিজয় সরণিতে অবস্থিত। ২০২১ সালে চালু হওয়া এই জাদুঘরই এখন পর্যন্ত এই দেশের সবচেয়ে বড় এবং সর্বাধুনিক জাদুঘর।

জাদুঘর মানেই যেখানে জীবনে একবার গেলেই চলে। শুধু কিছু মাটি খুঁড়ে বের করা অতীতের নিদর্শন, পুরোনো মুদ্রা আর রাজা-রানিদের ভাঙাচোরা বাসনকোসন। বারবার ওখানে গিয়ে কী হবে? তোমারও কি এই কথাগুলোই মনে হয়? তাহলে সামরিক জাদুঘর তোমার এই ধারণা বদলে দেবে। এই পুরো জাদুঘরটি ভালোভাবে ঘুরে দেখার জন্য মাত্র এক দিন যাওয়া যথেষ্ট নয়। কারণ, ভেতরে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে চমকের পর চমক।

আরও পড়ুন

জাদুঘরটির বাইরের ল্যান্ডস্কেপই এত সুন্দর যে সেখানে ঘোরা আর ছবি তোলাতেই কেটে যেতে পারে বেশ খানিকটা সময়। টিকিট কেটে প্রবেশপথ দিয়ে ঢোকার পর মূল ভবনের দুই পাশেই চোখে পড়বে সবুজ ঘাস আর গাছগাছালি। একটু এগোতেই বাঁ দিকে সবুজ ঘাসের ওপর ‘অ্যাম্বুশ পজিশনে’ দাঁড়ানো কয়েকজন সৈনিক। মনে হতে পারে, এ কেমন অভ্যর্থনা? ভয়ের কিছু নেই। তারা সব লোহার তৈরি। জাদুঘরের অর্ধবৃত্তাকার ফ্রন্ট প্লাজাটি দাঁড়িয়ে রয়েছে স্বচ্ছ পানির কৃত্রিম লেকের ওপর।

এখানকার নিরাপত্তাব্যবস্থাও বেশ জোরদার। জাদুঘরে ঢোকার পথে টিকিট দেখিয়ে, মেটাল ডিটেক্টর পার হয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে। জাদুঘরটি কয়েকটি গ্যালারিতে বিভক্ত। সেনাবাহিনী গ্যালারি, নৌবাহিনী গ্যালারি, বিমানবাহিনী গ্যালারি, জাতিসংঘ শান্তি মিশন গ্যালারি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিরক্ষা গ্যালারি।

জাদুঘরগুলোতে সাধারণত প্রতিটি গ্যালারিতেই কয়েকজন গাইড থাকেন, যাঁরা দর্শনার্থীদের সবকিছু বুঝিয়ে বলেন। কিন্তু এই জাদুঘর ভিন্ন। এখানে তোমরা গার্ড দেখতে পাবে প্রচুর। কিন্তু কোনো গাইড খুঁজে পাবে না। কারণ, প্রতিটি নিদর্শনের সামনেই রয়েছে তার পরিচিতি–সংক্রান্ত সব তথ্য। কিছু কিছু নিদর্শনের সামনে ছোট ছোট টাচ স্ক্রিন রাখা আছে। যেগুলো থেকে সহজেই তোমরা বুঝতে পারবে কোনটা কী কাজে ব্যবহার করা হয়। ঢুকতেই দোতলার সেনাবাহিনী গ্যালারির কথাই ধরা যাক না। প্রাচীন একটি বুদ্ধমূর্তির পাশে ইতিহাস দর্পণ ‘শশাঙ্ক থেকে শেখ মুজিব’ নামের বিশাল এক স্ক্রিনেই তোমরা বিভিন্ন শাসনামলে বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে সব তথ্য দেখতে ও শুনতে পাবে।

বিশাল একটি স্ক্রিনে প্রদর্শিত হচ্ছে সমুদ্রপথে যুদ্ধের একটি চোখধাঁধানো অ্যানিমেশন।
ছবি: আব্দুল ইলা

এই গ্যালারিতেই প্রদর্শিত হচ্ছে পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত কামান। এর কাছাকাছিই রয়েছে একটি বিমানবিধ্বংসী কোয়াডগান, যা রাশিয়ায় (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) তৈরি। এ ছাড়া রয়েছে সপ্তদশ শতাব্দীর অটোম্যান যুদ্ধজাহাজের মডেল, একুশ শতকের বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজের মডেল এবং মিগ-২৯ যুদ্ধবিমানের মডেল। প্রাচীন ও মধ্যযুগের হাতিয়ার হিসেবে এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে ঢাল, বর্শা, রামদা ও খড়্গ। ১৭ ও ১৮ শতকের পিস্তল তরবারি, প্রাচীন তির-ধনুকও প্রদর্শিত হচ্ছে এই গ্যালারিতে। আগ্নেয়াস্ত্রের বিবর্তনও দেখা যাবে এই গ্যালারির একটি দেয়ালে। পঞ্চদশ শতাব্দীর আরকেবাস থেকে শুরু হয়ে কতগুলো পর্যায় পার হয়ে আজকের আধুনিক রাইফেল এসেছে, তা একনজরেই দেখা যাবে এখানে। পৃথিবীতে কত নামের আর ক্যালিবারের রাইফেল ও পিস্তল আছে, তা এখানে এলেই বোঝা যায়। গোলাকার প্যাটার্নে সাজানো কিছু থ্রি নট থ্রি রাইফেলও দেখা যাবে। এই পুরো গ্যালারিকে একটি ইতিহাসের বই বললেও ভুল হবে না। গ্যালারির দেয়ালে দেয়ালেই পর্যায়ক্রমে লেখা রয়েছে বাঙালির স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশি সৈনিক ল্যান্সনায়েক আব্দুল মান্নানের সাক্ষাৎকার প্রদর্শিত হচ্ছে একটি বড় স্ক্রিনে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত রিকয়েললেস রাইফেল, ৭.৯২ মিমি ভারী মেশিনগান, মর্টারসহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র সংরক্ষিত রয়েছে এখানে। আরও রয়েছে একটি জিপ অ্যাম্বুলেন্স, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করেছিলেন। জিপ অ্যাম্বুলেন্সটির পাশেই রাখা একটি লাল টেবিল। টেবিলটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লে. জেনারেল নিয়াজি এবং স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে জেনারেল এম এ জি ওসমানী ব্যবহার করছেন।

তোমরা ‘মুজিব ব্যাটারি’র নাম শুনেছ? এই ব্যাটারি কিন্তু সেই ব্যাটারি নয়। মুজিব ব্যাটারি হলো ১৯৭১ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম গোলন্দাজ ইউনিট। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দেওয়া ছয়টি ৩.৭ ইঞ্চি কামান নিয়ে এই ইউনিট গঠিত হয়েছিল। সেই মুজিব ব্যাটারি কামানগুলো এখন শোভা পাচ্ছে সামরিক জাদুঘরে।

বর্তমান সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কম্পাস, ওয়াকিটকি, বাইনোকুলার, রেডিও সেট, ফিল্ড টেলিফোন, ট্রাক্টর ল্যানডিনি ইত্যাদি প্রদর্শিত হচ্ছে সেনাবাহিনীর গ্যালারিতে।

এই গ্যালারির অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে মর্টার ও মেশিনগান ভি আর। এই ভি আর শোর টিকিটের মূল্য ১০০ টাকা।

বর্তমান সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কম্পাস, ওয়াকিটকি, বাইনোকুলার, রেডিও সেট, ফিল্ড টেলিফোন, ট্রাক্টর ল্যানডিনি ইত্যাদি প্রদর্শিত হচ্ছে সেনাবাহিনীর গ্যালারিতে।
ছবি: আব্দুল ইলা

সেনাবাহিনী গ্যালারির ভেতর দিয়েই তোশাখানা জাদুঘরের প্রবেশপথ। এই জাদুঘরে রাষ্ট্রীয় উপহারসামগ্রী সংরক্ষিত আছে। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া উপহারগুলো সত্যিই চোখধাঁধানো। হয়তোবা এই কারণেই উপহারগুলোর ছবি তোলা নিষেধ। চাঁদের পাথরের টুকরা, হাতির দাঁতের তৈরি শোপিস, স্বর্ণের তৈরি ঘোড়া, বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, তৈজসপত্রসহ আকর্ষণীয় অনেক উপহারসামগ্রী রয়েছে এখানে। স্পাইরাল সিঁড়ি আর সিঁড়ির মাঝখানে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ মূর্তি এই জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ।

সামরিক জাদুঘরের দ্বিতীয় তলা এবং ভূগর্ভস্থ প্রথম তলায় রয়েছে নৌবাহিনী গ্যালারি। এই গ্যালারিটিই দর্শনার্থীদের কাছে জাদুঘরটির মূল আকর্ষণ। নৌবাহিনী গ্যালারিতে ঢুকতেই ডান দিকে বড় বড় তিনটি স্ক্রিনে চোখে পড়বে প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ পার হয়ে আধুনিক নৌশক্তির বিবর্তনের গল্প। আরেকটু এগোলে চোখে পড়বে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের ছবি। পাশেই প্রদর্শিত হচ্ছে এই মহান বীরের আত্মত্যাগের ওপর নির্মিত শর্টফিল্ম। ‘আমাদের ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনী’ নামের ডিসপ্লেটিও চমৎকার। এ ছাড়া গ্যালারির এই অংশে রয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের নৌকার সুন্দর সুন্দর মডেল। প্রাচীন যুদ্ধজাহাজের বিভিন্ন মডেলও দেখা যাবে এখানে।

এই গ্যালারির ‘Guts and Glory’ নামক অংশটি তৈরি করা হয়েছে একটি জাহাজের আদলে। সামনে বিশাল একটি স্ক্রিনে প্রদর্শিত হচ্ছে সমুদ্রপথে যুদ্ধের একটি চোখধাঁধানো অ্যানিমেশন। জাহাজের আদলে তৈরি মেঝেতে দাঁড়িয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকালে মনে হবে, তুমি সত্যিই কোনো চলন্ত জাহাজে দাঁড়িয়ে আছ। যুদ্ধ দেখছ।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের ইতিহাস এই গ্যালারিতেই দেখা যাবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ‘অপারেশন জ্যাকপট’–এর গৌরবান্বিত ইতিহাসও জানা যাবে এখান থেকেই। শহীদ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের ছবি এবং তাঁর ব্যবহৃত কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও এই গ্যালারিতে সংরক্ষিত আছে।

সারা গ্যালারিতেই সাজানো রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অসংখ্য যুদ্ধজাহাজের মডেল। এ ছাড়া রয়েছে নৌ যোগাযোগব্যবস্থায় ব্যবহৃত মেরিটাইম পালস, এইচএফ কমিউনিকেশন সেট ইত্যাদি।

সামরিক জাদুঘর
ছবি: আব্দুল ইলা

এখানেই চমকের শেষ নয়, এই গ্যালারির আসল চমক শুরু হয় ভূগর্ভস্থ প্রথম তলায় গেলে। এখানে এলে প্রথমে একটু অবাক হতে পারো। মনে হতে পারে এটা বাংলাদেশ নয়, সিঙ্গাপুরের কোনো হাইটেক জাদুঘর। এখানে তৈরি করা হয়েছে ‘অতলান্তিকের গভীরে’ নামক একটি ভার্চ্যুয়াল সাগরতলের জগৎ। মনে হবে, তুমি স্কুবা ডাইভিং করতে বেরিয়েছ। যেখানে তোমার চারপাশ দিয়ে সাঁতার কাটছে হাঙর, তিমি, জেলিফিশসহ নাম না জানা অসংখ্য রঙিন মাছ। পাশেই দেখতে পাবে একটি সাবমেরিনের মডেল। বাস্তবে একটি সাবমেরিন কেমন হয়, তার ধারণা পাওয়া যাবে এই মডেল সাবমেরিনের ভেতরে ঢুকলে। চালকের আসনে বসা ক্যাপ্টেনকে দেখলে একটু অবাক হতে পারো। তবে একবার ভালোভাবে তাকালেই বুঝবে, সে আসলে কোনো মানুষ নয়, পুতুল! সাবমেরিনের ভেতর বেডস্পেস, কিচেন, মিটিং রুম, ডাইনিং রুম এগুলো কেমন হয়, সবই দেখতে পাবে এই সাবমেরিনে। একটা টয়লেটও আছে। তবে ভুলেও সেখানে বসতে যেয়ো না কিন্তু!

সাবমেরিন থেকে বের হলেই ‘মজার জগৎ’। এটিও একটি ভার্চ্যুয়াল আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ড। এটি বিশেষভাবে শিশুদের আনন্দ দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে। বাচ্চারা এখানে এসে আনন্দে হুটোপুটি খায়। মেঝেতে সাঁতরে চলা মাছ আর কচ্ছপগুলোকে হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু মাছগুলো কীভাবে ধরা পড়বে? কিছুই তো সত্যি নয়!

ভূগর্ভস্থ এই গ্যালারির একটি কক্ষে রয়েছে শিপ সিমুলেটর। জাহাজের ক্যাপ্টেনকে কীভাবে কাজ করতে হয়, তার একটি ধারণা এখান থেকে পাওয়া যাবে।

নৌবাহিনীর গ্যালারিতে আরও আছে ভার্চ্যুয়াল অ্যাকুয়ারিয়াম, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হেলিকপ্টারের মডেলসহ আরও অসংখ্য চোখধাঁধানো নিদর্শন।

আরও পড়ুন

জাদুঘরের তৃতীয় তলায় রয়েছে বিমানবাহিনী গ্যালারি।

এখানে রয়েছে মিগ-২৯, এফ ৭বিজিসহ আরও অনেক যুদ্ধবিমানের মডেল। সাদা আর লাল রঙের মিশেলে রাঙানো এয়ারট্যুরার বিমানের বিশাল মডেলটিও চোখে পড়ার মতো। আরও রয়েছে এমআই-১৭ হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন, এফটি-৬ যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন, পিটি-৬ বিমানের ইঞ্জিন, হেলিকপ্টার রোটর হাব ইত্যাদি। আরও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মিসাইলের রেপ্লিকা।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বিমানবাহিনী কর্মকর্তাদের ছবিসহ তালিকাও দেখা যাবে এই গ্যালারির স্ক্রিনগুলোতে। ছবি, মানচিত্র আর মডেলসহ জানা যাবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম আকাশপথের অপারেশন ‘কিলো ফ্লাইট’ সম্পর্কে খুঁটিনাটি সবকিছু।

পাহাড়ে কর্মরত একজন সৈনিকের জীবন কেমন হয়? সেই ধারণা দিতেই ছোট্ট একটি জুমঘর তৈরি করে রাখা হয়েছে ‘পাহাড়ের না বলা গল্প’ কর্নারে। ভেতরে খাট, টর্চলাইট, ওয়্যারলেসসহ সৈনিকদের ব্যবহারের প্রয়োজনীয় আরও কিছু জিনিসপত্র। খাটের ওপর ভাঁজ করে রাখা ইউনিফর্ম। সত্যিই যেন ওটা কোনো সৈনিকের বাসস্থান!

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে একটি নাম। বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান। স্বাধীন বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর আত্মত্যাগের ওপর নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে এই গ্যালারিতে। পাশেই একটি ব্যানারে রয়েছে তাঁর কর্মজীবনের বেশ কিছু ছবিসহ মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের গল্প।

বিমানবাহিনী গ্যালারি থেকে বের হওয়ার পথে দুটি মজার জিনিস দেখা যাবে। দুজন যুদ্ধবিমানচালকের ইউনিফর্ম পরা মডেল। একটি বড়, একটি ছোট। হাত-পা সবই আছে। শুধু মাথার জায়গাগুলো ফাঁকা। এই মডেলগুলোর পেছনে দাঁড়িয়ে, ফাঁকা জায়গায় মাথা রেখে যোদ্ধা সেজে ছবি তোলে ছোট–বড় অনেকেই।

আরও পড়ুন

জাদুঘরের চতুর্থ তলায় রয়েছে জাতিসংঘ শান্তি মিশন গ্যালারি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিরক্ষা গ্যালারি।

বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী শুধু দেশেই নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও নিজেদের দায়িত্ব পালন করে চলেছে। এই গ্যালারিতে ঢোকার পর ডান দিকের দেয়ালে তাকালে একনজরেই দেখা যাবে বাংলাদেশ নৌবাহিনী দেশের বাইরে কয়টি দেশে, কী কী মিশন সম্পন্ন করেছে। বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পালনের সময়ও জানা যাবে ভেতরের আরেকটি দেয়াল থেকে। বিদেশের মাটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যুদ্ধে প্রাণ হারানো বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের ছবিসহ নামও চোখে পড়বে এই গ্যালারিতে।

আরও দেখতে পাবে বিভিন্ন দেশে দায়িত্বরত অবস্থায় তোলা অসংখ্য ছবি। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা সুদানে কর্মরত অবস্থায় এক ছোট্ট শিশুকে পানি পান করাচ্ছেন। সত্যিই মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো একটি ছবি।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালনকালে সামরিক বাহিনীর পাওয়া বেশ কিছু পদকও প্রদর্শিত হচ্ছে গ্যালারির এই অংশে।

আরেকটু এগোলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিরক্ষা গ্যালারি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আদ্যোপান্ত জানা যাবে এই গ্যালারি থেকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত সাবমেশিনগান, শান্তি বাহিনী কর্তৃক সমর্পণ করা রাইফেলসহ আরও কিছু অস্ত্র এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে।

পাহাড়ে কর্মরত একজন সৈনিকের জীবন কেমন হয়? সেই ধারণা দিতেই ছোট্ট একটি জুমঘর তৈরি করে রাখা হয়েছে ‘পাহাড়ের না বলা গল্প’ কর্নারে। ভেতরে খাট, টর্চলাইট, ওয়্যারলেসসহ সৈনিকদের ব্যবহারের প্রয়োজনীয় আরও কিছু জিনিসপত্র। খাটের ওপর ভাঁজ করে রাখা ইউনিফর্ম। সত্যিই যেন ওটা কোনো সৈনিকের বাসস্থান!

‘চাঁদের গাড়ি’ ও ‘প্যারাগ্লাইডিং’ নামে দুটি ভিআর শো দেখার ব্যবস্থা রয়েছে এই গ্যালারিতে। শো দেখার জন্য আলাদা টিকিট সংগ্রহ করতে হবে।

সব কটি গ্যালারি দেখা হয়ে গেলে জাদুঘর থেকে বের হওয়ার জন্য আবারও সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে হবে সেনাবাহিনী গ্যালারিতে। এত সুন্দর জাদুঘরে কত দ্রুত সময় কেটে যায়, বোঝাই যায় না। একবার ঘুরে দেখলেও মনে হয় যেন অনেক কিছুই দেখা হয়নি। কিন্তু বাড়িতে তো ফিরতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বাড়ি ছেড়েছিলেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু সবাই বাড়ি ফিরতে পারেননি। বাড়ি ফিরতে ফিরতে হয়তোবা তাঁদের কথা ভেবে তোমার চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়বে দুই ফোঁটা অশ্রু।

আরও পড়ুন