পুরোনো টাওয়ার (তৃতীয় পর্ব)

অলংকরণ: আরাফাত করিম

পাঁচ

‘আরে, আরে!’ চেঁচিয়ে উঠল ফ্রেড। ‘এই সব ছুরিটুরি আবার কেন! এই জায়গার মালিক তার গাড়ি নষ্ট হলে মোটেও খুশি হবে না!’

মুখ তুলে লোকটার দিকে তাকাল কিশোর। ‘আমার চাচাকে বহুবার দেখেছি এভাবে চেঁছে রং ওঠাতে। ওঠানোর পর আপনি বুঝতেই পারবেন না কোথায় দাগ।’

ঘোঁতঘোঁত করল ফ্রেড। ‘তুমি তো আর তোমার চাচা নও। দেখো, সাবধানে তোলো!’

যতটা সম্ভব সাবধানে, জায়গাটা থেকে এমনভাবে লাল রঙের চলটা তুলল কিশোর যে ধরার কোনো উপায় রইল না। পকেট থেকে টর্চ বের করে আলো ফেলল ওখানে।

কিশোরের ঘাড়ের ওপর দিয়ে উঁকি দিল রবিন, বলল, ‘লালের নিচে দেখি হালকা নীল রং। হলুদ তো না!’

‘ঠিকই।’ সায় দিল কিশোর। তীব্র চোখে তাকাল ফ্রেডের দিকে।

লাল হয়ে গেল স্বঘোষিত ডিটেকটিভের মুখ। ‘তোমরা বলতে চাইছ, মুসার জেলোপি নয় এটা?’ গলা বাড়িয়ে বলল সে। ‘কিন্তু আমি বলছি এটাই মুসার গাড়ি। আর আমার কথাই ঠিক!’

‘আরে না, আমরা তো বলিনি আপনি ভুল বলেছেন।’ তাড়াতাড়ি বলল রবিন। মনের কোণে একটু আশা, এটাই হয়তো মুসার গাড়ি। যদিও যুক্তি বলছে অন্য কথা।

‘আচ্ছা, অন্য পাশটায় দেখি তো।’ সোজা হয়ে দাঁড়াল কিশোর। ঘুরে ওপাশের ফেন্ডারটার কাছে চলে এল।

এপাশেও একই অবস্থা। দেখা যাচ্ছে, লালের আগে সত্যি সত্যি হালকা নীল রং ছিল গাড়িটার।

‘হুঁ, চোরটা মনে হয় আগে নীল রং করেছে, তারপর তার ওপরে করেছে লাল রং।’ মানতে রাজি নয় ফ্রেড।

মুখের ওপর হাসল রবিন। ‘বেশ, আরেকটু গভীর করে চাঁছা যাক। জায়গার মালিক কিছু বললে ফেন্ডার রং করার দাম দিয়ে দেব আমরা।’

কিন্তু কয়েক পরত রং তোলার পরও হলুদের কোনো চিহ্ন দেখতে পেল না কিশোর।

এতক্ষণ ধরে গাড়ির চারপাশে শুধু ঘুরে ঘুরে দেখছিল মুসা, ভেতরে বা বাইরে কোনো পরিচিত চিহ্ন চোখে পড়ে কি না। এটা যে ওর হারানো জেলোপিটা নয়, কিশোর তা নিশ্চিত করার আগেই ও নিজে সেটা বুঝে গেছে।

‘ইয়েলো বেবির পেছনে, ডান দিকের ফেন্ডারে একটা লম্বা, পাতলা তোবড়ানো দাগ ছিল।’ বলল মুসা। ‘আর দরজার পাশের ওই সিটেও সামান্য একটু চেরা ছিল। ওগুলো তো ঠিক করার কথা নয় চোরের।’

খানিকটা হতাশ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কিশোর আর রবিন যে ওকে সত্যি উদ্‌ঘাটনে সাহায্য করেছে, তাতে খুশিও হয়েছে। তবে এত সহজে টাকার দাবি ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয় ফ্রেড।

‘কিছুই প্রমাণ করতে পারোনি তোমরা।’ বলল সে। ‘এ জায়গার মালিক স্বীকার করেছে যে গাড়িটা চোরাইও হতে পারে। যার কাছ থেকে কিনেছিল এটা, সেই লোক নাকি জানিয়েছিল সে রকি বিচের বাইরে একটা ফার্মে থাকে।’

কথাটা শুনে মুহূর্তের জন্য থমকে গেল ছেলেরা। কিন্তু এক মুহূর্ত পর বলল কিশোর, ‘চল তো গিয়ে মালিকের সঙ্গে কথা বলে দেখি। যে লোক গাড়িটা এনেছিল, তার সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানাতে পারে সে।’

যথেষ্ট সহযোগিতা করল পুরোনো গাড়ির ইয়ার্ডের মালিক। যতগুলো প্রশ্ন করল কিশোর, তার সবগুলোরই জবাব দিল। বিক্রির রসিদ থেকে জানা গেল, লাল জেলোপির আগের মালিকের নাম টল ওয়ার্নার, রকি বিচে বাড়ি।

‘আরে, একে তো আমরা চিনি!’ বলল কিশোর। ‘রকি বিচ হাইস্কুলে পড়ত। পরিবারসহ চলে গেছে এখান থেকে। মনে হয়, সে কারণেই গাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে গেছে।’

‘কিন্তু মি. ফ্রেড বললেন যে আপনার নাকি সন্দেহ, এটা চোরাই গাড়ি।’ ফস করে বলে বসল রবিন।

মুচকি হাসলেন পুরোনো গাড়ি ব্যবসায়ী। ‘বলতে বাধ্য হচ্ছি, ধারণাটা মি. ফ্রেডই আমার মাথায় ঢুকিয়েছে। আমি শুধু এটুকু বলেছিলাম, লোকটা বেশ তাড়াহুড়া করে অনেক সস্তায় গাড়িটা বেচে গেছে। এসব ক্ষেত্রে আমরা ব্যবসায়ীরা একটু ভয়ই পাই, পাছে চোরাই গাড়ি কিনে ভেজালে পড়ি। কিন্তু এই টল ওয়ারনারকে দেখে খারাপ লোক মনে হয়নি, তাই তার জেলোপিটা কিনে রাখি।’

কিশোর তাকে আশ্বস্ত করল, আসলেও সব ঠিকঠাক আছে। তারপর যখন ব্যবসায়ীর মুখে টল ওয়ার্নারের চেহারার বর্ণনা শুনল, তখন তো আর কোনো সন্দেহই রইল না গাড়িটা তারই।

একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থা তখন ফ্রেডের। একটা কথাও না বাড়িয়ে সোজা নিজের গাড়ির দিকে হাঁটা দিল সে। ছেলেরা গেল পেছন পেছন। মুসাদের ফার্মে ফেরার পথেও টুঁ–শব্দ করল না ফ্রেড। লোকটার জন্য খারাপই লাগছে ছেলেদের। তাই নিজেদের ভেতর অন্য হাজারটা প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করলেও গাড়ির বিষয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করল না আর।

মুসার ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল মেয়ে দুটো। ‘পেয়েছ, গাড়ি?’ ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চাইল ফারিহা।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মুসা। ‘আরেকবার বোকা বানাল ফ্রেড।’ বিরক্তি ফুটল ওর গলায়। ডিটেকটিভকে দেওয়ার জন্য বন্ধুরা যে টাকা দিয়েছিল ওকে, তা ফেরত দিল সবাইকে।

কিশোর আর রবিন ‘গুডবাই’ জানিয়ে মোটরসাইকেলে উঠল। ট্রেসিকে ওর বাসায় নামিয়ে দিয়ে, ফিরে এল নিজেদের বাড়িতে। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ল রাতের মতো।

পরদিন স্কুল ছুটি হতেই ধূসর উইগটা নিয়ে হারবিজের দোকানে গেল ওরা। মালিক নিশ্চিত করল, ওর দোকানের উইগ নয় ওটা।

‘একেবারে সস্তা পরচুলা।’ বলল লোকটা।

কোয়ালিন আর ব্রুম্যানদের দোকানেও খোঁজ নিল গোয়েন্দারা। দুটো দোকানের একটাও এই ধূসর উইগ বেচেনি। তা ছাড়া ওদের কারও কাছেই গত কয়েক মাসের ভেতর কোনো লাল পরচুলা কিনতে আসেনি কেউ। বিভিন্ন রঙের নকল চুল পরার অভ্যাস আছে, এমন কোনো কাস্টমারও নেই ওদের।

‘আজকের গোয়েন্দাগিরিটা একেবারে মাঠে মারা গেল, আঙ্কেল।’ রাতে মি. পাশাকে জানাল রবিন।

মুচকি হাসলেন ডাকসাইটে গোয়েন্দা। ‘তাতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। শোনো, এক শটা ব্যর্থ অভিযানের পর আসে হয়তো একটা সাফল্য।

বিছানায় যাওয়ার জন্য কাপড় ছাড়ছে ওরা, এই সময় কিশোর রবিনকে মনে করিয়ে দিল আগামী দিন স্কুলের সাপ্তাহিক বন্ধ। ‘কাল দিনভর কেসটা নিয়ে কাজ করতে পারব।’ উৎসাহ নিয়ে বলল সে।

‘কাজটা কি করব আমরা?’ জানতে চাইল রবিন।

কাঁধ ঝাঁকাল কিশোর। বেশ কয়েকটা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করল দুজন। শেষ অবধি রবিনের একটা আইডিয়া পছন্দ হলো ওদের। কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নেবে ওরা। ওদের ধারণা, পুলিশের ভয়ে গাড়ি নিয়ে খুব বেশি দূর যেতে পারেনি চোরটা। কাজেই আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা চষে ফেলবে ওরা জেলোপির সন্ধানে।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘গাড়ি লুকানোর মতো সম্ভাব্য সব জায়গায় অভিযান চালাব আমরা।’ বলল রবিন।

পরদিন খুব সকালে ফোন নিয়ে বসে গেল কিশোর। একটার পর একটা কল করতে লাগল ‘বাহিনী’র কাছে। মুসা ছাড়াও তার ভেতর থাকল টমাস মার্টিন ওরফে টম, বক্সিং ভালোবাসে। বাহিনীর অন্য সদস্যদের ভেতর রয়েছে জিল জেসন, জিরেমি গুডম্যান আর বিড ওয়াকার। সবাই ওরা রকি বিচ হাইস্কুলের ছাত্র, খেলাধুলাসহ কোনো না কোনো কাজে পারদর্শী।

পাঁচ বন্ধুই সাগ্রহে রাজি হলো তদন্তে সাহায্য করতে। সবাই নয়টার সময় কিশোরদের বাসায় মিলিত হবে, ঠিক হলো। কিশোর আর রবিন তখন কর্মপন্থা ব্যাখ্যা করবে ওদের কাছে।

নাশতার পরপরই কিশোরের চাচার কাছে নিজেদের পরিকল্পনার কথা খুলে বলল কিশোর আর রবিন। অনুসন্ধানের ব্যাপারে তাঁর কোনো পরামর্শ আছে কি না, জানতে চাইল।

‘একটা ম্যাপ নাও।’ বললেন তিনি, ‘আমাদের শহরটাকে কেন্দ্র করে ভাগ ভাগ হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ো সবাই। দুজন দুজন করে যাবে একেক ভাগে।’

সকাল নয়টার ভেতর ছেলেরা অনুসন্ধানের এলাকা চিহ্নিত করে ফেলল ম্যাপে। প্রথম স্বেচ্ছাকর্মী হিসেবে উপস্থিত হলো টনি প্রিটো। হাসিখুশি, প্রাণবন্ত ছেলে। তার পরপরই ঢুকল শান্তশিষ্ট, বুদ্ধিমান ছেলে জিরেমি গুডম্যান।

‘বলো, কী করতে হবে।’ জানতে চাইল বিড। ‘আজকে বাবার বাইরে যাওয়া নেই, তাই তার ট্রাকটা নিয়ে এসেছি আমি।’ ঠিকাদারি ব্যবসা করেন বিডের বাবা। ‘বেশ কয়েক মাইল কাভার করা যাবে ওটা দিয়ে।’

কিশোরের পরামর্শে জোট বাঁধল বিড আর জিরেমি। ম্যাপটা বুঝে নিল কিশোরের কাছ থেকে। রকি বিচকে কেন্দ্র করে মস্ত একটা বৃত্ত আঁকা হয়েছে ওটায়, সমান চার ভাগে ভাগ করা। ঘড়িতে যে নম্বর থাকে, সেভাবে নম্বর দেওয়া হয়েছে বৃত্তটাতে।

‘এই যে, এই ডায়ালের নয়টা থেকে বারোটার ঘরের এই অংশটা কাভার করতে পারো তোমরা।’ ম্যাপ দেখিয়ে বিড আর জিরেমিকে বলল কিশোর। ‘চাচি আমাদের সাহায্য করতে রাজি হয়েছে। প্রতি ঘণ্টায় একবার করে ফোন করে, রিপোর্ট করতে হবে তাকে। সবার রিপোর্ট টুকে রাখবে সে।’

‘ঠিক আছে, ঘণ্টায় ঘণ্টায় জানাব তাঁকে।’ কথা দিল বিড। ‘চলো, জিরেমি, কাজে নেমে পড়ি!’

ওরা দুজন রওনা দিতে না দিতেই মোটরসাইকেল নিয়ে হাজির হলো টম আর জিল। সোনালি চুল টমের, লম্বা লম্বা পা, ঘোড়ার মতো ছুটতে পারে সে। অল্প সময়ের ভেতর বিস্তীর্ণ এলাকা চষে ফেলতে পারে দৌড়ে। জিল রকি বিচ হাইস্কুলের বেসবল টিমের খুব ভালো একজন ফিল্ডার। মাঝারি গড়নের, পেটা শরীর, গায়ে অনেক জোর।

ম্যাপের ছয়টা থেকে নয়টার মাঝামাঝি অংশটা দেওয়া হলো টম আর জিলকে। তদন্তের ব্যাপারে টুকটাক আরও কয়েকটা কথা বলে ওদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো অভিযানে।

‘মুসার খবর কী?’ ছেলেদের জিজ্ঞেস করলেন মি. পাশা। ‘ও যাচ্ছে না খোঁজার কাজে?’

‘মনে হয় ঘুম থেকেই ওঠেনি এখনো।’ হাসল কিশোর। ‘ঘুমকাতুরে হিসেবে তো নাম আছে মুসার।’

‘কিংবা হয়তো দ্বিতীয়বারের মতো নাশতায় বসেছে।’ টিপ্পনী কাটল রবিন।

‘ওই যে এসে গেছে।’ বলতে বলতে মেরি চাচি এসে দাঁড়ালেন সামনের বারান্দায়। ‘মি. আমানের গাড়ি না ওটা?’

‘হ্যাঁ, তাঁরই।’ জবাব দিল কিশোর।

মুসার বাবা ছেলেকে কিশোরদের গেটে নামিয়ে দিয়ে গেলেন। হন্তদন্ত হয়ে বারান্দায় উঠে এল মুসা। ‘গুড মর্নিং আন্টি, গুড মর্নিং আঙ্কেল, আর এই যে, দোস্তরা!’ উৎফুল্ল গলায় কথার তুবড়ি ছোটাল মুসা। ‘সরি, একটু দেরি হয়ে গেল। বেরোতে গিয়ে দুনিয়ার জায়গায় ফোন শুরু করল বাবা। আমি তো ভয়ই পেয়ে গেলাম যে কালকের আগে মনে হয় আর আসতেই পারব না।’

ওর কথা থামতে বলে উঠলেন মি. পাশা, ‘তো, আমি তো বলেছিলাম দুজন দুজন করে ভাগ হতে। এখন দেখছি, লোক একজন কম পড়ে। এদিকে বাকি আছে অর্ধেক এলাকা।’ হঠাৎ লাজুক হাসলেন দুঁদে গোয়েন্দা। ‘একজনের সঙ্গে আমি নিজে থাকলে কেমন হয়?’

খুশিতে অধীর হয়ে চাচার দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন। ‘সত্যিই যাবে?’ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। ‘তাহলে এই মুহূর্তে তোমাকে আমার পার্টনার করে নিচ্ছি আমি।’

‘আরেকটা পরামর্শ আছে আমার।’ বললেন মি. পাশা। ‘ম্যাপের চিহ্নিত এলাকায় তল্লাশি চালাতে তোমাদের সবার তিন ঘণ্টার বেশি লাগার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে বাড়তি একটা জায়গা তোমরা দেখতে পারো।’

‘কোনটা সেটা?’ উৎসুক রবিন।

‘উইলো গ্রোভ। মূলত একটা পার্ক ওটা। কিন্তু এক পাশে বড় বড় জংলা জমি আছে ওটার। চোরাই গাড়ি লুকানোর ভালো জায়গা।’

মি. পাশা পরামর্শ দিলেন, দুপুরে উইলো গ্রোভে পিকনিক করতে যেতে পারে ছেলেরা। পরে কাছ থেকে খোঁজখবর করে দেখতে পারবে। ‘মানে, এর মাঝে যদি মুসার জেলোপিটা পেয়ে না যাও আরকি।’ যোগ করলেন তিনি।

মাঝখানে বলে উঠলেন মেরি চাচি, ‘আমি তোমাদের জন্য লাঞ্চ বানিয়ে দিতে পারি।’

‘হা হা হা।’ হাসিতে উদ্বেলিত মুসার মুখ, ‘তাহলে তো কথাই নেই, আন্টি! আপনার রান্না, উফ্!’

পরিকল্পনাটা দারুণ মনে ধরল কিশোর আর রবিনের। আলোচনা করে ঠিক হলো, বেলা একটা পর্যন্ত খুঁজবে ওরা। এ সময়ের মধ্যে গাড়ি পাক বা না পাক, পিকনিক করতে চলে যাবে সবাই। মেরি চাচি বললেন, যে-ই ফোন করবে, অন্যদের সেটা জানিয়ে দেবেন।

রবিন আর মুসা গিয়ে উঠল রবিনের মোটরসাইকেলে। ম্যাপের বারোটা থেকে তিনটার ঘরে অনুসন্ধান চালাবে ওরা। সবশেষে গাড়ি নিয়ে রওনা হলো কিশোর আর মি. পাশা, তিনটা থেকে ছয়টার ভাগ রইল তাদের জন্য।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলল সতর্ক তল্লাশি। কি পাবলিক, কি প্রাইভেট—প্রতিটি গ্যারেজ, কম ব্যবহার হয় এমন প্রতিটি রাস্তা, গাছপালা ঘেরা প্রতিটা জমি, সব তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। মুসার হলদে জেলোপির কোনো চিহ্নই পাওয়া গেল না কোথাও। শেষ পর্যন্ত একটার দিকে বাসায় ফিরে এল কিশোর আর ওর চাচা। একটু পর মুসা আর রবিনও ফিরে এল। একগাদা পিকনিকের খাবারদাবার তোলা হলো দুই মোটরসাইকেলে। রওনা হলো পিকনিক করতে। তবে এবার কিশোরের চাচা আর গেলেন না ওদের সঙ্গে।

পিকনিকের এলাকায় এসে মোটরসাইকেলগুলোকে বেড়ার বাইরে রাখতে হলো ওদের। কেরিয়ার থেকে লাঞ্চ বক্সগুলো খুলে নিয়ে সামনের লেকের দিকে হাঁটা ধরল ওরা। বাকিরাও ইতিমধ্যে চলে এসেছে ওখানে।

দ্রুত হাতে খাবার বের করে পার্কের পিকনিক টেবিলে সাজিয়ে ফেলল ওরা।

‘উম্ম্! চিকেন স্যান্ডউইচ!’ শব্দ করে জিব চাটল মুসা।

খেতে খেতে সকালের তদন্তের ফলাফল আলোচনা করতে লাগল ওরা। আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সবাই, কিন্তু চোরাই গাড়ির কোনো খোঁজ পায়নি কেউ।

‘এখনো কাজ শেষ হয়নি আমাদের।’ সবাইকে মনে করিয়ে দিল কিশোর। ‘কিন্তু আমার অবস্থা কাহিল। একটু রেস্ট না নিয়ে আর উঠতে পারছি না আমি।’

রবিন বাদে বাকি সবারও মোটামুটি একই অবস্থা। সে সবার চেয়ে কম খেয়েছে। খাওয়া শেষ হতে, ঘাসের ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল সবাই। একটু জিরিয়ে নেবে। ওদের ডান পাশেই একটা জঙ্গল। রবিন একাই উঠে দেখতে চলল, কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে কি না, ঝোপঝাড়ের ভেতর।

মিনিট বিশেক খুঁজেও কোনো গাড়ির নিশানা পেল না সে। নিরাশ হয়ে ফিরে আসতে যাচ্ছে অন্যদের কাছে, ঠিক এমন সময় এক টুকরো পরিষ্কার জমি চোখে পড়ল ওর। দেখে মনে হলো, পরিত্যক্ত কোনো রাস্তা ওটা।

উত্তেজিত হয়ে ঝোপ–জঙ্গল ঠেলে এগিয়ে চলল রবিন। জঙ্গলের খানিকটা নিচুতে জায়গাটা, মাটিও ভেজা ভেজা। একখানে তো পুরোপুরি কাদা। ওখানেই কিছু একটা দেখে কৌতূহল হলো রবিনের।

‘এ তো দেখি টায়ার! তাহলে হয়তো গাড়িও ছিল।’ নিজের মনে বিড়বিড় করল সে। যদিও কাছেপিঠে কোথাও গাড়ি চোখে পড়ছে না ওর। ‘নাহ্, কোনো পায়ের ছাপও তো দেখছি না। মনে হচ্ছে, টায়ারটা কেউ ফেলে দিয়েছে এখানে।’

কিন্তু বিষয়টাকে উপেক্ষা না করে কাছে গিয়ে ভালো করে দেখল ও।

‘চাকার খাঁজটা তো।’ উত্তেজিত হয়ে উঠল সে, ‘পরিচিত মনে হচ্ছে!’

যতক্ষণ না নিশ্চিত হলো, তাকিয়ে রইল টায়ারটার দিকে। তারপর িশগগিরই ছুটতে শুরু করল বন্ধুদের দিকে।

‘এই! শুনছ তোমরা!’ চেঁচিয়ে বলল সে। ‘একটা সূত্র পেয়ে গেছি মনে হচ্ছে!’

ছয়

সবাইকে পথ দেখিয়ে কর্দমাক্ত এলাকাটায় নিয়ে চলল রবিন। টায়ারটা পরীক্ষা করেই চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

‘কোনো ভুল নেই! আমার গাড়িরই টায়ার! নতুন টায়ার লাগিয়ে পুরোনোটা ফেলে দিয়ে গেছে চোর।’

‘সম্ভবত আশপাশেই কোথাও আছে ইয়েলো বেবি।’ দ্রুত সিদ্ধান্তে এল কিশোর। ‘নিশ্চিন্তে কেটে পড়ার আগে, হয়তো এই রাস্তাটাকেই লুকানোর জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছে চোরটা।’

‘উপযুক্ত জায়গাই বটে।’ সায় দিল মুসা। ‘উইলো গ্রোভে আসা লোকজনের গাড়ি রাখতে হয় গেটে। কাজেই এ পর্যন্ত আসবে না কেউ। কিন্তু এই পুরোনো রাস্তাটা হাইওয়ে থেকেই এসেছে। চল, খুঁজে দেখি।’

পরিত্যক্ত রাস্তা ধরে হাইওয়ের দিকে খুঁজতে শুরু করল ওরা। খানিক বাদেই সামনে থাকা কিশোর আর মুসা চেঁচিয়ে উঠল একসঙ্গে।

‘এই যে একটা শাখা রাস্তা! আর এই যে এদিক দিয়ে গেছে চাকার দাগ!’ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে কিশোর। একফালি সরু পথ চলে গেছে একধার দিয়ে। ঘাস, লতাপাতায় প্রায় ঢাকা বললেই চলে। পরিত্যক্ত রাস্তা থেকে শুরু হয়ে, ঢুকে গেছে জঙ্গলের গভীরে।

বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে রাস্তাটা ধরে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল কিশোর আর মুসা। বেরিয়ে এল একফালি খালি জায়গায়।

গাছে ঘেরা সেই খালি জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে মুসার হারানো জেলোপি!

‘আমার ইয়েলো বেবি!’ আনন্দে ফেটে পড়ল মুসা। ‘এই যে লাইসেন্স প্লেট!’

গভীর মমতায় গাড়িটা পরীক্ষা করল। অবশেষে গালভরা সন্তুষ্টির হাসি নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

‘একবিন্দুও ক্ষতি হয়নি আমার ইয়েলো বেবির। চলার জন্য একেবারে তৈরি। চোরটা গাড়িটা লুকিয়ে রেখেই কেটে পড়েছে। এসো, দোস্তরা, উঠে পড়ো। পয়সা ছাড়াই হাইওয়েতে ঘুরিয়ে আনি!’

চলে আসার আগে চোরের পায়ের ছাপ পরীক্ষা করল কিশোর। ‘স্নিকার পরে ছিল চোরটা।’ দেখে বলল সে।

এমন সময় দরজা খুলে মেঝের দিকে তাকাল মুসা। ‘বলতে চাইছ, আমার স্নিকার পরেছে ব্যাটা। দেখ, আমার জোড়া গায়েব।’

‘আর নিজের জোড়া খুলে নিয়ে গেছে।’ দেখে বলল রবিন। ‘দারুণ চালাক। সূত্র তো এবার গেল। জুতার ছাপ দেখে ধরার আর কোনো উপায় থাকল না।’

‘চল যাই!’ তাগাদা দিল মুসা।

লাফ দিয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল সে। মুহূর্ত পরেই গর্জে উঠল ইঞ্জিন। খালি জায়গাটা একেবারেই ছোট। গাড়ি ঘোরানোর জায়গা নেই বললেই চলে। কষ্টেসৃষ্টে, কোনোমতে ঘুরিয়ে জেলোপিটাকে যখন শাখা রাস্তার মুখে ওঠাল মুসা, হইহই করে উঠল ওর বন্ধুরা। চেপে বসল গাড়িতে।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

হেলেদুলে পরিত্যক্ত রাস্তায় গিয়ে উঠল জেলোপি। ওখান থেকে মেইন হাইওয়ে পর্যন্ত যেতে আর কোনো অসুবিধা হলো না। বিডের ট্রাক আর ছেলেদের মোটরসাইকেল, যার যারটা বুঝে নিল ওরা। তারপর সামনে কিশোর আর রবিনকে রেখে মিছিল করে ফিরে চলল রকি বিচে। ওদের ইচ্ছে, সোজা পুলিশ হেডকোয়ার্টারে গিয়ে সাফল্যের কথাটা চিফ ফ্লেচারকে শুনিয়ে আসবে।

‘আশা করি, ফ্রেডকেও পাওয়া যাবে ওখানে।’ হেসে বলল মুসা।

খানিক বাদে ডগলাস ফ্রেডকে দেখল ওরা, কপালে দীর্ঘ ভাঁজ ফেলে হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

‘এই যে ডিটেকটিভ, কী খবর!’ হেঁকে উঠল রবিন। ‘দেখলেন তো, মুসার গাড়ি বের করে ফেলেছি আমরা।’

‘চোরাই গাড়ির চেয়ে চিন্তা করার মতো আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে আমার...।’ শুরু করেছিল ডিটেকটিভ, পরক্ষণেই মনে হয় পুরো বিষয়টা উপলব্ধিতে এল তার। ‘অ্যাঁ, কী বললে?’ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মুসার গাড়িটার দিকে।

ফ্রেডের মুখ থেকে প্রশংসা শোনার অপেক্ষা করল ছেলেরা। কিন্তু তার ধারকাছ দিয়েও গেল না ডিটেকটিভ। বলল, ‘বিরাট এক রহস্য সমাধান করতে হবে আমার। টাওয়ার ম্যানশনে ডাকাতি হয়েছে!’

‘বলেন কী!’ সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর আর রবিন।

রকি বিচের দর্শনীয় জায়গাগুলোর একটা টাওয়ার ম্যানশন। এযাবৎ শহরের হাতে গোনা কয়েকজনের মাত্র সৌভাগ্য হয়েছে ওটার ভেতরে যাওয়ার। প্রাসাদের মতো বিশাল অট্টালিকাটার যত নামডাক, যত প্রশংসা, তা সব বাইরের চাকচিক্য থেকেই। রকি বিচে নতুন আসা কারও মনে সচরাচর এই প্রশ্নটাই জাগে: ‘পাহাড়ের মাথায় টাওয়ারওয়ালা ওই প্রাসাদটার মালিক কে?’

উপসাগরের দিকে মুখ করে থাকা বিশাল, পাথরের এক অট্টালিকা। বহু মাইল দূর থেকে ওটার অবয়ব দেখা যায় দিগন্তের গায়ে, ঠিক যেন কোনো মধ্যযুগীয় দুর্গ। দুর্গের সঙ্গে ওটার সাদৃশ্য বাড়িয়ে তুলেছে ভবনটার শেষ দুই মাথা থেকে উঠে যাওয়া একটা করে সুউচ্চ টাওয়ার।

ভবন তৈরির সময়ই টাওয়ারগুলোর একটা বানিয়েছিলেন মেজর বিলসন, আর্মির অবসরপ্রাপ্ত এক খ্যাপাটে বুড়ো। কিছুদিন পরে আসলটার মতো আরেকটা টাওয়ার বসান তিনি প্রাসাদের আরেক প্রান্তে। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় টাকা খাটিয়ে কপাল খুলে যায় তাঁর।

বছর কয়েক আগেও প্রাসাদটা নাচ–গান আর পার্টিতে জমজমাট ছিল। কিন্তু শেষ দিকে একসময় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে যায় বিলসন পরিবার। পুরোনো বাড়িটাতে শুধু পড়ে থাকে জন বিলসন আর তাঁর বোন কোরিয়া। বর্তমানে বিশাল, নির্জন বাড়িটাতে তাঁরা দুজনেই শুধু বাস করেন।

বছর ষাটেক বয়স জন বিলসনের, লম্বা, খানিকটা কুঁজো। দুষ্প্রাপ্য ডাকটিকিট সংগ্রহ করাই যেন বর্তমানে তাঁর জীবনের একমাত্র সাধ-আহ্লাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাঁর বোন কোরিয়া অবিবাহিত, বয়স ধরা যায় না। রকি বিচের সুসজ্জিত মহিলাদের কাছে তাঁর পোশাক-আশাক একটা মুখরোচক বিস্ময়। ক্যাটকেটে রঙের খাপছাড়া ডিজাইনের পোশাক পরেন মহিলা। সবার ধারণা, জন আর কোরিয়া মস্ত বড় ধনী। যদিও সাদাসিধে জীবনযাপন করেন তাঁরা। হাতে গোনা কয়েকজন চাকরবাকর নিয়ে তাঁদের সংসার। কখনো মেহমান যেতে দেখা যায় না তাঁদের বাড়িতে।

‘এই, ডাকাতির ঘটনাটা একটু বলেন না।’ ফ্রেডকে অনুরোধ করল রবিন।

হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করল গোয়েন্দা। ‘নিজেরাই বের করো গে যাও।’ বলে হনহন করে হেঁটে চলে গেল।

বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরল কিশোর আর রবিন। বাসায় পৌঁছেই দেখল, জন বিলসন বিদায় নিচ্ছেন ওদের বাড়ি থেকে। হাতের ছড়ি দিয়ে সিঁড়িতে টোকা দিতে দিতে নেমে এলেন ভদ্রলোক। মোটরসাইকেলের আওয়াজ কানে যেতে, খর দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকালেন একবার।

‘গুড ডে!’ গোঁ গোঁ করে বললেন, যেন নিতান্ত অনিচ্ছায়। তারপর হাঁটা ধরলেন নিজের পথে।

‘নিশ্চয়ই চাচার কাছে কেস নেওয়ার কথা বলতে এসেছিলেন।’ রবিনের উদ্দেশে বলল কিশোর। মোটরসাইকেল গ্যারেজে ঢুকিয়েই ঘরের দিকে ছুট দিল দুজন। ডাকাতির গল্প শোনার জন্য কৌতূহলে ফেটে পড়ছে। সামনের হলঘরেই দেখা হয়ে গেল রাশেদ পাশার সঙ্গে।

‘টাওয়ার ম্যানশনে ডাকাতি হয়েছে শুনলাম।’ কোনো ভূমিকা না করে জিজ্ঞেস করল রবিন।

মাথা ঝাঁকালেন মি. পাশা। ‘হ্যাঁ। এইমাত্র এসেছিলেন মি. বিলসন। কেসটা নিতে বললেন আমাকে। আমি একটু ভাবার সময় চেয়েছি। তারপর ফোন করে তাঁকে জানালে আমাকে নিতে আসবেন আবার।’

‘কী পরিমাণ খোয়া গেছে?’ জানতে চাইল কিশোর।

মুচকি হাসলেন মি. পাশা। ‘গয়নাগাটি আর সিকিউরিটি বন্ড, সব মিলিয়ে পঁচিশ লাখ ডলার হবে। বিলসনদের লাইব্রেরিতে রাখা সিন্দুক থেকে নেওয়া হয়েছে।’

‘ওরে বাপ রে! আঁতকে উঠল কিশোর। ‘এ তো বিশাল ডাকাতি! সিন্দুকটা কখন খুলল?’

‘হয় গত রাতে, নয়তো আজ সকালে। আজ সকালে ঘুম ভাঙতে ভাঙতে দশটা বেজে যায় মি. বিলসনের। তারপর লাইব্রেরিতে ঢুকতে প্রায় দুপুর। তখনই চুরির ঘটনাটা আবিষ্কার করেন তিনি।’

‘সিন্দুকটা খুলেছে কীভাবে?’

‘কম্বিনেশন ব্যবহার করে। এমন কেউ চুরি করেছে, কম্বিনেশনের নম্বর যার জানা। অথবা ধুরন্ধর কোনো চোর হবে, কম্বিনেশনের টাম্বলার পড়ার আওয়াজ শুনে নম্বর বের করে ফেলেছে।’

‘তা কী ঠিক করলে? তদন্ত করতে যাচ্ছ?’ প্রশ্ন করল উত্তেজিত কিশোর।

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ফোন করতে উঠে চলে গেলেন রাশেদ পাশা। ফিরে এলেন হাসিমুখে। বললেন, ‘কয়েক মিনিটের ভেতর রওনা হচ্ছি আমি। মি. বিলসন আসছেন আমাকে নিতে।’

‘আমি যাব আপনার সঙ্গে।’ ব্যগ্রভাবে বলল রবিন।

‘আমিও যেতে চাই।’ কিশোরও সুর মেলাল।

ছেলেদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন মি. পাশা। ‘আমার কোনো আপত্তি নেই। মি. বিলসন অসম্মতি না জানালে, আমার সঙ্গে আসতে পারো তোমরা।’

চলবে...

আরও পড়ুন