আলু এল কোথা থেকে
ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিপস অথবা ভর্তা খেতে প্রয়োজন আলু। মুরগি হোক কিংবা মাছ, তরকারির জন্য আলুই যথেষ্ট। কিন্তু এই মজার সবজিটি আমরা কীভাবে পেলাম? বিজ্ঞানীরা এতদিন এর রহস্য পুরোপুরি সমাধান করতে পারেননি। তবে সম্প্রতি একদল বিজ্ঞানী আলুর জন্মরহস্য ভেদ করেছে। তাঁরা যা জানতে পেরেছেন, তা শুনলে তুমি অবাক হবে। আমাদের প্রিয় এই আলু নাকি টমেটোর বংশধর! একটি প্রাচীন টমেটো গাছের সঙ্গে অন্য একটি বুনো গাছের সংকরায়নের ফলেই জন্মেছে আলু গাছ।
ঘটনাটি প্রায় ৯০ লাখ বছর আগের। তখন দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালা তৈরি হচ্ছিল। সেই সময় প্রকৃতিতে অদ্ভুত একটি ঘটনা ঘটে। একটি প্রাচীন টমেটো গাছের সঙ্গে এক ধরনের বুনো গাছের মিলন হয়। গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Solanum etuberosum। এটি দেখতে আলুগাছের মতো হলেও এতে কোনো আলু ধরত না।
এই দুই ভিন্ন গাছের সংকরায়নের ফলেই এক নতুন উদ্ভিদের জন্ম হয়। সেই গাছের কাণ্ডের নিচেই মাটির ভেতরে প্রথম আলু তৈরি হতে শুরু করে। এই গবেষণার ফল সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সেল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
আমরা যে আলু খাই তার বৈজ্ঞানিক নাম সোলানাম টিউবেরোসাম (Solanum tuberosum)। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাবারগুলোর একটা। বিজ্ঞানীরা জানতেন এর সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকার সোলানাম ইটিউবেরোসাম নামে একটা গাছের সম্পর্ক আছে। দেখতে এই গাছ আমাদের আলু গাছের মতোই। শুধু একটাই পার্থক্য, এটা টিউবার তৈরি করতে পারে না। মানে যেই অংশ থেকে আমরা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বা চিপস বানাই, সেটা এই গাছে হয় না।
জিন গবেষণা থেকে জানা গেছে, আলুর সঙ্গে টমেটোর সম্পর্ক আছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা ভাবতেন এরা দূরের আত্মীয়। কিন্তু এখন গবেষণা দেখাচ্ছে, এই দুই প্রজাতির গাছ নিজেদের মধ্যে সংকরায়িত হয়েছিল। গবেষকেরা কয়েক ডজন বুনো আর চাষ করা আলুর জাত পরীক্ষা করে দেখলেন। প্রতিটা আলু প্রজাতির প্রায় অর্ধেক জিন এসেছে টমেটো থেকে। বাকি অর্ধেক এসেছে সোলানাম ইটিউবেরোসাম থেকে। মানে, আলু এই দুই দলের একটা মাত্র সংকরায়ন থেকে এসেছে।
যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের উদ্ভিদবিজ্ঞানী স্যান্ড্রা ন্যাপ বলেন, ‘এই সংকরায়নের ফলে দুটি জিন একসঙ্গে হয়। এর ফলেই টিউবার তৈরি হওয়া সম্ভব হয়েছে।’
একটা জিন এসেছে টমেটোর দিক থেকে। এর নাম এসপি৬এ। আগের গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, এটা টিউবার তৈরির মাস্টার সুইচের মতো কাজ করে। আরেকটা জিন আছে আইটি১। এটা মাটির নিচের কাণ্ড বাড়াতে সাহায্য করে। এই কাণ্ড থেকেই টিউবার তৈরি হয়। এই জিন এসেছে সোলানাম ইটিউবেরোসাম থেকে।
আলু গাছে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, আইটি১ জিন না থাকলে টিউবার হয় খুবই ছোট। এসপি৬এ জিন না থাকলে টিউবার একদমই তৈরি হয় না। তবে একটা গাছে এই জিনগুলো মিলে কীভাবে আলু তৈরি করল, সেটা এই গবেষণাপত্রে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা হয়নি।
বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ১৮০ প্রজাতির বুনো আলু পাওয়া যায়। এগুলোর বেশিরভাগই তেতো ও বিষাক্ত। কিন্তু হাজার হাজার বছর আগে আন্দিজ অঞ্চলের আদিবাসীরা একটি সুস্বাদু বুনো আলুর সন্ধান পেয়েছিল। তারা সেটি চাষ শুরু করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা আরও নানা জাত তৈরি করে। পরে স্পেনের অভিযাত্রীরা সেই আলু নিয়ে যায় ইউরোপে। সেখান থেকেই এটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু একটি চিন্তার বিষয়ও আছে। আমরা এখন যেসব আলু চাষ করি, সেগুলোর মধ্যে জিনগত বৈচিত্র্য অনেক কম। তাই বন্যা বা অতিরিক্ত গরমে এগুলোর ফসল সহজেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
তবে আশার কথা হলো, বিজ্ঞানীরা এখন আলুর জন্মরহস্য জানেন। তাঁরা হয়তো ভবিষ্যতে টমেটো বা অন্য বুনো গাছের জিন ব্যবহার করবেন। এর মাধ্যমে আরও শক্তিশালী নতুন জাতের আলু তৈরি করা সম্ভব হবে। আর এটিই হয়তো আমাদের ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
সূত্র: সায়েন্স নিউজ এক্সপ্লোর