পুরোনো টাওয়ার (চতুর্থ পর্ব)

অলংকরণ: আরাফাত করিম

সাত

কয়েক মিনিট পরই শোফার-চালিত একটা দামি গাড়ি এসে থামল কিশোরদের বাড়ির সামনে। ছড়ির ওপর থুতনি রেখে মি. বিলসন বসা পেছনের সিটে। কিশোর আর রবিনকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন রাশেদ পাশা। ছেলেদের অনুরোধের কথা জানাতে, নিতান্ত অনিচ্ছায় সম্মত হলেন বিলসন। সরে বসলেন এক পাশে। চাচার পাশে উঠে বসল কিশোর আর রবিন। টাওয়ার ম্যানশনের দিকে ছুটতে শুরু করল গাড়ি।

‘আসলে কোনো ডিটেকটিভের প্রয়োজন ছিল না কেসটাতে!’ ফুঁসে উঠলেন বিলসন। ‘একেবারেই প্রয়োজন নেই। পানির মতো পরিষ্কার বিষয়। কে করেছে জানিই তো। শুধু প্রমাণ করতে পারব না, এই যা।’

‘কাকে সন্দেহ করছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন রাশেদ পাশা।

‘পৃথিবীতে একজনই আছে যে গয়না আর বন্ডগুলো নিতে পারে। পিটারসন!’

‘পিটারসন?’

‘হ্যাঁ। গ্রেগরি পিটারসন। আমার কেয়ারটেকার। ওই নিয়েছে!’

চট করে পরস্পরের দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন। টাওয়ার ম্যানশনের কেয়ারটেকার গ্রেগরি পিটারসন, ছেলেদের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাবা! বন্ধুর নাম বব পিটারসন, এত বেশি শুকনো রোগা শরীর, তার ডাকনামই হয়ে গেছে ‘স্কেলিটন’।

ডাকাতির অভিযোগে মি. পিটারসনকে দায়ী করাটা একেবারেই অযৌক্তিক মনে হলো ছেলেদের কাছে। বিভিন্ন উপলক্ষে বেশ কয়েকবার মি. পিটারসনের সঙ্গে দেখা হয়েছে ওদের। নিতান্তই সহজ-সরল, ভদ্রগোছের একজন লোক, প্রখর নীতিবোধ।

‘আমার বিশ্বাস হয় না উনি দোষী,’ ফিসফিস করে বলল কিশোর।

‘আমারও না,’ পাল্টা ফিসফিস রবিনের।

‘পিটারসনকে সন্দেহ করলেন কেন?’ জন বিলসনকে জিজ্ঞেস করলেন মি. পাশা।

‘আমি আর আমার বোন বাদে একমাত্র ও-ই আমাদের সিন্দুকটা খুলতে-লাগাতে দেখেছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখলে সহজেই ওটার কম্বিনেশন মুখস্থ হয়ে যাওয়ার কথা ওর। আমি নিশ্চিত, সেটাই করেছে সে।’

‘ওকে সন্দেহ করার পেছনে এই একটাই কারণ নাকি?’

‘না। আজ সকালে ব্যাংকে ৯ হাজার ডলারের চেক রেখে এসেছে সে। অথচ দুই দিন আগেও জানতাম, ১০০ ডলারও নেই ওর কাছে। তাহলে এত তাড়াতাড়ি হঠাৎ করে এত টাকা কোথায় পেল ও?’

‘হয়তো এর কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আছে,’ যুক্তি দেখালেন মি. পাশা।

‘ব্যাখ্যা আছে তো ভালো কথা!’ গম্ভীর স্বরে বিলসন। ‘তবে সেই ব্যাখ্যাটা আমাকে সন্তুষ্ট করার মতো যথেষ্ট জোরালো হওয়া চাই।’

গাড়িটা ইতিমধ্যে ম্যানশনে যাওয়ার প্রশস্ত ড্রাইভওয়েতে চলে এসেছে। খানিক বাদেই প্রবেশ ফটকে গিয়ে থামল ওটা। মি. পাশা আর কিশোর-রবিন বাড়ির ভেতর ঢুকল খেপাটে লোকটার সঙ্গে।

‘চুরির ঘটনা আবিষ্কারের পর থেকে লাইব্রেরির কোন জিনিস নাড়াচাড়া করা হয়নি,’ ওই দিকে যেতে যেতে বললেন তিনি। ‘যেটা যেখানে ছিল, যেমন ছিল, তেমনই আছে।’

খোলা সিন্দুকটা পরীক্ষা করলেন মি. পাশা। তারপর পকেট থেকে বিশেষ ধরনের একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করলেন। মনোযোগের সঙ্গে কম্বিনেশন লকের ডায়ালটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন তিনি। তারপর প্রতিটি জানালা আর দরজার কাছে গিয়ে আঙুলের ছাপ পাওয়া যায় কি না দেখলেন। তারপর মি. বিলসনকে তাঁর আঙুলগুলো উজ্জ্বল আলোর সামনে উঁচু করে ধরতে বললেন, যাতে ডগার সর্পিল রেখাগুলো পরিষ্কার চোখে পড়ে। দেখা শেষ করে অবশেষে মাথা নাড়লেন মি. পাশা।

‘পরিচ্ছন্ন কাজ,’ মন্তব্য করলেন তিনি। ‘নিশ্চয়ই গ্লাভস পরা ছিল চোরটার। ঘরের যতগুলো ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেখলাম, সব মনে হয় আপনার, মি. বিলসন।’

‘ওসব আঙুলের ছাপটাপ বা অন্য কোনো প্রমাণ খুঁজে লাভ নেই,’ অধৈর্য গলায় বললেন বিলসন। ‘বললামই তো, কাজটা পিটারসনের।’

‘ওকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারলে ভালো হতো,’ প্রস্তাব করলেন মি. পাশা।

বেল বাজিয়ে একজন চাকরকে ডাকলেন বিলসন। কেয়ারটেকারকে ডেকে আনতে বললেন। ছেলেদের দিকে তাকালেন।

ওদের বাইরে বেরিয়ে যেতে ইশারা করলেন মি. পাশা। ‘এতে পরিস্থিতি কিছুটা কম বিব্রতকর হবে মি. পিটারসনের জন্য,’ নিচু গলায় বললেন ওদের।

সঙ্গে সঙ্গে বারান্দায় বেরিয়ে এল কিশোর আর রবিন। মি. পিটারসন আর তাঁর ছেলে ববের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ওদের। পিটারসন শান্তই আছেন, তবে ফ্যাকাসে হয়ে গেছেন। দরজায় দাঁড়িয়ে ববের কাঁধ চাপড়ে সান্ত্বনা দিলেন।

‘ভেবো না,’ বললেন তিনি, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে।’ তারপর ঢুকে গেলেন ভেতরে।

বন্ধুদের দিকে ঘুরল বব। ‘ঠিক হতেই হবে!’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলল সে। ‘আমার বাবা নির্দোষ!’

ববের বাবাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ওকে সব রকম সাহায্য করবে ঠিক করল কিশোর আর রবিন। ওদেরও দৃঢ়বিশ্বাস মি. পিটারসন নির্দোষ, সে কথা জানাল ববকে।

‘অবশ্যই উনি নির্দোষ,’ সায় দিল কিশোর। ‘অভিযোগ থেকে ঠিকই বেরিয়ে আসবেন, দেখো।’

‘কিন্তু এই মুহূর্তে সবকিছুই তার বিপক্ষে,’ কাঁপতে কাঁপতে বলল বব। রক্ত সরে গেছে মুখ থেকে। ‘আসল চোরটাকে যতক্ষণ ধরতে না পারছেন মি. পাশা, ততক্ষণ বাবার ঘাড়েই চুরির দায় চেপে থাকবে।’

‘সবাই জানে তোমার বাবা ভালো লোক,’ সান্ত্বনা দিল রবিন। ‘উনি যে বিশ্বাসী একজন কর্মচারী, সেটা মি. বিলসনকেও মানতে হবে।’

‘কিন্তু তাতে তো চুরির দায় থেকে মুক্ত হচ্ছে না সে। আর বাবা স্বীকারও করেছে, কম্বিনেশনের নম্বর তার জানা। যদিও ওটা ব্যবহার করার কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি কখনো।’

‘নম্বর জানা?’ পুনরাবৃত্তি করল রবিন। বিস্মিত হয়েছে।

‘কম্বিনেশনটা দৈবক্রমে জেনে ফেলেছে বাবা। এত সহজ নম্বর, ভুলে যাওয়ার কোনো সুযোগই নেই। ঘটনাটা এ রকম। একদিন লাইব্রেরির ফায়ারপ্লেস পরিষ্কার করার সময় এক টুকরো কাগজ কুড়িয়ে পায় বাবা। ওখানেই লেখা ছিল নম্বরটা। খানিক দেখে তার ধারণা হলো, এটা সেফের কম্বিনেশন নম্বর হবে। বাবা ধারণা করল, কাগজটা ডেস্কের ওপর রাখা ছিল। খোলা জানালা দিয়ে বাতাস আসছিল, নিশ্চয়ই উড়িয়ে এনে ফেলেছে মেঝেতে।’

‘মি. বিলসন জানতেন এটা?’

‘এখনো জানে না। তবে বাবা এখন বলে দেবে। যদিও বুঝতে পারছে, ব্যাপারটা তার বিপক্ষেই যাবে, তারপরও সত্যিটা জানিয়ে দেবে মি. বিলসনকে, আমি জানি।’

লাইব্রেরি থেকে গুঞ্জন ভেসে এল। অন্য দুজনের অস্পষ্ট কথার আওয়াজ ছাপিয়ে থেকে থেকে জন বিলসনের কর্কশ গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। শেষ অবধি, হঠাৎ মি. পিটারসনের গলা চড়তে শুনল ছেলেরা।

‘কাজটা আমি করিনি! বললামই তো, টাকাটা আমি নিইনি!’

‘তাহলে ওই ৯ হাজার ডলারের চেকটা কোথায় পেলে তুমি?’ কঠোর গলায় জানতে চাইলেন বিলসন।

নীরবতা।

‘বলো, কোথায় পেয়েছ?’

‘আপনাকে কেন, কাউকেই সেটা বলতে পারব না আমি।’

‘কারণ?’

‘টাকাটা আমি সৎ পথে পেয়েছি—শুধু এটুকু বলতে পারি।’

‘বা-বা!’ গলা চড়ালেন বিলসন। ‘সৎ পথে পেয়েছ, কিন্তু কোথা থেকে পেয়েছ, বলতে পারবে না! দারুণ কেচ্ছা তো! সৎ পথেই যদি পাও, তাহলে কোথায় পেয়েছ, বলতে লজ্জা কী।’

‘লজ্জা পাচ্ছি না আমি। তবে বলেছি তো, এই সম্পর্কে কিছু বলার এখতিয়ার নেই আমার।’

‘চট করে ৯ হাজার ডলার পেয়ে গেলে, ফাজলামো নাকি! গত হপ্তায়ও তো টানাটানির মধ্যে ছিলে তুমি, কী? আমার কাছে মাসের বেতন অগ্রিম চাওনি?’

‘চেয়েছি।’

‘আর তার পরপরই, বেছে বেছে চুরির দিন একেবারে ৯ হাজার ডলার হাতে এসে গেল তোমার! অথচ বলছ না কোথা থেকে এল!’

মি. পাশার শান্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘অবশ্যই আপনার ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাতে চাই না আমি, মি. পিটারসন। তবে আমার মনে হয়, এই টাকার ব্যাপারটা আপনার কাছে খোলাসা করে ফেলাই ভালো। বুঝতে পারছি, ব্যাপারটা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে,’ ক্লান্ত গলায় বললেন কেয়ারটেকার। ‘কিন্তু আমি একজনকে কথা দিয়েছি কাউকে বলব না। এই প্রতিশ্রুতি আমি ভাঙতে পারব না।’

‘আর স্বীকারও করেছ যে কম্বিনেশনের নম্বর তোমার জানা, অ্যাঁ!’ বাধা দিয়ে বললেন বিলসন। ‘কই, আমি তো জানতাম না। আগে কেন বলোনি সেটা?’

‘আমার কাছে তেমন জরুরি মনে হয়নি।’

‘অথচ এখন মনে হয়েছে!’

‘হ্যাঁ। পরিস্থিতির কারণে। আমার লুকানোর কিছু নেই। গয়না আর সিকিউরিটিগুলো যদি আমি নিয়ে থাকতাম, তাহলে কম্বিনেশনের ব্যাপারটা বলতাম না আপনাদের।’

‘হ্যাঁ,’ বললেন মি. পাশা, ‘এই একটা পয়েন্ট আপনার পক্ষে যায়, মি. পিটারসন।’

‘তাই নাকি?’ ভুরু কোঁচকালেন বিলসন। ‘মহা ধড়িবাজ লোক পিটারসন। ইচ্ছে করে কৌশলটা খাটিয়েছে। ভেবেছে, সততার ভেক ধরলেই আমি ওকে সৎ মনে করব। ভাবব, আহা, চুরিটা ও করেনি! ধুরন্ধর লোক। তবে অতটা না। এই মুহূর্তে ওকে ফাটকে পোরার মতো যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে, এবং আর সময় নষ্ট করতে রাজি নই আমি।’

একমুহূর্ত পরই টেলিফোনে মি. বিলসনকে বলতে শোনা গেল, ‘পুলিশ স্টেশন? হ্যালো...পুলিশ স্টেশন? বিলসন বলছি—বিলসন—জন বিলসন...আচ্ছা, চোরটাকে পেয়ে গেছি আমরা...হ্যাঁ, লোকটা পিটারসন...আপনারাও তাই ভেবেছিলেন?...আমিও, তবে কিছুটা দ্বিধা ছিল...সত্যি সত্যি ও নিজেই নিজের কথায় ধরা খেয়েছে...জি, আমি ওর গ্রেপ্তার চাইছি...আপনারা এখনই আসছেন?...খুব ভালো...গুড বাই!’

‘আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবেন, মি. বিলসন?’ ককিয়ে উঠলেন কেয়ারটেকার। মুষড়ে পড়েছেন।

‘কেন দেব না? তুমিই তো চোর!’

‘অরেকটু অপেক্ষা করলে ভালো হতো,’ বাধা দিয়ে বললেন মি. পাশা। ‘অন্তত যতক্ষণ না আরও কিছু তথ্যপ্রমাণ হাতে আসে।’

‘আর কী প্রমাণ চাই আপনার, মি. পাশা?’ নাক দিয়ে বিচিত্র আওয়াজ করলেন টাওয়ার ম্যানশনের মালিক। ‘পিটারসন যদি গয়না আর সিকিউরিটিগুলো ফেরত দেয়, তো কেস উঠিয়ে নিতে পারি আমি।’

‘আমি কোত্থেকে দেব!’ প্রতিবাদ করলেন মি. পিটারসন।

‘ভাবার জন্য যথেষ্ট সময় পাবে,’ ব্যঙ্গের সুরে বললেন বিলসন। ‘বহুদিন গারদে থাকতে হবে তোমাকে...বহুদিন।’

হলওয়েতে দাঁড়িয়ে ভেতরের উত্তপ্ত বাদানুবাদ আর উদ্বিগ্ন কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছে ছেলেরা। সহসাই যেন দুঃখজনক দিকে মোড় নিল কেসটা। ববকে দেখে মনে হচ্ছে, এত চাপ সহ্য করতে না পেরে যেকোনো সময় জ্ঞান হারাবে।

‘আমার বাবা নিরপরাধ,’ দুই হাত মুঠি পাকিয়ে, বিড়বিড় করে একই কথা বারবার বলে চলেছে সে। ‘আমি তা জানি। ওকে ধরতে পারে না পুলিশ। জীবনে কখনো কারও জিনিস না বলে নেয়নি বাবা!’

বন্ধুর কাঁধ চাপড়ে সান্ত্বনা দিল কিশোর। ‘চিন্তা কোরো না, বব। আমি শিওর, তোমার বাবা ঠিকই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে বেরিয়ে আসবেন, দেখো।’

‘মাকে জানাতে হবে,’ কোনোমতে উচ্চারণ করল বব। ‘একেবারে ভেঙে পড়বে মা। আর আমার বোনেরা...’

আট

ববের পেছন পেছন, হলঘর থেকে বেরিয়ে একটা করিডর ধরে প্রাসাদের পূর্ব পাশটায় চলে এল কিশোর আর রবিন। সেখানে সামান্য কয়েকটা আসবাবপত্রে সাজানো ছিমছাম, পরিপাটি একটা ঘরে মিসেস পিটারসনকে দেখতে পেল। ভদ্র, মায়াভরা চেহারার এক মহিলা। খোঁড়া। জানালার ধারে একটা চেয়ারে বসে, উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছেন। পাশেই দাঁড়িয়ে তাঁর দুই মেয়ে নিরা আর ডলি—১২ বছরের যমজ দুই বোন। ছেলেরা ঢুকতেই, আশা নিয়ে সবাই তাকাল ওদের দিকে।

‘খবর কী, বাবা?’ ছেলেদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর, সাহস করে জিজ্ঞেস করলেন মিসেস পিটারসন।

‘খারাপ খবর, মা।’ জবাব দিল বব।

‘ওরা তো...ওরা তো...অ্যারেস্ট করছে না বাবাকে, না?’ কাঁদতে কাঁদতে সামনে ছুটে এল নিরা।

নিঃশব্দে শুধু মাথা ঝাঁকাল বব।

‘কিন্তু এটা তো করতে পারে না ওরা!’ প্রতিবাদ করল ডলি। ‘অমন কিছু কখনো করবে না বাবা! এটা অন্যায়...’

মিসেস পিটারসনের দিকে তাকাতে, হঠাৎ তাঁকে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়তে দেখল কিশোর। মেঝেতে পড়ার আগেই ও একলাফে সামনে গিয়ে ধরে ফেলল মহিলাকে।

‘মা!’ আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল বব।

আলগোছে মহিলাকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে, দ্রুত ওর বোনের দিকে ঘুরল কিশোর। জরুরি গলায় বলল, ‘ঝটপট স্মেলিং সল্ট আর অন্য কি ওষুধ আছে, নিয়ে এসো তো নিরা।’

বব জানাল, উত্তেজিত হলে হঠাৎ মাঝে মাঝে অমন অজ্ঞান হয়ে যায় ওর মা। ‘বাবার খবর মাকে দেওয়াটা একবারেই ঠিক হয়নি!’

‘একসময় তো জানতেনই,’ নরম গলায় বলল রবিন।

মুহূর্তের ভেতর স্মেলিং সল্টের শিশি আর ওষুধ নিয়ে এল নিরা। স্মেলিং সল্ট শোঁকাতে চেতনা ফিরে এল মিসেস পিটারসনের। তখন নিরা তাকে ওষুধ খাইয়ে দিল। খানিক বাদেই কিছুটা স্বাভাবিক হলেন মহিলা। কুণ্ঠিত গলায় দুঃখ প্রকাশ করলেন, সবাইকে চিন্তায় ফেলে দেওয়ার জন্য।

‘স্বামীকে অ্যারেস্ট করা হচ্ছে, খবরটা সত্যিই ভীষণ এক ধাক্কা আমার জন্য,’ আস্তে আস্তে বললেন তিনি। ‘কিন্তু তার নির্দোষ প্রমাণের জন্য কিছু না কিছু নিশ্চয়ই করা যাবে।’

মহিলাকে সান্ত্বনা দিল কিশোর আর রবিন। বলল, আসল চোরটাকে ধরার সাধ্যমতো চেষ্টা করবে ওরা। কারণ ওরা নিজেরাও বিশ্বাস করে যে মি. পিটারসন অপরাধী নন।

পরদিন সকালে নিজেদের ঘরে কাপড় পাল্টাচ্ছে ছেলেরা। এই সময় বলল কিশোর, ‘কেসটার বহু কিছু এখনো আড়ালে রয়ে গেছে। এমনও হতে পারে, মুসার গাড়িচোরের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রয়েছে এর।’

একমত হলো রবিন। ‘লোকটা অপরাধী—এটুকু তো নিশ্চিত। একে তো একটা মোটরগাড়ি চুরি করেছে, তার ওপর আবার টিকিট অফিসেও ডাকাতির চেষ্টা করেছে। তাহলে আরেকটা ডাকাতি করতে তার বাধা কোথায়?’

‘ঠিকই বলেছ, রবিন। আর এইমাত্র মাথায় এল, উদ্ধারের পর আর মুসার গাড়িটা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি, কোনো সূত্র ফেলে গেছে কি না চোরটা। এখন চল, গিয়ে দেখি।’

ওই দিন আর স্কুলে গাড়ি নিয়ে আসেনি মুসা। কাজেই তখনকার মতো কৌতূহল চাপা দিয়ে রাখতে হলো ওদের। ক্লাস শেষ করে খানিকক্ষণ বেসবল প্র্যাকটিস চলল স্কুলের মাঠে। অবশেষে মিসেস আমান যখন মুসা আর ফারিহাকে নিতে এলেন, তখন ওরাও চলল ওদের সঙ্গে।

মুসাদের বাড়িতে পৌঁছে মুসার গাড়ির কাছে গিয়ে রবিন বলল, ‘আমি সিটের তলাগুলো দেখি।’

‘আর আমি গাড়ির ট্রাঙ্কে খোঁজ করছি।’ গাড়ির পেছনে গিয়ে ডালা উঠিয়ে দিল কিশোর। নেকড়া, কাগজপত্র আর স্কুলের ছেঁড়াফাটা বই–খাতা ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করল সে। খানিক বাদেই উল্লসিত চিত্কার শোনা গেল ওর।

‘এই পেয়েছি! দুনিয়ায় এর চেয়ে ভালো প্রমাণ আর কী আছে!’

ছুটে এল রবিন আর মুসা। লাল একটা পরচুলা টেনে বের করল সে।

মহা উত্তেজিত কিশোর। ‘এটাতে হয়তো কোনো সূত্র থাকতে পারে!’

তেমন কিছু পাওয়া গেল না পরীক্ষা করে। কিন্তু কিশোর বলল, ওর চাচাকে একবার দেখাতে চায় উইগটা। একটা রুমালে মুড়ে ওটা সাবধানে পকেটে ঢুকিয়ে রাখল সে। মুসা ওদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে চলল। মি. পাশাকে তাঁর স্টাডিরুমে পাওয়া যাবে অনুমান করে একছুটে ওপরে চলে এল ছেলেরা। তারপর কোনোরকম জানান না দিয়ে সোজা ঢুকে পড়ল তাঁর কাজের ঘরে।

‘আঙ্কেল, দেখুন একটা সূত্র পেয়ে গেছি!’ চেঁচিয়ে বলতে শুরু করেছিল রবিন। কিন্তু পরক্ষণেই পিছিয়ে এল। লজ্জা পেয়েছে। অন্য কেউ যে ঘরে আছে, বুঝে উঠতে পারেনি।

‘সরি!’ বলল কিশোর। বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল ওরা ঘর থেকে। কিন্তু মি. পাশার মেহমান এদিকে ঘুরতেই বব পিটারসনকে চিনল ওরা।

‘আরে, আমাকে দেখে পালাচ্ছিলে?’ বব বলল।

‘প্রথমে তোমাকে চিনতে পারিনি!’

‘টাওয়ার ডাকাতির ব্যাপারে আরও কিছু তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করছিল বব,’ ব্যাখ্যা করলেন মি. পাশা। ‘কিন্তু তোমরা কিসের সূত্রের কথা বলছিলে?’

‘ডাকাতির সঙ্গেও সম্পর্ক থাকতে পারে এটার,’ জবাবে বলল কিশোর। ‘ওই লালচুলো লোকটার বিষয়ে।’ পকেট থেকে উইগটা বের করল সে। কোথায় পেয়েছে, জানাল।

সঙ্গে সঙ্গে আগ্রহী হয়ে উঠলেন মি. পাশা। ‘মনে হচ্ছে, ঘটনাগুলো সব একসূত্রে গাঁথা। উপকূলের রাস্তায় যে লোকটাকে তোমরা দেখেছিলে, অ্যাকসিডেন্টে ভেঙে গেল তার গাড়ি। তখন মুসার গাড়িটা চুরি করল সে। পরে টিকিট অফিসে ডাকাতির চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। অবশেষে টাওয়ারে গিয়ে আরও বড় দাও মারতে সফল হলো।’

‘আঙ্কেল, উইগটা কি সত্যি সত্যি টাওয়ার ডাকাতি সুরাহায় কাজে আসবে?’ ব্যগ্র হয়ে জানতে চাইল বব। চোখভরা আশা।

‘সম্ভবত।’

‘আঙ্কেলকে যা বলছিলাম আমি,’ কিশোরদের জানাল বব। ‘ডাকাতি হওয়ার দিন দুয়েক আগে, ম্যানশনের চারপাশে একটা অচেনা লোককে ঘুরঘুর করতে দেখেছিলাম আমি। তখন বিষয়টাকে পাত্তা দিইনি। আর তারপর তো বাবার ওই ঘটনার ধাক্কায় ভুলেই গিয়েছিলাম।’

‘ভালোমতো চেহারা দেখেছিলে লোকটার? কেমন দেখতে, বলতে পারবে?’ জানতে চাইল কিশোর।

‘মনে হয়, পারব না। ঘটনাটা সন্ধ্যায় ঘটেছিল। জানালার পাশে বসে পড়াশোনা করছিলাম। মুখ তুলে দেখি, গাছপালার ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে লোকটা। পরে, মাঠের অন্যপাশ থেকে কুকুরের ডাক শুনতে পেলাম। খানিক বাদেই একটা লোককে ছুটে যেতে দেখলাম উঠান পার হয়ে। আমি ভেবেছিলাম, কোনো ভবঘুরে হবে হয়তো।’

‘ওর মাথায় কি ক্যাপ ছিল, না হ্যাট?’

‘যত দূর মনে পড়ে, ক্যাপ। অন্ধকারে পোশাক দেখতে পাইনি।’

‘আর মুখ দেখোনি লোকটার, তাই তো?’

‘নাহ্।’

‘তো, যদিও বিশেষ কিছু হচ্ছে না এটুকুতে,’ বললেন মি. পাশা, ‘তবে এর সঙ্গে যোগসূত্র থাকতে পারে মুসার জেলোপি চোরের। কিশোর আর রবিন যেমন ধারণা করছে, লোকটা এখনো রকি বিচের আশপাশেই কোথাও আছে, তা-ও ঠিক।’ কিছুক্ষণ গভীরভাবে চিন্তা করলেন গোয়েন্দা। ‘এ ঘটনাগুলো সব খুলে বলব আমি মি. বিলসনকে। আর পুলিশের বড় কর্তাদের সঙ্গেও কথা বলব আমি। আমার মনে হয় না, বব, তোমার বাবাকে আটকে রাখার মতো যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে ওদের কাছে।’

‘বাবাকে বের করে আনতে পারবেন, আঙ্কেল?’ ব্যাকুল গলায় বলল বব।

‘পারব। সত্যি বলতে কী, এতক্ষণে হয়তো নিজের ভুল বুঝতে শুরু করেছেন মি. বিলসন।’

‘বাবা ফিরে এলে দারুণ হবে,’ বলল বব। ‘অবশ্য অবস্থার বিশেষ হেরফের হবে না তাতে। যতক্ষণ না আসল অপরাধী ধরা পড়ছে, সন্দেহের কালো মেঘ সরছে না তার মুখ থেকে। আমার মনে হয় না, মি. বিলসন তাকে কাজে বহাল করবেন, বা অন্য কেউ তাকে কাজ দেবে।’

‘সে কারণেই তো যত দ্রুত সম্ভব কেসটা সমাধান করে ফেলতে হবে আমাদের। প্রচুর খাটতে হবে,’ বলল কিশোর। তার কথা শেষ হতে যোগ করল রবিন, ‘বব, তোমার বাবার জন্য যত দূর সাধ্যে কুলোয় আমাদের, সবই করব।’

পরদিন বিকেলে স্কুল শেষে বাড়ি ফিরছে কিশোর আর রবিন। এমন সময়, পোস্ট অফিসের সামনে লোকের ভিড় চোখে পড়ল ওদের। কাচে ঢাকা নোটিশ বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই।

‘আবার কী হলো?’ বলে, লোকজনের ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল রবিন। একই পথ ধরল কিশোরও।

মস্ত একটা পোস্টার সাঁটা বোর্ডের গায়ে। বড় বড় অক্ষরে, কালো কালিতে লেখা:

‘৫০ হাজার ডলার পুরস্কার।’

নিচে, তার চেয়ে সামান্য ছোট অক্ষরে লেখা:

‘টাওয়ার ম্যানশনের লাইব্রেরির সিন্দুকে থাকা গয়নাগাটি আর সিকিউরিটি বন্ড চুরি করেছে যারা, তাদের ধরিয়ে দেওয়ার মতো কোনো তথ্য দিতে পারলে উপরোক্ত পুরস্কার দেওয়া হবে।’

পুরস্কারটা ঘোষণা করা হয়েছে জন বিলসনের পক্ষ থেকে।

‘আরে, তার মানে তো মি. পিটারসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়েছে!’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন।

‘তাই তো মনে হচ্ছে। চল তো, ববকে পাই কি না দেখি।’

পুরস্কারের অঙ্ক নিয়ে কথা বলছে চারপাশের লোকজন। শোনা যাচ্ছে নানা রকম মন্তব্য।

‘৫০ হাজার ডলার!’ ভিড় গলে পোস্ট অফিসের কাছ থেকে সরে এসে বলল কিশোর। ‘অনেক টাকা, রবিন।’

‘হ্যাঁ,’ সায় দিল রবিন।

‘আর, সবার মতো আমাদেরও ওটা রোজগার করে নেওয়ার সুযোগ নিতে তো কোনো বাধা দেখছি না।’

‘আমার মনে হয়, রাশেদ আঙ্কেল আর পুলিশ বাদ থাকবে ওই পুরস্কারের লিস্ট থেকে—যেহেতু চোরটাকে খুঁজে বের করা এমনিতেই তাদের দায়িত্বের ভেতর পড়ে। কিন্তু আমরা ওকে ধরতে পারলে, টাকাটা পেয়ে যেতে পারি। কলেজ ফান্ডে রাখার জন্য ভালো একটা অঙ্ক।’

‘তাহলে আর দেরি কেন! আরে, ওই তো বব আসছে।’ কিশোর বলল।

রাস্তা দিয়ে বব পিটারসনকে হেঁটে আসতে দেখা গেল ওদের দিকে। গত রাতের চেয়ে অনেক বেশি খুশি খুশি দেখাচ্ছে ওকে। গোয়েন্দাদের দেখে মুখ–চোখ আরও উজ্জ্বল হলো।

‘বাবাকে ছেড়ে দিয়েছে,’ বলল সে। ‘কিশোর, তোমার চাচাকে ধন্যবাদ। বাবার ওপর থেকে চার্জ তুলে নেওয়া হয়েছে।’

‘শুনে খুব ভালো লাগছে!’ উত্ফুল্ল কণ্ঠে বলল রবিন। ‘পুরস্কার ঘোষণা করেছে দেখলাম।’

‘কিশোরের চাচা মি. বিলসনকে বুঝিয়েছেন, কাজটা বাইরের কারও। ওস্তাদ চোরের কাজ। চিফ ফ্লেচারও স্বীকার করেছেন যে বাবার বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। তাই ওরা ছেড়ে দিয়েছে বাবাকে। বিরাট স্বস্তি পেলাম। মা আর আমার বোন দুজনের তো চিন্তায় পাগল হওয়ার দশা হয়েছিল।’

‘তা তো হবেই,’ সমবেদনা জানাল কিশোর। ‘তো এখন কী করবেন আঙ্কেল?’

‘জানি না,’ বলল বব। ‘তবে টাওয়ার ম্যানশন থেকে তো চলে যেতেই হবে। মি. বিলসন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, চার্জ তুলে নেওয়া হলেও অপরাধের সঙ্গে বাবার জড়িত না থাকার ব্যাপারে তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত নন। কাজেই বরখাস্ত করেছেন বাবাকে।’

‘খারাপই হয়ে গেল। কিন্তু ভেবো না, তোমার বাবা ঠিকই আরেক জায়গায় কাজ জুটিয়ে নিতে পারবেন,’ সান্ত্বনা দিয়ে বলল কিশোর।

‘জানি না পারবে কি না। চুরির দায়ে অভিযুক্ত কাউকে তো কারও পছন্দ করার কথা নয়। আজ বিকেলেই দুই–তিন জায়গায় চেষ্টা করেছে বাবা, কোথাও কাজ পায়নি।’

চুপ হয়ে গেল গোয়েন্দারা। পিটারসন পরিবারের জন্য খারাপ লাগছে ওদের। আরও একবার প্রতিজ্ঞা করল মনে মনে, যেভাবে হোক সাহায্য করবে অসহায় পরিবারটিকে।

চলবে...

আরও পড়ুন