স্ক্রল করে করে ব্রেন রট ঘটেছে কি না, কীভাবে বুঝব

সম্ভাবনা আছে, এখন তুমি বা তোমার পাশের কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ক্রল করছে। একের পর এক ভিডিও আসছে। তোমার মুখে হাসি ফুটে উঠছে বা তুমি স্ক্রল করে পরের ভিডিওতে চলে যাচ্ছ। আসো, একটা পরীক্ষা করি। স্ক্রল করা এক মিনিটের জন্য থামাও। থামিয়ে এবার ভাবো, এখন যে ভিডিওতে তুমি আছ, তার আগেরটার আগের ভিডিওতে তুমি কী দেখেছ? মনে করতে না পারলে বুঝবে, তোমার ব্রেন রটের লক্ষণ দেখা গেছে। চেষ্টা করলে হয়তো তুমি মনে করতে পারবে কী দেখেছ। কিন্তু আরও এক বা দুই ধাপ পেছনে গেলে, মানে তার আগের দুটো ভিডিওর কথা তোমার মনে থাকার কথা নয়। তোমার ফটোগ্রাফিক মেমোরি নেই বলে ধরে নিচ্ছি।

এভাবেই ইন্টারনেটের আসক্তি আমাদের চেপে ধরেছে। আমাদের জীবন কঠিন করে তুলেছে। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকে নতুন নতুন ট্রেন্ড এলেই আমরা জেনে যাচ্ছি। এসবের ভিড়ে আমরা ‘ব্রেন রট’ নামের নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে পড়েছি।

আরও পড়ুন

ব্রেন রট কী

তুমি যদি জেনারেশন জি হও, তবে ধরে নেওয়া যায় যে ‘ব্রেন রট’ শব্দটির সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে। তাও তোমাকে একটু মনে করিয়ে দেই। ব্রেন রট হলো এমন এক অবস্থা, যখন সারাক্ষণ অনলাইনে থাকার কারণে আমাদের জীবনযাত্রায় এর প্রভাব পড়তে শুরু করে। যেমন বাস্তব জীবনে যখন আমরা ইন্টারনেট স্ল্যাং বা ভাইরাল বাক্যগুলো বলা শুরু করি। যেমন (উদাহরণ দিচ্ছি) তুমি একটি লিফটের অতি ধীরগতির দরজা দেখে বলে উঠলে, ‘টেকনোলজিয়া’। এমন কথা বলতে শুরু করলে বুঝতে হবে তোমার সমস্যাটি শুরু হয়েছে। এককথায় এটি এমন এক সংস্কৃতি, যেখানে অনলাইন জগৎ আর বাস্তব জীবনের পার্থক্য মুছে যায়।

আমরা এত বেশি সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি, এত এলোমেলো, অপ্রয়োজনীয় তথ্য আমাদের মস্তিষ্ক গ্রহণ করে, এটা থেকে আমরা বলি যে আমাদের মস্তিষ্কে পচন ধরছে বা ব্রেন রট ঘটছে।

ব্রেন রটের মূল লক্ষণ হলো, যখন তোমার অনলাইনে কাটানো সময় প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করে। স্বাস্থ্য মনোবিজ্ঞানী ড. জুলিয়া কোগানের মতে, যদি তুমি ফোন থেকে চোখ সরাতে না পারার কারণে ঘুমাতে না পারো বা বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলো এড়িয়ে ফেসবুক বা টিকটক নিয়ে ব্যস্ত থাকো, তবে তুমি ব্রেন রটে ভুগতে পারো।

ব্রেন রটের আরও লক্ষণ হতে পারে, ফোন থেকে দূরে থাকতে না পারা এবং সারাক্ষণ নোটিফিকেশন দেখার তাড়া অনুভব করা। অতিরিক্ত ফোন ব্যবহারের কারণে চোখের ওপর চাপ পড়া, মাথাব্যথা বা দুর্বলতা অনুভব করাও এর লক্ষণ।

আরও পড়ুন

কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে

সামনাসামনি দেখা হলে আমাদের অস্বস্তি দূর হয়, অন্যের প্রতি সংবেদনশীলতার অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়
এআই দিয়ে তৈরি

আমরা সবাই কমবেশি ব্রেন রটে ভুগি। আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অনেকটা অংশ ফোনের মধ্যে চলে। ফোন এড়িয়ে চলা এখন আমাদের জন্য কঠিন। তবে কিছু মানুষ অন্যদের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোভিড মহামারির পর থেকে শিশু-কিশোরেরাই এর সবচেয়ে বড় শিকার।

২০২৩ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারির আগে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের গড় স্ক্রিন টাইম ছিল ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ, যা পরে বেড়ে ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে ৮ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুরা প্রতিদিন ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা এবং কিশোর-কিশোরীরা ৯ ঘণ্টা পর্যন্ত অনলাইনে সময় কাটায়। তুমি হিসাব করে দেখতে পারো, তোমার স্ক্রিন টাইম কত।

আরও পড়ুন

কী প্রভাব পড়ছে

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর বয়সীরা সারাক্ষণ অনলাইনে থাকলে তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিকাশের পথ বন্ধ হয়ে যায়। বয়ঃসন্ধিকালে মানুষ সমবয়সীদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে সামাজিক ও আবেগীয় দক্ষতা অর্জন করে। ভালো লাগা বা নতুন বন্ধুত্ব তৈরি হয়। এটি বিকাশপ্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে। সামনাসামনি দেখা হলে আমাদের অস্বস্তি দূর হয়, অন্যের প্রতি সংবেদনশীলতার অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়।

কিশোর-কিশোরীরা এই মূল্যবান বছরগুলো স্ক্রিনের পেছনে ব্যয় করে। এর ফলে বন্ধু তৈরি করা, ঝগড়া মেটানো, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা, আত্মবিশ্বাসী হওয়ার মতো অভিজ্ঞতা থেকে তারা বঞ্চিত হয়।

সামনাসামনি যোগাযোগের পরিবর্তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার তাই একাকিত্ব বাড়ায়। এভাবে বিষণ্নতার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। অতিরিক্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ফলে নিজেকে যোগ্য বা ‘যথেষ্ট ভালো নয়’ মনে হতে পারে। সবার রঙিন জীবন, সেরা সময়গুলো অনলাইনে দেখে দেখে আত্মমর্যাদার ওপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।

আরও পড়ুন

ব্রেন রট কমানোর উপায় কী

ব্রেন রট কোনো স্থায়ী রোগ নয়। এটি কমানোর বেশ কিছু উপায় আছে। যেমন ১৬ বছর বা তার বেশি বয়সের আগে শিশুদের হাতে স্মার্টফোন না দেওয়া। সামাজিক মনোবিজ্ঞানী ড. জোনাথন হেইড বলেন, কিশোরেরা যত কম ডিভাইস পাবে, তাদের ডিজিটাল আসক্তিতে ভোগার আশঙ্কা তত কম হবে।

যদি শিশু-কিশোরদের হাতে স্মার্টফোন এরই মধ্যে চলে যায়, তবে তাদের স্ক্রিন টাইমের সীমা নির্ধারণ করা উচিত। মা–বাবার উচিত স্ক্রিন ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা তৈরি করা যেন পড়াশোনা, খাবারের সময় বা ঘুমের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্ক্রিন টাইম বাধা না হয়ে দাঁড়ায়।

মা–বাবারা নিজেরাই উদাহরণ তৈরি করতে পারেন। নিজেরা যদি বাসায় কম ডিজিটাল ডিভাইসে মগ্ন থাকেন, তবে শিশুরা তাঁদের অনুসরণ করতে পারে। আর অনলাইন সময় কাটানোর বদলে অফলাইনে অ্যাকটিভিটি করাও ব্রেন রট দূর করতে ভালো কাজ করে।

তুমি যদি এরই মধ্যে ব্রেন রটে আক্রান্ত হয়ে যাও, তবে এখন তো জানোই যে কীভাবে ব্রেন রট দূর করা যায়। মনে রাখবে, ব্রেন রট কোনো রোগ নয়, কিছু লক্ষণ। লক্ষণ দূর করা নিশ্চয়ই অসম্ভব কিছু নয়।

সূত্র: ভেরি ওয়েল মাইন্ড

আরও পড়ুন